ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কৃষিতে সউদী আরবের বিস্ময়কর সাফল্য

Daily Inqilab মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠে শিল্প। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের মূল উৎস হচ্ছে কৃষি। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি স্তরে কৃষির বিরাট অবদান রয়েছে। একটি দেশের শিল্প তথা সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও উন্নতির মূলে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য।

অনাবৃষ্টি ও মরুভূমির দেশ নামে খ্যাত তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব বিগত তিন দশকে কৃষিতে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে তা রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার। অত্যধিক খরা আর মরুময় আরবের বুকে আজ যে সবুজায়ন এবং কৃষিজ উৎপাদন তা সত্যিই অবাক করার মতো। দেশটিতে বছরে গড়ে মাত্র চার ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয় এবং পানি সরবরাহেরও তেমন ব্যাপক ও সহজলভ্য কোনো উৎস না থাকার পরও মরুভূমির বৃহৎ এলকাগুলোকে কৃষির আওতায় নিয়ে এসে যে ব্যাপক ফসল উৎপাদন করছে তা সত্যিকার অর্থেই বিরাট অর্জন। সৌদি আরবের ৯০ শতাংশ ভূখণ্ড মূলত মরুভূমি ও কৃষিকাজের অনুপযুক্ত বিবেচনা করে খুব কম লোকই আশা করতে পারে যে, সৌদি আরব একটি নতুন কৃষি বিপ্লবের জায়গা হবে এবং আভ্যন্তরীণ শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করবে। সৌদি আরবে চাষাবাদের কথা উঠলেই প্রথমে চলে আসে পানির কথা। মরুময় পাথুরে জমিতে পানি কোথায় পেল দেশটি? বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই অনেকের অজানা। সৌদি আরবের পানির প্রধান উৎস হলো জলাভূমি। এগুলো ভূগর্ভস্থ পানির বিশাল আধার। ১৯৭০-এর দশকে, সরকার এই ধরনের জলাধারগুলি সনাক্ত এবং সেগুলোর সক্ষমতা নির্ধারণে একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সফল বাস্তবায়ন করেছিল। ফলস্বরূপ কয়েক হাজার গভীর নলকূপ খনন করতে সক্ষম হয়েছিল কৃষি খাতে ব্যবহারের জন্য। পানির আরেকটি প্রধান উৎস হলো সমুদ্র। সমুদ্রের পানিকে ডিস্যালিনেশনের মাধ্যমে লোনা পানি থেকে মিষ্টি পানি তৈরি করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনকারী দেশ। স্যালাইন ওয়াটার কনভার্সন কর্পোরেশন (এসডব্লিউসিসি) ২৭টি ডিস্যালিনেশন স্টেশন পরিচালনা করে, যা দিনে তিন মিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি পানি উৎপাদন করে। আরেকটি বিষয় হলো, বর্তমানে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি ধরে রাখতে বাঁধ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০টিরও বেশি বাঁধ তাদের জলাধারে বছরে আনুমানিক ১৬ বিলিযন ঘনফুট পানি সংগ্রহ করে। এই বাঁধগুলির মধ্যে কয়েকটি বৃহত্তম ওয়াদি জিজান, ওয়াদি ফাতিমা, ওয়াদি ভিশা এবং নাজরানে অবস্থিত। এই পানি প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং হাজার হাজার মাইল সেচখাল এবং খালের মাধ্যমে বিস্তৃত উর্বর জমিতে বিতরণ করা হয়, যা আগে পতিত ছিল। পানির আরেকটি উৎস হলো ব্যবহৃত পানির পুনর্ব্যবহার। শহুরে এলাকায় গার্হস্থ্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পানির ৪০ শতাংশের মতো পানি কৃষিতে পুনর্ব্যবহার করে দেশটি।

ক্ষুদ্র কৃষি ব্যবসায় ভারী বিনিয়োগ এবং ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়া সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে অনাবাদী এবং কম আবাদী জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে সৌদি আরব পুরোপুরি সফল বলা যায়। কৃষি উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে দেশটিতে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও সেচ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে এবং সরকারের নেয়া আধুনিক ও কার্যকর পদক্ষেপ, কৃষিবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, ভোক্তাদের সাথে কৃষকদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিসহ কৃষি উন্নয়নে নিত্য নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশটি কৃষিজ উৎপাদনে আজ বহুদূর এগিয়েছে। পূর্বের সীমিত ফসলের সাথে আস্তে আস্তে যুক্ত হয়েছে হরেক রকম ফল ও সবজির চাষ। বর্তমানে সৌদি আরব নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সবজি ও ফল রপ্তানি করে, যা বিগত তিনদশক আগেও কল্পনা করেনি কেউ। কৃষি উন্নয়নে এত দ্রুত সফলতা অর্জনের পিছনে কাজ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব কৃষি ব্যাংক (এসএএবি), রিফ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন এবং কৃষি উন্নয়নের সাথে জড়িত নানান সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। সরকারের দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, সময়োচিত বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি, সুদমুক্ত ঋণ প্রদান, প্রযুক্তিগত সহায়তা, কম খরচে পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল ও কৃষিযন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ এদেশের কৃষিখাতকে এগিয়ে নিয়েছে খুব দ্রুত। সৌদি নাগরিক বা দেশি-বিদেশি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে কৃষি খাতে যারা কাজ করছে তাদের ১০ বছরের জন্য কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এসব কৃষিবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে একসময় যে দেশে শুধু খেজুর এবং সামান্য কিছু ফল-ফলাদির চাষ হতো তার চিত্র এখন সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন এখানে সবচাইতে বেশি উৎপাদিত ফসলের মধ্যে খেজুর ছাড়াও রয়েছে কলা, তরমুজ, সাইট্রাস জাতীয় ফল, পেঁয়াজ, স্কোয়াশ, কাঁচা মরিচ, টমেটো, আনারস, পেঁপে, আম, পেয়ারাসহ আরো বেশ কিছু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল। লোহিত সাগরের ধারে অবস্থিত কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (কেএইউএসটি) এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর জিজানে অবস্থিত আল হিকমা গবেষণা কেন্দ্র নিরলসভাবে নতুন নতুন কৃষিজ ফসল উৎপাদনে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে এবং সফলতা নিয়ে আসছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষি গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান ও রোগ বালাই দমনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দ্রুত ও কার্যকর সেবার মাধ্যমে দেশটি প্রায় সকল প্রকার মৌলিক খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। যার ফলে মাংস, দুধ, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ অনেক খাদ্য সামগ্রীতে সৌদি আরব এখন স্বয়ং সম্পূর্ণ। বর্ধিত খাদ্য উৎপাদনের কারণে দেশটি খাদ্য আমদানি আনুপাতিক হারে কমিয়ে এনেছে। নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে তারা এখন গম, খেজুর, দুগ্ধজাত পণ্য, ডিমসহ বিভিন্ন শাক-সবজি ও ফুল রপ্তানি করে, যা সৌদি আরবের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে অবদান রাখছে। বিশেষ করে, সৌদি আরবের জলবায়ু খেজুর চাষের জন্য অত্যধিক উপযুক্ত বিধায় এখানে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি খেজুর উৎপন্ন হয় এবং তা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার মতে, সৌদি আরব ২০২২ সালে খেজুর রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করে। ২০২২ সালে সৌদি আরব থেকে খেজুর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩২১.১ হাজার মেট্রিক টন, যার আর্থিক মূল্য ৩৪১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে আধুনিক দুগ্ধ খামার রয়েছে সৌদি আরবে। যেখানে গাভী প্রতি দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১৮০০ গ্যালন, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ। আলু উৎপাদনে দেশটি স্থানীয় চাহিদার ৮০ শতাংশ, মুরগিতে ৬৮ শতাংশ, টমেটো ৬৭ শতাংশ, গাজর ৫০ শতাংশ, মাছ ৪৮ শতাংশ এবং পেঁয়াজে ৪৪ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে ।

সৌদি আরবের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৮০’র দশকে। তখন থেকেই একটি যথোপযুক্ত কৃষি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে আজ এই সফলতায় পৌঁছেছে দেশটি। গ্রিন হাউজ এবং হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে তেল সমৃদ্ধ দেশটি নিছক আমদানিকারক এবং ভোক্তা থেকে রপ্তানিকারক হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন এবং বিশেষ বিশেষ কৃষিজপণ্য ইতমধ্যে রপ্তানিও করছে। সৌদি কৃষি মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক কৃষি প্রদর্শনী এবং কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে তাদের আন্তর্জাতিক কৃষিঅঙ্গনের সকল পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সাথে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা-ধারার সাথে পরিচিত হওয়ার দ্বারকে প্রশস্ত করছে এবং কৃষি উন্নয়নে তা অবদান রাখছে বলে সৌদি আরবের প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ‘আরবনিউজ’কে জানান রেড সি ফার্মস কোঅপারেটিভ এর সিইও এবং ভাইস চেয়ারম্যান জামাল আল-সা’দুন। সৌদি আরবের সবচাইতে নাটকীয় কৃষি কৃতিত্ব ছিল গম আমদানিকারক দেশ হতে গম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হওয়া। ১৯৮৪ সালে দেশটি সর্বপ্রথম গম উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করে। এর পরে সৌদি আরব চীন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ প্রায় ৩০টি দেশে গম রপ্তানি শুরু করে। সৌদি আরবের তাবুক, হায়েল এবং আল-কাসিমের বিভিন্ন এলাকায় গমের ব্যাপক ফসল হয়, যা একসময় একর প্রতি গড়ে ৩.৬ টন পর্যন্ত ছিল। সৌদি কৃষকরা গম ব্যতীত বার্লি এবং বাজরাও চাষ করে থাকেন। তা ছাড়াও ধূ-ধূ বালিকারাশিতে সূর্যরশ্মির চিক-চিক করার পরিচিত দৃশ্যের হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার মরুভূমির মাঝেও এখন দেখা যায় মাছ চাষ। পাথর-বালির শক্ত শিলায় গঠিত এমন অনুর্বর মরু জমিতে মাছ চাষ সত্যিই একসময় কল্পনা করা যেত না। কিন্তু সৌদি আরব সেটিও সফল করে দেখিয়েছে তাদের উন্নত প্রযুক্তি আর দৃঢ় ও কার্যকর কৃষি পরিকল্পনার মাধ্যমে। তাই মরুর বুকেও গড়ে উঠেছে মাছের খামার এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে এদেশের মৎস্য খামারগুলোর মাছ চাষ। ২০২৫ সালের মধ্যে মৎস্য উৎপাদন ৫০০% বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে, যা দেশটির অর্থনীতিতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে সমগ্র বিশ্বের সাপ্লাই চেইন এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় দেশে দেশে। তখন সৌদি আরব আরো অধিকতর নজর দেয় কৃষি সম্প্রসারণে। কৃষি খাতের উন্নতি ও খাদ্য আমদানির সুবিদার্থে কৃষি উন্নয়ন তহবিল সৌদি কৃষকদের ২.৫ বিলিয়ন রিয়াল অর্থ সহায়তা প্রদানসহ বেশ কিছু উদ্ভাবনী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়নে কাজ করছে। আধুনিক ডিস্যালিনেশন প্রযুক্তি এবং উন্নত সেচ কৌশল অবলম্বন করে পানির উপর চাপ কমিয়ে কীভাবে কৃষিতে ব্যাপক সফলতা আনতে হয় তার উপর কাজ করে যাচ্ছে সৌদি আরবের কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই খাতে বিনিয়োগের ফলে পানির রিজার্ভকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার, পানির অপ্রয়োজনীয় অপচয় রোধ, লবণাক্ত ও বর্জ্য পানি শোধন করে কৃষিকাজে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। ডিস্যালিনেশন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের অংশ হিসেবে সৌদি আরব তার উপকূলরেখা বরাবর গাছপালা রোপণ করছে, যা সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে মিঠা পানিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে। কৃষিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে ২০২৩ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে মরুভূমির দেশ খ্যাত সৌদি আরব। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম কৃষি খামারের স্বীকৃতি পেয়েছে দেশটির আছির অঞ্চলের ওয়াদি বিন হাশবালে অবস্থিত একটি খামার। যেটির আয়তন ৩২ লাখ বর্গমিটার। খামারটি প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রতি বিভাগে রয়েছে ৫ লাখ লিটার পানি ধারণক্ষমতা সমৃদ্ধ কংক্রিট ট্যাংক। টেকসই কৃষি এবং নবায়নযোগ্য পানি ব্যবহারের ধারণাকে শুধু বাস্তবেই রূপ দেয়নি বরং নিয়ে গেছে উৎকর্ষের শীর্ষে। খামারটিতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা এবং পাঁচটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গ্রিন হাউজ। মডেল এই খামারটিতে সবচাইতে বেশি উৎপাদিত হয় লেবু, কমলা, ডালিম, আঙ্গুর, ডুমুর, বাদাম ও জলপাই। বিশ্বের সেরা এই খামারটিতে বিভিন্ন জাতের ১৪ হাজারের অধিক গাছ রয়েছে।

সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করে দেশটিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা দেশটির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে আসার জন্য এবং তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে এনে কীভাবে ভবিষ্যতে আরো শক্তিশালী অর্থনীতি দাঁড় করানো যায় এবং বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশে সৌদি আরবকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এর প্রায় সকল কর্মপরিকল্পনা রয়েছে এই ‘ভিশন-২০৩০’র মধ্যে। বিশেষ করে কৃষিখাতকে অধিকতর শক্তিশালী ও প্রযুক্তিগতভাবে কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য খুবই শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা রয়েছে এই ভিশনে, যা ইতমধ্যে কৃষিখাতে বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেছে। ভিশন ২০৩০ এর অন্তর্ভুক্ত খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের কারণে খাদ্যের উপর আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং দেশটিকে কৃষিবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। যা বিগত পাঁচ বছেরের কিছু পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই। গত ৫ বছরে সৌদি আরবে জলজ উৎপাদন ১৮৩% বেড়ে ৩০,০০০ টন থেকে ৮৫,০০০ টন হয়েছে। একই সময়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৬০ শতাংশ বেড়েছে। গ্রিন হাউসের উৎপাদন ২৫৭,০০০ টন থেকে ৫৮% বেড়ে ৪০৭,০০০ টন এবং জৈব খাদ্য চাষ ১৮% বৃদ্ধি পেয়ে ৫২,৮০০ টন হয়েছে। ভিশন-২০৩০ অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরবের কৃষি বিনিয়োগ ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যাবে। ২০২২ সালে দেশটির জিডিপিতে কৃষির অবদানের পরিমাণ ছিল ১৯.৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি এবং নতুন নতুন শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি উৎপাদনের ফলে দেশটির ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন এসেছে। বৈচিত্র্য এসেছে স্থানীয় খাবারে, যা কয়েক প্রজন্ম আগে কল্পনাও করা যেত না। সৌদি আরবের অত্যাবশ্যকীয় খাবারের মধ্যে খেজুর ছিল প্রধান। কিন্তু বর্তমানে খেজুর তাদের অত্যাবশ্যকীয় খাবার নয়, যেভাবে অতীতে ছিল। তবে পরিপূরক খাবার হিসেবে এখনও খেজুর অতি প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে সৌদি আরবের খাদ্যাভ্যাসে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে। দেশটিতে প্রায় ৪৫০ প্রকারের খেজুর উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত খেজুরের বড় একটি অংশ মানবিক সহায়তা হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতরণ করা হয় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মাধ্যমে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন বিশ্বে খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জনের সফল প্রচেষ্টায় সৌদি আরবকে বিশ্বের মধ্যে একটি অনুকরণীয় ও সফল উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী শুষ্ক দেশগুলির জন্য উদ্ভাবনী ও টেকসই চাষাবাদের দ্বার উন্মুক্ত করছে সৌদি আরবের বিভিন্ন গবেষণালব্দ চাষাবাদ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার।

দেশটি আগামীতে গ্রিনহাউজ প্রযুক্তি ছাড়াও আরো উন্নত এবং সর্বশেষ কৃষি প্রযুক্তির দিকে যাবার রোডম্যাপ তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ড্রোন এবং এরিয়াল ইমেজিং সিস্টেম, রোবোটিক্স টেকনোলজি, কন্ট্রোলড এনভাইরনমেন্ট এগ্রিকালচার (সিইএ), যা তাপমাত্রা, আদ্রতা, কার্বনডাই অক্সাইড, আলো এবং পুষ্টির ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে ফসলের ফলন সর্বাধিক করে এবং কীটপতঙ্গ ও গাছের রোগ-বালাই কমিয়ে রাখবে। অদূর ভবিষ্যতে সৌদি আরব নিজস্ব খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সৌদি প্রবাসী প্রবন্ধকার

 


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা