ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম

Daily Inqilab মেজর জেনারেল এম এ মতিন, বীর প্রতীক (অব.)

২৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:২৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৩২ পিএম

ইতিহাস কেবল অতীত বা কোন স্থির বিষয় নয়, ইতিহাস হচ্ছে চলমান প্রক্রিয়া, এক কথায় ইতিহাস আমাদের ভবিষ্যতও। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। তাদেরকে জানতে হবে ভারত বিভক্তির প্রেক্ষাপট তথা ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২১৪ বছরব্যাপী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, তাদেরকে জানতে হবে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন হঠাৎ করে আমাদের জাতীয় জীবনে আবির্ভূত হয়নি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি, বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত বাসনা আর স্বপ্ন থেকে জন্ম নিয়েছে একাত্তরের বাংলাদেশ, আমাদের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম এবং প্রকৃত অর্থে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় তার অব্যবহিত পর থেকেই। তাদেরকে আরও জানতে হবে, আমাদের এ সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আছে আমাদের দু’টো মহৎ অর্জন, আর তা হলো— ’৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ‘৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।

উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৫৮ সালে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়, তারই সূচনামাত্র। ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে করায়ত্ত করে রাখে ক্ষমতার সকল মসনদ, লুণ্ঠন করে এদেশের সম্পদ, চালু করে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা। বিজাতীয় শাসন, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের যাতাকলে জাতি নিষ্পেষিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে শুরু হয় আন্দোলন, বিদ্রোহ ও প্রতিরোধযুদ্ধ। ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান মীর কাসিম, মহিশুরের হায়দার আলী ও তৎপুত্র টিপু সুলতান; এছাড়া ফকির বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, মুজাহিদ নেতা সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর জিহাদ আন্দোলন, বাঁশের কেল্লাখ্যাত তিতুমীরের সংগ্রাম, ব্রিটিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক ও নীল চাষীদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ফরায়েজী আন্দোলন, এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব বা স্বাধীনতা সংগ্রাম। এসবই ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের শতবর্ষব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা গণ-জাগরণের ধারাবাহিকতার এক একটি মাইলফলক।

সিপাহী বিপ্লবে মুসলমানদের ভূমিকাই ছিল প্রধান ও মুখ্য। তাই সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর এ উপমহাদেশে মুসলমানদের ওপর ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা ছিল অনেক বেশি এবং তা ছিল ভয়াবহ। বিশেষ করে শিক্ষিত সচ্ছল মুসলমানদের ধ্বংস সাধনে তারা প্রথম থেকেই তৎপর হয়। তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার প্রয়াস ও প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আঠারো শতক পার হওয়ার আগেই ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে বেছে বেছে একশ্রেণির নব্য হিন্দু জমিদার সৃষ্টি করা হয় এবং ইংরেজ তোষক নব্য হিন্দু ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণির উদ্ভব ঘটানো হয়। এভাবেই গড়ে ওঠে নব্য হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইংরেজদের সহায়তায় এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যায়, সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রকার চাকরিসহ ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তারা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে এবং সমাজে বিত্তবান শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুসলমানদের সামাজিক জীবনে এর প্রভাব হলো সুদূরপ্রসারী। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান, এ দু’সম্প্রদায়ের মাঝে পার্থক্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

পলাশী বিপর্যয়ের পরবর্তী একশ’ বছর মুসলমানরা ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য শুধুমাত্র সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ব্রিটিশ-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃক পৃষ্ঠপোষিত সাহিত্যচর্চাও তারা বয়কট করে চলে। অপরদিকে ভারতীয় হিন্দুসমাজ ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তুলে এবং ক্রমশঃ উন্নতির পথে অগ্রসর হয় এবং কালক্রমে শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ও প্রসার ঘটে। ১৮৮৫ সালে শিক্ষিত হিন্দুগণ নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দেশীয় স্বার্থ রক্ষার নামে অনেক মুসলমানও গোড়ার দিকে কংগ্রেসে যোগদান করেন। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস নিজেকে জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করলেও প্রতিষ্ঠার দুন্দশক অতিক্রান্ত না হতেই স্বায়ত্তশাসন আদায়ের প্রশ্নে এর নেতৃত্ব চলে যায় গোঁড়া হিন্দু মতবাদে বিশ্বাসী চরমপন্থীদের হাতে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানকল্পে চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের নামে সরাসরি মুসলমানবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। একই সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানকল্পে গোঁড়া হিন্দু মতবাদে বিশ্বাসী কতিপয় চরমপন্থী হিন্দু লেখক মুসলমানবিরোধী সাহিত্য রচনার কাজে ব্রতী হন। প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘আনন্দমঠ’ ইত্যাদি গ্রন্থ। রচিত হয় ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিবাজী উৎসব কবিতা। ফলে কংগ্রেস অনুসৃত নীতি ও বর্ণহিন্দু সমাজের কার্যকলাপ থেকে ততোদিনে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শুধুমাত্র মুসলমানদের অস্তিত্ব অস্বীকার করাই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিন্দু সমাজের আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই প্রথমদিকে যারা কংগ্রেসে যোগদানের পক্ষপাতি ছিলেন তারাও সরে দাঁড়ান কংগ্রেসের পথ থেকে। তাদের এ আশঙ্কা অচিরেই সত্যে পরিণত হয়।

‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ১৮৯১ সালে এদেশে ‘যুক্ত-নির্বাচন’ প্রথায় অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। ভোটাধিক্যের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা সর্বত্রই নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে। দেশব্যাপী কোথাও একজন মুসলমান প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেনি। শাসনকার্যে সর্বত্র শুধুমাত্র হিন্দুদের প্রতিনিধি, মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার মতো কেউ থাকে না। এমতাবস্থায় মুসলমানরা বুঝতে পারে যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ব্যতীত তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আর কোনো পথই খোলা নেই। পৃথক নির্বাচনের পথ বেছে নেয়ার যৌক্তিকতা আরো জোরদার হয় ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’কে ঘিরে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশী বিপর্যয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্থ এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূত্র ধরে শুরু হয় এ উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিক্ষোভ মোকাবিলা করার জন্য ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ,মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এভাবেই উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের সূচনা হয়। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, শুরু হয় ব্যাপক গণআন্দোলন।

এমতাবস্থায়, বর্ণহিন্দুদের বৈরী আচরণ, কংগ্রেসী নেতৃত্বের তীব্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের আবির্ভাবের ফলে মুসলমান নেতাগণ শংকিত হয়ে পড়েন যে, ভবিষ্যতে স্বাধীন ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের শাসনই কায়েম হবে। বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান ছাড়া অন্য সব প্রদেশে মুসলমানরা ছিলেন সংখ্যালঘু। এ প্রেক্ষিতে চল্লিশ কোটি মানুষের অখন্ড ভারতীয় শাসনতন্ত্রে নয় কোটি মুসলমানের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্যে একটা রক্ষাকবচ অর্জন করা ছিল মুসলমান নেতাদের বিবেচনায় অপরিহার্য। এ জন্যে তারা প্রদেশগুলির পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যূনতম ক্ষমতা এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা দাবি করেন।

১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয় নতুন নির্বাচন নীতি, প্রতিষ্ঠিত হয় স্বতন্ত্র নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের প্রথা। মুসলমানরা অধিকার পায় মুসলমানদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার। এভাবেই মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করে, যা শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পাকিস্তান সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করে।

১৯২৮ সালের আগষ্ট মাসে কংগ্রেস নেতা পন্ডিত মোতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি ‘নেহেরু রিপোর্ট’ নামে ভারতের ভবিষ্যত সংবিধানের যে রূপরেখা তথা খসড়া পেশ করে তাতে মুসলমানসহ অপরাপর সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ও স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। নেহেরু রিপোর্টের চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য ১৯২৮ সালের ২২ ডিসেম্বর কোলকাতায় সর্বদলীয় সম্মেলনে নেহেরু রিপোর্ট পেশ করা হয়। এ সম্মেলনে জিন্নাহ মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে নেহরু রিপোর্টের উপর মুসলমানদের দাবি- দাওয়া সম্পর্কীয় কতিপয় সংশোধনী পেশ করেন। কিন্তু গভীর রাত্রি পযন্ত আলোচনার পরও জিন্নাহর একটি সংশোধনী প্রস্তাবও গৃহীত হয় না। সংখ্যাধিক্যের জোরে মুসলমানদের সব প্রস্তাব বাতিল করে দেয়া হয়।

কোলকাতার সর্বদলীয় সম্মেলন থেকে লীগ নেতা জিন্নাহ অশ্রুসজল চোখে ফিরে এলেও তখন পর্যন্ত তিনি ভারত বিভক্তির পক্ষে ছিলেন না। তিনি চাইতেন, ভারতবর্ষ একটি অখন্ড স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হোক। তাই হিন্দু-মুসলিম সমঝোতার প্রয়াসে ১৯২৯ সালের প্রথমদিকে তিনি ‘কংগ্রেস’ ও ‘হিন্দু মহাসভার’ নিকট ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের কাঠামো তৈরির জন্য মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ে অপরিহার্য দিকসমুহ উল্লেখপূর্বক উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন, যা ‘দিল্লী প্রস্তাব’ এবং ‘জিন্নাহর চৌদ্দ দফা নামে খ্যাত। চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী এবারও কংগ্রেস নেতৃত্ব ১৪ দফার সব দাবি শুধু অগ্রাহ্যই করেনি, বরং হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস একইভাবে মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক বলে বিষোদগার করে। তারা তাদের সংখ্যাধিক্যের শক্তি দিয়ে ব্রিটিশকে বাধ্য করে তাদের দাবি আদায় করে নেয়ার পথে অগ্রসর হয়।

স্বাধীন ভারতবর্ষে মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিরাপদ হোক, জিন্নাহ কেবলমাত্র তাই চেয়েছিলেন। তাঁর ভয় ছিল উপযুক্ত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা না থাকলে নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই হিন্দুরা মুসলিম সমাজকে দাবিয়ে রাখবে। কিন্তু সংকীর্ণচেতা হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের এই ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে কোন মতেই রাজি হলেন না।

১৯৩৭ সালে ভারত উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দুটি প্রধান দল হিসেবে অংশ গ্রহণ করে। নির্বাচনে বাংলা, সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করে। অপরদিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। কেন্দ্রে সরকার গঠন প্রশ্নে কংগ্রেস মুসলিম লীগকে প্রায় অগ্রাহ্য করে। এটি ছিল স্বাধীন অবিভক্ত ভারতে শাসনকার্য পরিচালনার একটি পরীক্ষামাত্র। এ পরীক্ষায় দেখা যায়, তিন-চতুর্থাংশ হিন্দু-জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতে মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই। কংগ্রেস শাসিত এসব প্রদেশসমূহে মুসলমানদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন।

জিন্নাহ বুঝতে পারলেন যে, দেশে হীন সাম্প্রদায়িকতাই সবকিছু মূল্যায়নের মাপকাটি, সে দেশে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা চিরকাল সংখ্যাগুরু হিসেবে সকল প্রকার সুবিধাদি ভোগ করবে, আর সংখ্যালঘু মুসলমানরা চিরকাল তাদের পদতলে বসে অশ্রুপাত করবে। তা হতে পারে না। এসব ভেবে-চিন্তে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, মতবাদ ও কৌশল পরিবর্তন করে উপমহাদেশের মুসলমানদের মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এমতাবস্থায় এবং বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে এদেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দ অনুভব করলেন যে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক আচার-আচরণ এবং হিংস্র কর্মকান্ড থেকে রেহাই পেতে হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি স্থাপন তথা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের কোনো বিকল্প নেই। এসব বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই ভারতের ‹হিন্দু› ও ‘মুসলমান’ যে দু’টো পৃথক জাতি সে সম্পর্কে দ্বিজাতিতত্ত্বের জনক লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৮ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর অত্যন্ত জোরালো ও সুস্পষ্টভাষায় বক্তব্য রাখেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘রাষ্ট্র বিজ্ঞানের যে কোনো সংজ্ঞানুযায়ী ভারতের মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাদের অবশ্যই নিজেদের বসতভূমি, ভূখন্ড এবং রাষ্ট্র থাকতে হবে।’

অতঃপর তিরিশের দশকে মুসলিম লীগ গণসংগঠনে পরিণত হয় এবং এই মুসলিম লীগের প্ল্যাটফর্ম থেকেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে এদেশের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ উত্থাপন করে পাকিস্তান আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক গোড়াপত্তন করা হয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে মুসলিম লীগ একটি যথার্থ জাতীয় সংগঠনে পরিণত হয়।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে অঞ্চল হিসেবে পূর্ববঙ্গ ও জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি মুসলমান সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তাই, ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন সর্বাধিক শক্তি অর্জন করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান ইস্যুই ছিল মুসলিম লীগের মূল ইস্যু। প্রদেশ হিসেবে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সপক্ষে জনগণের রায় ঘোষিত হয়। এই প্রদেশে লীগ প্রার্থীগণ কেন্দ্রীয় আইন সভার সবক›টি মুসলিম আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টিতে জয়ী হন। মুসলিম লীগের এ অভূতপূর্ব বিজয় বাঙালি মুসলমানদের শাণিত আত্মোপলব্ধিকে স্পষ্ট করে তোলে। পাকিস্তান ততোদিনে এ উপমহাদেশের মুসলিম জনতার দাবিতে পরিণত হয়।

সুতরাং ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে ধর্মই একমাত্র নিয়ামক ছিল, ঐতিহাসিকগণ তা মানতে নারাজ। তাদের মতে, ধর্মের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কারণও ছিল। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপনের পূর্বে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ অখন্ড ভারতের কাঠামোর মধ্যে মুসলমানদের নানা ধরনের রক্ষাকবচসহ স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়াস পান। কিন্তু তাদের সকল প্রচেষ্টা একের পর এক ব্যর্থ হয়। এমনকি ১৯৪৬ সালের দিকে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের অভ্যুদয় যখন নিশ্চিত তখনও মুসলিম লীগ ও তার নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন অবিভক্ত ভারতের পক্ষে। ক্রিপস প্রস্তাবিত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান সমর্থন করে মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলন থেকে সরে গেলেও পরে কংগ্রেসের কারণে ক্রিপস মিশন প্ল্যান ব্যর্থ হয়ে যাবার পর মুসলিম লীগ তার পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসে।

অথচ, আজ যারা ভারত বিভক্তির জন্য একতরফাভাবে জিন্নাহকে দোষারূপ করে থাকেন তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না, জিন্নাহ তার শেষ সহনশীলতা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন, ভারত যেন বিভক্ত না হয়। এটা কংগ্রেস বিশেষ করে গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেলচক্র যারা ভারত বিভক্তিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। জিন্নাহ সর্বশক্তি দিয়ে গৃহযুদ্ধ, রক্তপাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। অথচ, এই প্রাক্তন কংগ্রেসী নেতা জিন্নাহকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে তাতে মনে হয়, তিনি একাই যেন পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া, ভারত-বিভক্তির অনেক বছর পরও ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো বিশ্বকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে অপপ্রচার করে আসছে যে, ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। মূল সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, কায়েদে আযমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উপমহাদেশের তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের দূরদর্শীতা ও দৃঢ়চিত্ততা গান্ধী, প্যাটেল, নেহরু, মাউন্টব্যাটেন এবং এটলীর মিলিত ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে তাদের নিজেদের জন্যে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান গঠন করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এসব ঐতিহাসিক তথ্য তথা ঘটনাপঞ্জী না জেনে শুধুমাত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে একপেশে জ্ঞান দান করবে। তাই, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের পলাশী বিপর্যয় থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন ও শতবর্ষব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিপাহী বিপ্লব পরবর্তী মুসলিম সমাজ, নতুন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান, অখন্ড হিন্দু-ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, কালক্রমে মুসলমানদের পৃথক আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি, পরিণামে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা পরিকল্পনা এবং ভারত বিভক্তি. ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও ধারণা থাকা আবশ্যক।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার