সংস্কৃতি চর্চার নামে কী হচ্ছে

Daily Inqilab মেহেদী হাসান পলাশ

১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:১৬ এএম

বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান। তৎপ্রেক্ষিতে এদেশের জাতীয় উৎসব উৎযাপনের রীতি ও পদ্ধতিতে সেই গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির বিশ্বাস ও আচারের প্রতিফলন থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতির নামে যেভাবে পৌরাণিকতা ও পৌত্তলিকতাকে মুসলিম সমাজে, পরিবারে ও ব্যাক্তিজীবনে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে তাতে আপত্তি ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে, এর সাথে বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের হাজার বছরের ঐতিহ্যের কোনো সাদৃশ্য না থাকার পরও তা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করানোর জোর চেষ্টাই আপত্তির মূল কারণ।

রাজধানীতে রমনাপার্কে অশ্বত্থবৃক্ষের বেদীমূলে মাঙ্গলিক গান গেয়ে নববর্ষ বরণের যে রীতি অথবা রেওয়াজ তার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৬৭ (মতান্তরে ১৯৬৫) সালে ছায়ানট শিল্পীগোষ্ঠি এর প্রবর্তন করে। মূলত তৎকালীন সরকারের রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ নীতির বিরোধিতা করেই ছায়ানট রমনার অশ্বত্থমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ থেকে বুঝা যায়, রমনার অশত্থমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবের একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। ছায়ানট এই বাংলা নববর্ষ বরণে যে বিশেষত্ব নিয়ে আসে তার সাথে শত শত বছর এ অঞ্চলের মানুষ যেভাবে বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে তার মিল নেই। ছায়ানট প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে সূর্যোদয়ের পূর্বে তার নিজস্ব শিল্পীগোষ্ঠি নিয়ে রমনা পার্কে লেকের পাড়ে অবস্থিত অশ্বত্থবৃক্ষের বেদীমূলে সূর্যদেবের উদয়ের অপেক্ষায় থাকে। যখন পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হয় তখনই শিল্পীরা তার কাছে নিখিল ও অখিলের কল্যাণ কামনায় গেয়ে ওঠে নানা মাঙ্গলিক এবং প্রার্থনামূলক সঙ্গীত, যেমন ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল কর, উজ্জ্বল কর, সুন্দর করো হে...’।

ছায়ানটের এই গান নির্বাচনেও একটি বিশেষত্ব লক্ষ্যণীয়। অনুষ্ঠানে যেসব গান গাওয়া হয় এবং কবিতা আবৃত্তি করা হয় তার শতকরা ৯০ ভাগ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং বাকী ১০ ভাগ অন্যান্য কবি বা গীতিকারের। সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি। সুতরাং তার কবিতা বা গান গাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, ছায়ানটের এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের সেই গানগুলোই বেছে নেয়া হয়, যে গানগুলো মূলত হিন্দু দেবদেবীর কাছে মঙ্গল কামনা করে বা ঐসব দেবদেবীর স্তুতি করে লেখা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গান। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের যে দু’একটি গান গাওয়া হয়, তাও ঐ শ্যামা সঙ্গীত।

এদিকে রমনা অশ্বত্থমূলের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে একটি মঙ্গল শোভা যাত্রা বের করা হয়। এর সাথেও আমাদের হাজার বছরের নববর্ষ উৎযাপনের ঐতিহ্যের কোনো মিল নেই। মূলত ১৯৮৫ সালে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন সর্বপ্রথম যশোরে বাংলা নববর্ষে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন করে। তারই অনুকরণে ১৯৮৯ সালে চারুশিল্পী সংসদ ঢাকায় নববর্ষে মঙ্গল শোভা যাত্রার প্রচলন করে। এ শোভা যাত্রাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রদর্শনী বলা চলে। মনসাপট, লক্ষ্মীর সরা, বেদ-এ বর্ণিত নানা দেবদেবীর বাহন বিভিন্ন পশুপাখির ডামি, পূরাণের নানা অসূর, রাক্ষস, ভূত-প্রেত, প্যাঁচার মুখোশ সহকারে এই শোভাযাত্রা বের হয়। আগামী বছরের সুফলা কামনা করে ধনের দেবী লক্ষ্মীর সরা রাখা হয়, বিদ্যার উন্নতি কামনা করে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন হংস ও বীণা রাখা হয়, অমঙ্গল থেকে দূরে থাকতে অমঙ্গলের দেবী মনসার পট রাখা হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রায়। আর এভাবে মুসলিম তরুণ-তরুণীরা সংস্কৃতির নামে তা গলাধঃকরণ করে নিজের অজান্তেই শিরক-এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে।

যেহেতু বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে নানা ধর্মের লোকদের সমন্বয়ে, তাই বাংলা নববর্ষ পালনেও ভিন্নতা থাকবে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের বাঙালি তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলা নববর্ষ পালন করবে, এটাই স্বাভাবিক। যদি কোনো বাঙালি হিন্দু সূর্যদেবের পূজা করে, অগ্নিস্নানে সুচী হয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, সিঁদুর পরে বাংলা নববর্ষ পালন করে, কিম্বা বাঙালি বৌদ্ধ তাদের মৃত স্বজনদের মঙ্গল কামনায় ফানুস উড়িয়ে বৈশাখ উদযাপন করে, বাঙালি খ্রিস্টান গির্জায় প্রার্থনার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখের দিনটি শুরু করে তাতে সমস্যা দেখি না। বাঙালি হিন্দু যদি পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভা যাত্রা করে তাতে সমস্যা নেই। তবে কোনো বাঙালি মুসলিমের সেই মঙ্গল শোভা যাত্রায় শামিল হওয়া উচিত নয়, উচিত হবে না। কারণ, আকীদাগতভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এই মঙ্গল-অমঙ্গলের ধারণার সাথে বিরোধ রয়েছে। তাছাড়া এই মঙ্গল শোভা যাত্রায় পৌরাণিক বিভিন্ন দেবদেবীরচিত্র, পৌত্তলিকতার উপাচার যুক্ত করা হয়। তাতে মুসলমানদের শামিল হওয়া সম্ভব নয়। বাঙালি মুসলিম নববর্ষকে বরণ করে নিতে যদি তাদের ধর্মীয় বিধি নিষেধের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন উপায়ে স্বাগত মিছিল করে, তাতে কোথাও বাধার কিছু দেখি না। ইসলাম নির্দোষ স্থানীয় সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করেনি।

গত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখের সাথে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালনেরও ধুম পড়েছে। সার্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতি বলে এই অনুষ্ঠানও পালিত হচ্ছে পহেলা বৈশাখের আগের দিন থেকে। ছায়ানট সাংস্কৃতিক বলয়ের লোকেরা কিছুকাল ধরে ঘরোয়াভাবে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করে আসছিল এবং তা জাতীয়ভাবে পালনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং কিছুটা সফলতাও পেয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির মূল উৎসব হচ্ছে চড়ক পূজা। বাংলাপিডিয়া মতে, এটি হিন্দুদের একটি ধর্মানুষ্ঠান। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে এটি পালিত হয়। এর অপর নাম নীলপূজা। পশ্চিমবঙ্গের গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজারই রকমফের। এ পূজা খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিব লিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। এ পূজার পুরোহিত হলেন আচার্য ব্রা‏হ্মণ বা গ্রহবিপ্র, অর্থাৎ পতিত ব্রা‏হ্মণ। চড়ক পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়ক গাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে কোথায়ও কোথাও এ অনুষ্ঠান এখনো প্রচলিত আছে। চৈত্র সংক্রান্তি বা চড়কপূজাকে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে বাংলাদেশি মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুর্নীতির অভিযোগে রাশিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী গ্রেফতার

দুর্নীতির অভিযোগে রাশিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী গ্রেফতার

নাহিদসহ ৩ সমন্বয়ককে হাসপাতাল থেকে ডিবি হেফাজতে

নাহিদসহ ৩ সমন্বয়ককে হাসপাতাল থেকে ডিবি হেফাজতে

গাড়ির কসরৎ দেখিয়ে বিখ্যাত কুইন অফ স্মোক

গাড়ির কসরৎ দেখিয়ে বিখ্যাত কুইন অফ স্মোক

১০০ বছর পর প্যারিসে পর্দা উঠলো অলিম্পিকের

১০০ বছর পর প্যারিসে পর্দা উঠলো অলিম্পিকের

‘খান ইউনিসে’ ৪ দিনে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ লাখ

‘খান ইউনিসে’ ৪ দিনে বাস্তুচ্যুত প্রায় ২ লাখ

পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কা

পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কা

ইসরাইলকে বোমা সরবরাহের নীতি পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র

ইসরাইলকে বোমা সরবরাহের নীতি পরিবর্তন করেনি যুক্তরাষ্ট্র

১ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে লোকসান ৬ কোটি

১ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে লোকসান ৬ কোটি

বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন

বিজিবির নিরাপত্তায় ট্রেনে জ্বালানি তেল পরিবহন

বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’

বাংলাদেশে সহিংসতা প্রসঙ্গে মমতা, ‘আমাকে শেখাবেন না, বরং আপনারা শিখুন’

চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক

চোটজর্জর বার্সাকে নিয়ে চিন্তিত ফ্লিক

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি