ঢাকা   সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ | ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আমাদের অস্তিত্বের লড়াই

Daily Inqilab ড. অজয় কান্তি মন্ডল

২৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:১৪ এএম

প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন এবং এর ইতিহাস অন্য সকল জাতির ইতিহাস এবং সংগ্রামী জীবনগাঁথাকে পেছনে ফেলে যায়। স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালির যে ত্যাগ তা ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত। এই অর্জন, নৃশংস হত্যাকান্ডের একটি রক্তাক্ত দলিল, যেটা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। এর পেছনে ছিল পাকিস্তানি শাসক চক্রের শোষণ এবং নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাসের স্তরে স্তরে দক্ষ কান্ডারি হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেজন্য বাঙালি জাতি হৃদয়ে ধারণ করে, এই স্বাধীনতা অর্জনে যিনি অগ্রনায়কের ভূমিকায় ছিলেন তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, অন্ধকারের অতল গহীনে ডুবতে থাকা জাতির নিকট আবির্ভূত হওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্র, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা, সোনার বাংলার স্বপ্ন সারথি, জনগণের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মহান ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী প্রণেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া এই মহান ব্যক্তিত্ব কিশোর বয়স থেকেই সর্বদা অন্যায়ের প্রতিবাদী ছিলেন। যিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছেন এবং দিয়ে গেছেন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। কিশোর থেকে বঙ্গবন্ধু কখনো পিছপা হননি নায্য কথা বলতে। উপরন্তু ভীতি ও অত্যাচারের মুখে শোষিত মানুষের অধিকারের আদায়ের সংগ্রামে তিনি সচেষ্ট থেকেছেন সর্বক্ষণ। অত্যাচার এবং অনাচারের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রামী জীবন পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। আর সেজন্য শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বের ইতিহাস জুড়ে মিশে আছে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রতি পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ, যেটা শুরু হয়েছিল দেশ বিভাগের পর থেকেই। বাংলার মানুষের একের পর এক নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং ক্রমান্বয়ে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্ণাঙ্গ একটি দলিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যে দলিলের প্রতিটি আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বের ইতিহাসকে খুব সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করতে গেলেও যে বিষয়গুলো সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া লাগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১১ দফা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল হোতা ছিলেন পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তথা মুসলিম লীগের নেতা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি শাসক বাহিনী নানানভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে আসছিল। যে শোষণের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এই শোষণের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার অভিসন্ধির মধ্য দিয়ে এবং ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ নানা ক্ষেত্রে।
পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি প্রথম আঘাত এনেছিল ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক সমাবেশে জিন্নাহ’র ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। উক্ত ঘোষণার পরপরই রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনগণ ওই ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। আর এ ঘোষণার মাত্র তিনদিন পরে ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের অন্য একটি সভায় জিন্নাহ পুনরায় একই কথা বলেন। সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা চিৎকার করে জিন্নাহ’র বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদে শামিল হয়ে অনেক ছাত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবরণ করেন। মূলত জিন্নাহ’র ওই ঘোষণা থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে। ওইদিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানোর ঘটনায় রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ঢাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের কারাভোগ শেষে বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি বাঙালির কাছে পরাধীনতার শিকল ভাঙার মহামন্ত্র পৌঁছে দেওয়া। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদে নেমে পড়েন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের পরাজয় হয় যেটার প্রধান কারণ ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলে, ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করতে পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে যুক্তফ্রন্ট (যার প্রধান দল ছিল আওয়ামী লীগ) গঠন করে। ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা, এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকতে পারবে। কেননা, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৪ ভাগ বাঙালি হলেও দেখা গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সকল উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত ছিল পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। এসব পাকিস্তানি শাসকের নির্দেশে মুসলিম লীগ সরকার বাঙালিদের সব ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত করে চলছিল। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন মুসলিম লীগের এই কর্তৃত্ববাদী ও একপেশে শাসনের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত এবং কার্যকর বিরোধী দল গড়ে তুলতে হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের শুভ জন্ম হয়েছিল। দলটি গঠনের পরে প্রথমে বঙ্গবন্ধু যুগ্ম সম্পাদক এবং ক্রমান্বয়ে ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে সভাপতি হন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট সর্বাধিক আসন পেয়ে জয়ী হলেও পাকিস্তান সরকার ৯০ দিনের মধ্যে সেই যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে বাঙালির ওপর কেন্দ্রের শাসন চাপিয়ে দেয়। পরবর্তীতে আবার যখন পাকিস্তানি শাসক চক্র যখন বুঝতে পারে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিততে পারে তখন ১৯৫৮ সালে সরাসরি সামরিক শাসন জারি করে। এসব নানা ধরনের অগণতান্ত্রিক নিপীড়ন বাঙালিকে স্বাধীনতার চেতনায় আস্তে আস্তে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।

পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিকভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা দমিয়ে রাখা হয়। অথচ পাকিস্তানের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক আয়ের খাত ছিল পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক। যেমন পূর্ব পাকিস্তান পাট রপ্তানির মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়নের পেছনে তার অধিকাংশই বিনিয়োগ করা হতো। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তানি শাসনামলে জাতীয় বাজেটের মাত্র ২৮.৭% ব্যয় করা হত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। তৎকালীন অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করে দেখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান চরমভাবে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হচ্ছে এবং বাঙালির টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি পরবর্তীতে ছয় দফার ভিত্তি রচনা করে।

গোটা একটি দশক পাকিস্তান সামরিক সরকারের অধীনে ছিল। রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ বা সীমিত ছিল। অধিকাংশ সম্মুখবর্তী নেতারা বেশির ভাগ সময় কারাগারে ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেও বাঙালিদের আন্দোলন থেমে থাকেনি। রাজনীতিবিদেরা কারাবন্দী থাকলেও শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ তখন প্রতিবাদী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন এবং পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আন্দোলনকে সফলভাবে সচল রাখতে চেষ্টা করেন। এ সময় বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সেটি আরও সফলভাবে জনসমক্ষে প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁরা দুই অর্থনীতির তত্ত্ব তুলে ধরেন। বাঙালিদের ওপর দমন-পীড়ন দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ায়, গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এসব কিছু অনুধাবন করেই প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুসহ কিছু তরুণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা শুরু করতে থাকেন।

আর এ দাবিকে সামনে রেখেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা। ছয় দফা দাবিগুলোর ভিতর বলা হয় শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র এ দুটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আলাদা মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে। কর, বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা নীতিমালা থাকবে। এছাড়া ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী থাকার প্রস্তাব করা হয় এবং সেই সাথে সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবি জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেরেছিলেন ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের দাবির পেছনে গোটা বাঙালি জাতিকে এক করতে। পুরো জাতির ওই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছিল। কেননা ছয় দফা আন্দোলনের সময় শ্রমিক শ্রেণি, বস্তিবাসী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষের আন্দোলনে নামতে দেখা যায়। সারাদেশে ছয় দফা আন্দোলনের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন দেখে পাকিস্তান সরকার সহজেই বুঝে গিয়েছিল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেভাবেই হোক, এই আন্দোলনকে থামাতে হবে। পাকিস্তান সরকার বুঝেছিল আন্দোলনের মূল হোতা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে যেভাবেই হোক জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। পরে এ মামলায় আটক করা হয় গণতন্ত্রের পক্ষে এ সংগ্রামী নায়ককে।

পাকিস্তান সরকারের এই বিবেকহীন পদক্ষেপের কারণেই ১৯৬৯ সালের ছাত্র আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ছাত্ররা ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। ফলে ছয় দফার সাথে যুক্ত হয় ব্যাংক, বিমা, বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণের দাবি। সারাদেশে গণআন্দোলন তীব্র থেকে এত তীব্রতর হতে থাকে। জনগণের আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুবশাহীর পতন হয় এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে রাজি হয়। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণাকালে নজিরবিহীন জনসংযোগের মাধ্যমে গোটা জাতিকে স্বাধিকারের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। নির্বাচনের প্রচারণা কালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ হিসেবে উল্লেখ করতে থাকেন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। এই নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের দলের নেতা হন এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের বৈধতা পান। এরপর থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস জুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল সেটা নজিরবিহীন।

জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বিশাল জনসভায় সমবেত জনতাকে প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে বলেন। ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তখন সারাদেশের মানুষ, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও সে ডাকে সাড়া দেন। ভাষণ সমাপ্তির প্রাক্কালে জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, আবেগঘন বক্তৃতা, বাংলার জনসাধারণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত, জাত, পাত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের কার্যত সরকার প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে। এই অনুভূতিই তাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে পাকিস্তানি শাসকরা অনুধাবন করেছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তখনই ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর সশস্ত্র পাক বাহিনী ভীরু কাপুরুষের মতো ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক গণহত্যা চালায়। এই নারকীয় হত্যাকান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিদারুণ পীড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি জানতেন যেকোন মুহূর্তেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তাই তিনি আর কালক্ষেপণ না করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। লাখ জনতা শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ওই ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন এবং একমাত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালিদের ওপর চলল পাকিস্তানি আগ্রাসন। লাখ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হলেও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে অবিচল ছিল। ঐ ঐক্য শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, আমাদের টিকে থাকার লড়াই। আর এ লড়াইয়ের ইতিহাস আমাদের গৌরবের ইতিহাস।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী সিন্ডিকেট দমানো যায়নি
প্রশাসনিক সংস্কার সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
জনশক্তি রফতানিতে কাক্সিক্ষত গতি বাড়েনি
পুনঃতদন্তের উদ্যোগ নেই
নাগরিক সেবায় দুই সিটির চ্যালেঞ্জ
আরও

আরও পড়ুন

আ. লীগ নেতা হানিফের সাম্রাজ্য দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড়

আ. লীগ নেতা হানিফের সাম্রাজ্য দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড়

‘সবার চোখেই সাদা পোশাকের রঙিন স্বপ্ন’

‘সবার চোখেই সাদা পোশাকের রঙিন স্বপ্ন’

দাবি মিটিয়ে অমিতের আরেকটি সেঞ্চুরি

দাবি মিটিয়ে অমিতের আরেকটি সেঞ্চুরি

হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড ডিবি পুলিশ ও প্রেমিকার পরিবার- অভিযোগ স্বজনদের

হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড ডিবি পুলিশ ও প্রেমিকার পরিবার- অভিযোগ স্বজনদের

না.গঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো ৯৬ জন আক্রান্ত

না.গঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরো ৯৬ জন আক্রান্ত

অক্টোবরে সড়কে প্রাণ গেছে ৩৭৭ জনের : বিআরটিএ

অক্টোবরে সড়কে প্রাণ গেছে ৩৭৭ জনের : বিআরটিএ

সাধারণ ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষনা করবে কিনা তা জনগণই নির্ধারণ করবে ____সারজিস আলম

সাধারণ ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষনা করবে কিনা তা জনগণই নির্ধারণ করবে ____সারজিস আলম

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাথে পেশাভিত্তিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সাথে পেশাভিত্তিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত

নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া দেশে স্বস্তি ফিরবে না : বুলু

নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া দেশে স্বস্তি ফিরবে না : বুলু

সড়ক নিরাপদে পদক্ষেপ নিচ্ছে ডিএনসিসি

সড়ক নিরাপদে পদক্ষেপ নিচ্ছে ডিএনসিসি

ভূমিতে তদারকি ও সমন্বয় সাধনের নির্দেশনা

ভূমিতে তদারকি ও সমন্বয় সাধনের নির্দেশনা

খেলাপি ঋণ বেড়ে ২,৮৪,৯৭৭ কোটি টাকা

খেলাপি ঋণ বেড়ে ২,৮৪,৯৭৭ কোটি টাকা

আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া সেই আসামির বিরুদ্ধে মামলা, সাময়িক বরখাস্ত দুই পুলিশ সদস্য

আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া সেই আসামির বিরুদ্ধে মামলা, সাময়িক বরখাস্ত দুই পুলিশ সদস্য

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষার ফল প্রকাশ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষার ফল প্রকাশ

ঢাবি ছাত্রদলের ৬ নেতাক অব্যাহতি

ঢাবি ছাত্রদলের ৬ নেতাক অব্যাহতি

বিশ্বনবীর (সা.) আদর্শই বিশ্বমানবতার একমাত্র মুক্তির পথ

বিশ্বনবীর (সা.) আদর্শই বিশ্বমানবতার একমাত্র মুক্তির পথ

টঙ্গীতে বিএনপি নেতাদের হুঙ্কারে ঝুট নিয়ে বেকায়দায় কারখানা কর্তৃপক্ষ

টঙ্গীতে বিএনপি নেতাদের হুঙ্কারে ঝুট নিয়ে বেকায়দায় কারখানা কর্তৃপক্ষ

অটোরিকশার যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত- অটোচালক আহত

অটোরিকশার যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত- অটোচালক আহত

আশুলিয়ায় হত্যা মামলার আসামিসহ গ্রেফতার ৯

আশুলিয়ায় হত্যা মামলার আসামিসহ গ্রেফতার ৯

ওয়াশিংটনে লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর পুত্র তানজিরের ইন্তেকাল

ওয়াশিংটনে লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর পুত্র তানজিরের ইন্তেকাল