ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ পৌষ ১৪৩১

চট্টগ্রামের চন্দনপুরা তাজ মসজিদ

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

ইতিহাসের স্মারক হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র সিরাজউদ্দৌলা রোডে চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ। শতাব্দী প্রাচীন এ মসজিদটি মসজিদ-ই সিরাজ উদ-দৌলা নামেও পরিচিত ছিল একসময়। চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান হিসেবেও এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। অসীম সওয়াবের আশায় এ মসজিদে অনেকেই নামাজ আদায় করেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁর সেনাদল আরাকানের মগরাজাদের কাছ থেকে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করেন। এরপর এখানে মোঘল শাসন কায়েম হয়। তখন শাহি ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে মোঘল স্থাপত্য শিল্পের ছোঁয়ায় ছোট বড় অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সে সময়কার হামজা খাঁর মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, চকবাজার অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম, যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুরুতে চন্দনপুরা জামে মসজিদটি মসজিদ-ই সিরাজ উদ-দৌলা হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর ১৯৪৬ সালে মাস্টার আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তার বড় পুত্র আবু সাইয়্যেদ দোভাষ মসজিদটির পুনঃনির্মাণ এবং সংস্কার কাজ শেষ করেন। এরপর থেকে এটি হামিদিয়া মসজিদ হিসেবে পরিচিত।

বাংলায় মোঘল শাসনামলে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে এ মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ শুরু করেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ। মসজিদে ঢুকতে কার্নিশে খোদাই করে লিখা আছে তার নামটি। সংস্কার কাজে ব্যয় হয় সেই সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি। ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের দিকে মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ শেষ হয়। আর সে সময় সংস্কার কাজের জন্য লৌহজাত পণ্যসহ আনা হয় মোগল ঘরানার কারিগর। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য নানা উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল।

বাহারি রঙে সাজানো অনন্য ডিজাইনের মসজিদটি এখনও ধারণ করে আছে মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও গাম্ভীর্য। মসজিদের ওজুখানা, সিঁড়ির হাতল, কার্নিশ, দেয়ালসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অত্যন্ত নিখুঁত কারুকার্য। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পুরোনো এইসব ডিজাইনগুলোই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে নানান রঙের বর্ণাচ্ছটায়। মসজিদটির নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ১৫টি গম্বুজ। সবচেয়ে বড় গম্বুজটি তৈরিতে তৎকালীন সময়ের প্রায় চার লাখ টাকার ১৫ মণ রূপা ও পিতলের প্রয়োজন হয়। ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ প্রকাণ্ড গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। রাজা-বাদশাহদের মাথায় লাগানো তাজের মতোই গম্বুজে পড়া সূর্যের আলোকছটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো। এ কারণেই এ মসজিদটি তাজ মসজিদ হিসেবে পরিচিত পায়।

তবে এখন সেই নান্দনিকতা নেই। প্রতিটি গম্বুজে যাওয়ার জন্য আছে সিঁড়ি। গম্বুজ ও সিঁড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোঘল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতিচ্ছবি। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদের গম্বুজের চারপাশে লেখা আছে রাসূল (সা.)-এর পরিবার ও দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। মসজিদের সুউচ্চ মিনার, দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সূক্ষ্ম কারুকাজ। মসজিদের চারদিকে আছে হরেক রঙের ব্যবহার। মসজিদটির প্রতিটি অংশে সবুজ, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপীসহ হরেক রঙ ব্যবহার; লতা-পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে। অতীতে মাটির দেয়ালে কারুকাজে ছিল। চট্টগ্রামের আইকনিক ছবি হিসেবে এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকাশনায়। জাপানের এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়েছে।

স্থাপত্য শিল্পে তাক লাগানো এই মসজিদের আয়তন তিন গণ্ডার মতো। এছাড়া মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। যখন মাইকের ব্যবহার ছিল না তখন মসজিদটির চার তলা সমান উঁচু মিনারে উঠে আজান দিতেন মুয়াজ্জিন। বর্তমানে মাইকে আজান হলেও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ মিনার ও আজানখানা। রাজপথে চলাচলকারী পথিকেরও একনজর দেখে নেওয়ার সুযোগ হয় কালের সাক্ষী এ মসজিদটি। সিরাজউদ্দৌলা রোড হয়ে আসা-যাওয়ার পথে সবার নজর কাড়ে রাস্তার পশ্চিম পাশের দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদ।

প্রায় কয়েকশ বছর আগে নির্মিত ঐতিহাসিক ‘চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ’ অপরিকল্পিত সংস্কার কাজের ফলে স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। জানা যায়, প্রতি পাঁচ বছর পরপর মসজিদটি সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু সূক্ষ্ম কারুকাজের কারিগরের অভাবে সংস্কার কাজও সঠিকভাবে করা যায় না। বৈরি আবহাওয়ায় এসব জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। সাধারণত দিনে পাঁচ ওয়াক্ত কয়েক শত লোক নামাজ পড়েন এই মসজিদে। শুক্রবার জুমআর দিনে মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

 

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব, চট্টগ্রাম ব্যুরো।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী লীগের বেলাগাম পুঁজিলুণ্ঠন
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পটভূমিতে এবারের বিজয় দিবস
ইসলামোফোবিয়া
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যার মর্মমূলে স্বাধীন জাতিসত্তার চেতনা
স্মৃতি রোদ
আরও

আরও পড়ুন

বোয়ালমারীতে পর্ণোগ্রাফির চক্রের ২ সদস্য আটক, প্রায় বারো লাখ টাকা খোয়ালেন প্রবাসীর স্ত্রী

বোয়ালমারীতে পর্ণোগ্রাফির চক্রের ২ সদস্য আটক, প্রায় বারো লাখ টাকা খোয়ালেন প্রবাসীর স্ত্রী

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিখোঁজের একদিন পর বৃদ্ধের মরদেহ মিলল পুকুরে

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিখোঁজের একদিন পর বৃদ্ধের মরদেহ মিলল পুকুরে

চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কে ৫ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কে ৫ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

বুধবার রাতে সচিব নিবাসেও আগুন লেগেছিল

বুধবার রাতে সচিব নিবাসেও আগুন লেগেছিল

শৈলকুপায় নিহতের ঘটনায় অর্ধশতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দিয়েছে দূর্বৃত্তরা

শৈলকুপায় নিহতের ঘটনায় অর্ধশতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দিয়েছে দূর্বৃত্তরা

মধ্যরাতে আগুন লেগেছিল সচিব নিবাসেও

মধ্যরাতে আগুন লেগেছিল সচিব নিবাসেও

গোয়েন্দা সংস্থা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে : রিজভী

গোয়েন্দা সংস্থা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে : রিজভী

ফুলপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন

ফুলপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন

সচিবালয়ের ৮ তলায় মিলল কুকুরের দগ্ধ মরদেহ, চাঞ্চল্যের সৃষ্টি

সচিবালয়ের ৮ তলায় মিলল কুকুরের দগ্ধ মরদেহ, চাঞ্চল্যের সৃষ্টি

সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা পল্লীতে ফ্রিজ থেকে উদ্ধার হলো হরিণের মাংস

সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা পল্লীতে ফ্রিজ থেকে উদ্ধার হলো হরিণের মাংস

ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজা সম্পন্ন

ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজা সম্পন্ন

প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজে রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপন

প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজে রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপন

‘সচিবালয়ে আগুনের পেছনে আওয়ামী দোসরদের ষড়যন্ত্র রয়েছে’

‘সচিবালয়ে আগুনের পেছনে আওয়ামী দোসরদের ষড়যন্ত্র রয়েছে’

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড : প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার দাবি ফখরুলের

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড : প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার দাবি ফখরুলের

আটঘরিয়া-চাঁদভা হাড়লপাড়া সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে দুর্ভোগে পথচারীরা

আটঘরিয়া-চাঁদভা হাড়লপাড়া সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে দুর্ভোগে পথচারীরা

পুড়ে যাওয়া ২ মন্ত্রণালয় দেখে আসিফ মাহমুদ: ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে’

পুড়ে যাওয়া ২ মন্ত্রণালয় দেখে আসিফ মাহমুদ: ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে’

দেশে ফিরলেন মিজানুর রহমান আজহারী, অংশ নেবেন মাহফিলে

দেশে ফিরলেন মিজানুর রহমান আজহারী, অংশ নেবেন মাহফিলে

আরেকটি বিধ্বংসী দ্বিশতক হাঁকালেন রিজভি

আরেকটি বিধ্বংসী দ্বিশতক হাঁকালেন রিজভি

অবৈধ শিসা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর

অবৈধ শিসা তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর

সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন , বন্ধ দাপ্তরিক কাজ

সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন , বন্ধ দাপ্তরিক কাজ