ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ইংল্যান্ডের পথে প্রান্তরে

Daily Inqilab হারুন-আর-রশিদ

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সপরিবারে বাংলাদেশ বিমানে লন্ডনে যাত্রা করি। বিমান সিলেটে ৪৫ মিনিট বিরতি নিলো। কারণ লন্ডনের অধিকাংশ বাংলাদেশের মানুষ সিলেটের বাসিন্দা। বিমানের দুই তৃতীয়াংশ যাত্রী ছিল সিলেট বিভাগের। যাহোক, ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত লিখে রাখার জন্য দেশ-বিদেশে কোথাও গেলে সাথে একটি নোট খাতা নিতাম। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ বিমান ঐ দিন যথাসময় লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করলো। তখন লন্ডনের সময় বিকাল পাঁচটা। প্রায় ১০ ঘন্টার যাত্রা শেষ হলেও ইমিগ্রেশনে এসে বিপাকে পড়লাম। হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশনে খুব কড়াকড়ি। আমরাও নিরাপত্তাকর্মীর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। ভিসা পেলেই যে কোনো সমস্যা হবে না, এটা সঠিক নয়। একমাত্র ব্রিটিশ নাগরিক বা ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ছাড়া কমবেশি সবারই নানা প্রশ্নের সস্মুখীন হতে হয়। যেমন, কেন এসেছেন? কোথায় থাকবেন? পেশা কি? ইত্যাদি।এটা ব্রিটিশ সরকারের নিয়ম। তাছাড়া প্রথম ব্রিটেন সফরে আসলে সবারই কমবেশি এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদেরও ব্রিটেনে এটা ছিল প্রথম সফর। ২০২২ সালে জুলাই মাসে কানাডার টরেন্টো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কোন ঝামেলা পোয়াতে হয়নি আমাদের। তারা বয়স্ক মানুষকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখে। পাসপোর্টে কানাডার ভিসা থাকলে বর্ধিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। যাহোক আমরা ব্রিটেন ভ্রমণের ছয় মাসের ভিসা পেয়েছিলাম। এমন সময় আমার মেয়ের জামাই হোয়াটস অ্যাপে আমাদের সংবাদ জানতে চাইল। সে আমাদের নিতে এয়ারপোর্টে এসেছিল। আমরা সরাসরি ফোনটি সিকিউরিটি অফিসারকে দিলাম। সে কথা বলার সাথে সাথেই সিকিউরিটি অফিসার আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিল। আমার মেয়ে ও জামাই ব্রিটেনের নাগরিক। পরে জানলাম, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি করা হয় হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে কাঁদতে দেখেছি, ইমিগ্রেশনে আটকিয়ে দেয়ার জন্য। হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫টি টারমিনাল। এর মধ্যে ৪টি প্যাসেনজার টারমিনাল এবং ১টি কার্গো টারমিনাল। বিমানবন্দর থেকে মূল সড়কে এসে টেক্সিতে উঠে মেয়ের বাসা গ্রেসের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। দূরত্ব ৬১ মাইল। সময় লেগেছে মাত্র এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট। বাংলাদেশে এতটুকু জায়গা যেতে কত সময় লাগত, সেটা ঢাকাবাসীর অজানা থাকার কথা নয়।

লন্ডন শহরের শুরুটা দেখে মনে হলো দেশটির সুদক্ষ পরিকল্পনা এবং কাঠামোগত নির্মাণ কৌশল অত্যন্ত মজবুত এবং লেটেস্ট প্রযুক্তির সর্বস্তরে প্রয়োগে বিচক্ষণতা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। শহরটা দেখতে মনে হবে কোনো বিখ্যাত অঙ্কন শিল্পীর আঁকা ছবির মতো। নেই কোনো কোলোহল ও উচ্চশব্দ বা গাড়ির হর্ন। বিভিন্ন প্রজাতির মনোমুগ্ধকর গাছগাছালি, নানা রংবেরঙের ফুল আর ফলের বাগান রাস্তার হাইওয়ের দুইপাশে শোভা পাচ্ছে। শোনা যাবে, নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির ডাক। সড়কের দুইপাশে বহুতল বিশিষ্ট কোনো ইমারত দেখিনি। এ দেশে দুই থেকে তিন তলার উপর বাড়ি নির্মাণে প্লান দেওয়া হয় না। শহরকে সবুজ ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য ব্রিটেন সরকারের রয়েছে বহুমুখী পরিকল্পনা। প্রথমেই ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনকে বিকেন্দ্রীয়করণ প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে। লন্ডনে জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সেজন্য শতবছর পূর্বে তাদের পরিকল্পনা ছিল। সেন্ট্রাল লন্ডনে জনসংখ্যার চাপ বাড়ানো যাবে না। সেজন্য ব্রিটেন সরকার লন্ডনের চতুর্মুখী ৩০০ থেকে ৪০০ মাইল দূরত্ব পযর্ন্ত ৩৭৫টি ভিলেজ টাউন গড়ে তুলেছে। ইউরোপের ২৬টি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থান এক নম্বরে। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ট্রেন স্টেশন এবং ডবল ডেকার বাস স্টেশন লেটেস্ট টেকনোলজি প্রয়োগ করে নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সবাই জানে লন্ডন একটি সবুজ শহর। সেজন্য লন্ডনের আদলে লন্ডনের চতুর্দিকে সব ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধাসহ প্রায় ৩৭৫টি সবুজায়নে সুসজ্জিত ও মনমুগ্ধকর নান্দনিক ভিলেজ টাউন গড়ে তোলা হয়েছে। রাস্তায় কোনো পুলিশ চোখে পড়েনি। শুনেছি, পুলিশ এদেশের মানুষের প্রকৃত বন্ধু। মানুষ যখন বিপদে পড়ে পুলিশ নিজেই অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসে। কারণ, পুরো ব্রিটেন সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতাধীন। এ কারণে দেশটিতে অপরাধ কম।

ইংল্যান্ডে চিকিৎসা ব্যবস্থা সর্বত্র উন্নতমানের এবং মানসম্মত। ব্রিটেনের নাগরিকদের চিকিৎসা ফ্রি। এদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা দেখার জন্য একদিন মেয়ের সাথে কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিছুদিন ধরে তার পায়ে ব্যাথা ছিল। এ দেশে ডাক্তারের সাথে আগেই যোগাযোগ করে সময় নির্ধারণ করে নিতে হয়। কমিউনিটি হাসপাতাল হিসেবে ভেবেছিলাম হাসপাতালটি বেশি বড় হবে না। কিন্তু ছোট নয়। অবাক হলাম, আমার মেয়েসহ রোগী মাত্র তিনজন। বুঝতে পারলাম, এদেশে রোগ ব্যাধি খুব কম হয়। লন্ডনে যত্রতত্র কোনো ডায়গোনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক এবং হাসপাতাল গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। এদেশে কোনো ভিক্ষুক নেই। তবে সাহেবী ড্রেসে ভদ্রতা বজায় রেখে কিছু ধর্মপ্রচারক দেখেছি সেন্ট্রাল লন্ডনে। সেন্ট্রাল লন্ডনে একজন মুসলিমকে ইংলিশভার্সনে বিনামূল্যে কুরআন বিতরণ করতে দেখেছি। বুঝতে পারলাম, এ দেশে শান্তিপূর্ণ ধর্ম প্রচারে বাধা নেই। এ দেশে গড় আয়ু ৯০-৯৫ বছর। আমি নিজেই দেখেছি, ৮৮ বছর বয়সী একজন মানুষ সেন্ট্রাল লন্ডনে বিশাল একটি শপিং মলে কাজ করছে। দীর্ঘ আয়ুর কারণ হলো, আবহাওয়া, পরিবেশ এবং ঘরে ও বাইরে খাবারদাবার পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত ও হাইজেনিক। ঘুরতে বের হলে আমরা প্রায় সময়ই হালাল রেস্টুরেন্টে খেতাম। কোনো দিনই পেটে সমস্যা হয়নি। মনে হলো, ‘খাদ্যে ভেজাল’ এদেশে অচেনা দুটি শব্দ। এ দেশে ঘরে বসেই সব ধরনের বিল পেমেন্ট করা যায়। আরো অবাক হলাম দেখে, ঘরে প্রবেশ করলে প্রতিটি তলায় ধাপে ধাপে আলো জ্বলে উঠে। ওঠা শেষ হলে আলো আবার নিভে যায়। কিন্তু সুইচ নেই। যে কয়দিন ইংল্যান্ডে ছিলাম একদিনও বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখিনি।

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র ভিলেজ টাউনের ছোট-বড় শপিংমলে পাওয়া যায়। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মরিশনস, টেসকো আলদি, কসটকো এবং আইকিয়া চতুর্মুখী সাইজ দেড় কিলোমিটার। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে বিশাল চত্বর, কোনো আন্ডার গ্রাউন্ড নেই। বড় বড় শপিং মলগুলোর অধিকাংশ এক তলা। এ ছাড়া লন্ডনে প্রায় এলাকাতেই ছোটখাটো লেক আছে। এ কারণে বিশাল আকারে লেক সাইড শপিংমল ভিলেজ টাউনে গড়ে উঠেছে। শপিংমলে ইংরেজিতে লেখা 'World Foods Available here'। এসব দোকানে একটি পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবধরনের পণ্যসামগ্রী ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যায়। পবিত্র রমজান মাসে ব্রিটেনে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এখানে ফুটপাতে কেনাকাটার দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে সাদাদের (ব্রিটিশ) এলাকা বাঙালি এবং এশিয়ানদের এলাকার চেয়ে পরিষ্কার পরিছন্ন বেশি।

এ দেশে থুথু ফেললে জরিমানা দিতে হয়। তাই চলার পথে সবাই টিস্যু পেপার সাথে রাখে। ভাবতে অবাক লাগে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টি হলেও বায়ু মন্ডল ঠান্ডা হয় না। শরীর ঘর্মাক্ত হয়। অথচ, লন্ডনে ২০২৩ জুলাই মাসে গ্রীষ্মকালে একদিন হালকা বৃষ্টিতে শরীরে কাঁপন ধরেছে। দেখলাম, চালক ছাড়াও ট্রেন চলে। সবকিছুই অটোমেটিক। লন্ডনে ইলেকট্রনিক ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ন্যাশনাল লাইন, ডিস্ট্রিক লাইন এবং ইনটারন্যাশনাল লাইন ২৪ ঘণ্টা চালু আছে। সেন্ট্রাল লন্ডনে গাড়ি বিভিন্ন লাইনে চলাচল করে। লন্ডনে উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে ট্রেন স্টেশনে লিফট এবং স্কেলেটারের স্পিড অনেক বেশি। দেখলাম ট্রেনের মতোই যাত্রীবাহী বাসও আন্ডারগ্রাউন্ড এবং ওভার গ্রাউন্ডে চলাচল করে। লন্ডনে আন্ডার গ্রাউন্ডকে প্রায় সময় দি টিউব বলে। এ দেশে অবাক হওয়ার মতো একটি বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে, ট্রেনের টিকেট যে স্টেশন থেকে কাটা হয়। তার মেয়াদ থাকে ২৪ ঘণ্টা। আবার ঐ একই টিকিটে বাসে চড়ে লন্ডন সিটিতে ঘোরাফেরা করা যায়। অন্য লাইনের ট্রেনে উঠে যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন সেখানেও যাওয়া যায়। শিশুদের ট্রেনে টিকেট লাগে না। আমরা প্রতিজন ২০ পাউন্ড টিকিট কেটে, লন্ডনের আরো দুটি ট্রেনে যাতায়ত করেছি। আরামদায়ক বাসেও উঠেছি।
যাতায়ত ব্যবস্থার এতো সুযোগ-সুবিধা খুব কম দেশেই আছে বলে মনে হয়। যাত্রীবাহী একতলা ও বড় দ্বিতল বাসগুলোতে কর্মচারী হিসেবে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। গাড়ি চালকই সব দায়িত্ব পালন করেন। টিকেটের মূল্য ওয়েসটার কার্ড থেকে কেটে নেয়া হয়। ওয়াইফাই ও ইনটারনেট, মোবাইল চার্জার, দুর্ঘটনায় ইমারজেন্সি দরজা ব্যবহার এবং যানবাহনে এলাকার মানচিত্র সব কিছুই ছাপানো অক্ষরে লেখা থাকে। যাত্রী বাসে ওঠা এবং নেমে যাওয়ার দরজা আলাদা থাকে। যদি শুধু একটি দরজা থাকে তা আকারে বড়। ব্রিটিশ নিয়মে যাত্রীরা আগে নামবে, তারপর অন্য যাত্রীরা উঠবে। গাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং সিসিটিভি ক্যামরা চালু থাকে। ট্রেনগুলোতেও এসব টেকনোলজি আছে। আমাদের দেশে ইনটারনেটে কথা বলতে হলে মোবাইলে টাকা ভরতে হয়। আর মোবাইলে ইংল্যান্ডের সিম কার্ড থাকলে ঘরের বাইরেও ইনটারনেট সংযোগ পাওয়া যায়। এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা উন্নত দেশ ছাড়া আর কোথায়ও আছে কিনা আমার জানা নেই।

আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আন্তর্জাতিকমানের একটি বড় শপিং মলের নাম মরিশন। কয়েকবার গিয়ে দেখলাম, পণ্যসামগ্রীর দাম যা ছিল, তাই আছে। এ দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আমাদের দেশের মতো যখন-তখন বাড়ে না। ব্রিটেনে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। খাদ্যপণ্য নষ্ট হলে বা পচন ধরলে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা ফেলে দেওয়া হয়।

কানাডা এবং ব্রিটেনে দুই-তিন তলার উপরে বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। ইংল্যান্ডে প্রতিটি শহরে প্রতিদিন রাস্তা, বাসাবাড়ি এবং পার্ক পরিষ্কার করা হয়। প্রতিটি কমিউনিটিতে রয়েছে একাধিক পার্ক, যা সবুজে ঘেরা নানা রংবেরঙের ফুল দ্বারা সুসজ্জিত। একটি পার্কে ৬/৭ রংয়ের গোলাপ ফুল দেখেছি। এরকম তরতাজা ফুটন্ত ফুল দেখলে কারো মন আর খারাপ থাকতে পারে না। এ দেশের মানুষ ফল আর ফুলের সাহচর্যে থাকতে পছন্দ করে। দেশটাকে তারা সেভাবেই গড়ে তুলেছে। কেউ ফল আর ফুল ছিড়ছে না। তারা জানে, ছিড়ে ফেললে তো আর আনন্দ উপভোগ করা যাবে না। পার্কগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শিশুদের বিনোদনের জন্য সবধরনের খেলাধুলার সুব্যবস্থা আছে। মনোরম সাজে সজ্জিত শিশু পার্কগুলোতে শিশুদের প্রশিক্ষণের জন্য আছে উচ্চতর প্রশিক্ষক। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিনোদনের জন্য আছে খেলার মাঠ ও ব্যায়ামগার। শিশু বয়স থেকে জাতি গঠনের এতো সিস্টেমেটিক ব্যবস্থা উন্নত বিশ্ব ছাড়া আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। লন্ডনে কতগুলো ট্যানেল আছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। লন্ডনের বাইরে একদিন কেন্ট সিটিতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। গ্রামীণ নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। একাধিক সুসজ্জিত পার্ক পুরোটাই সবুজে ঘেরা। দেখলাম সুসজ্জিত বিশাল ব্লু ওয়াটার শপিং মল। পাশে শিশুদের খেলাঘর। শিশু-কিশোরদের খেলাঘরে রেখে বাবা-মা শপিং করছে। একদিকে শিশুদের বিনোদন, অন্যদিকে বাবা-মার শপিং করার ব্যবস্থা, এমন সুন্দর পরিবেশ এ দেশের শপিং মলে থাকে। উপভোগ করার মতই এলাকাটি। সেখানে একটি ট্যানেল দেখলাম, যার দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। আমরা উবারে ট্যানেলের নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম, উপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ব্রিটেন সরকার গোটা দেশে এরকম শত শত ট্যানেল নির্মাণ করেছে জনগণের যাতায়াতের সুবিধার্থে। ইংল্যান্ডের যানবাহনের গতিসীমা ৮০ থেকে ১০০ মাইল। এলাকাবিত্তিক গাড়ির গতি ওঠা-নামা করে। আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনের স্পিড সবচেয়ে বেশি। ১০০ মাইলের উপর। আমি পরিবার নিয়ে যখন সেন্ট্রাল লন্ডনে ঘুরতে যেতাম তখন ওভার গ্রাউন্ড এবং আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন দুটিই ব্যবহার করতে হতো। একদিন সকাল ১১টায় দূরপাল্লার ট্রেনে করে লন্ডন সিটির বাইরের শহর ব্রাইটনে গিয়েছিলাম। একটি পর্যটন শহর। ব্রাইটন যাওয়ার সময় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গেটউইক রেল স্টেশন, গেটউইক এয়ারপোর্ট এবং গেটউইক সমুদ্রবন্দর দেখেছিলাম। বিভিন্ন দেশের লোকজনের চলাচল বেশি, তাই এলাকাটি অত্যন্ত ব্যস্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। ব্রাইটন শহরে গিয়ে তিন দিনের জন্য সমুদ্রতীরবর্তী একটি ছোট কটেজ ভাড়া করলাম। ট্যুরিস্ট স্পটগুলো উঁচু-নিচু পথে পাহাড়িয়া অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্য দ্বিতল বাসগুলো উপযুক্ত বাহন। ব্রাইটন শহরে যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে নেমে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখলাম। মনোমুগ্ধকর সাউথ ডাউন সেভেন সিস্টার পার্ক। অপূর্ব সাজে সজ্জিত পার্কটি। যেন পার্কটি ট্যুরিস্টদের আপ্যায়নে অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ব্রাইটন শহরে পিয়ারসন এবং প্যাবিলিয়ন খুব সুন্দর জায়গা এবং ৪০০ থেকে ৫০০ ফুট উঁচু সাতটি পাহাড়ের সাথে মিশে গেছে বিশাল সমুদ্র। সমুদ্রের অপর পারে ফ্রান্স। এই সমুদ্রই ইংলিশ চ্যানেল, যা আটলানটিক মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। এ দুটো বিখ্যাত এলাকা দেখার জন্য অতিউৎসাহী ট্যুরিস্টদের ভিড় দেখলাম। ৮০/৯০ বছরের কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষও আমাদের চলার পথে সাথী হয়েছে। ব্রাইটন শহরের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার মতো কিছু এলাকা আছে। তার মধ্যে ব্রাইটন’স বেস্ট সানসেটস। কিন্তু সমস্যা হলো মূল সড়ক থেকে প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার অসমতল রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি এবং আমার জামাতা হাঁটা শুরু করলাম। আল্লাহ্ আমার আশা পূরণ করেছে। সেজন্য আল্লাহ্ দরবারে হাজারও শোকরিয়া আদায় করেছি। আসলে এটা উপভোগ করার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য। সুশীতল বিশুদ্ধ নির্মল বায়ু বুকভরে নিলাম কয়েকবার। এমন বিশুদ্ধ বাতাস পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। মনকে শিথিলকরণের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান কোলাহলমুক্ত সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা। অনেকক্ষণ বসে বিশ্রাম নিলাম। এতো মনোমুগ্ধকর শান্ত পরিবেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু যেতে হবে। তারপর হাঁটা শুরু করলাম।

 

ব্রাইটনের পাহাড়িয়া পথ বিধায় সেখানে গাড়ির স্পিড সড়কে খোদাই করে লেখা দেখলাম। পরে জানলাম, একই নিয়ম ইংল্যান্ডের সর্বত্র। এর ব্যতিক্রম করলে গাড়ির চালকের বড় অংকের আর্থিক জরিমানা দিতে হয়। ব্রাইটন শহরের সমুদ্রের পার টেমস নদীর চেয়েও মজবুত প্রাচীর দিয়ে শহরকে রক্ষা করার সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রিটেনের সর্বশ্রেণির মানুষের আয়ের কথা বিবেচনা করে যাতায়াতের জন্যই ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক সরকার গণপরিবহনকে সহজলভ্য করে দিয়েছে। ইংল্যান্ডে ৪০টি এয়ারপোর্ট আছে এবং লন্ডন শহরে ৬টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আছে, যাতে বিশ্বের সকল দেশ এবং ব্রিটেনের ৪টি প্রদেশে ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং এর কাছাকাছি দেশগুলো বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এই বিমানবন্দরগুলো ব্যবহারে বিশেষ সুবিধা পায়। ব্রিটেন সরকার ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে যাতায়াত ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নয়নসাধন করেছে, যা দেখার মতো। ব্রিটেনের পর্যটনখাতে যত আয় হয় তার বেশিরভাগ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের শেখশাসিত রাষ্ট্র থেকেই আসে। পরিসংখান থেকে জানতে পারলাম, ইংল্যান্ডের পর্যটন খাতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তা বাংলাদশের এক বছরে আর্থিক বাজেটর চেয়েও বেশি। আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাও তাই বলে। এ দেশের মানুষ ব্রিটেনকে লাইয়ন্স কান্ট্রি বলে গর্ববোধ করে। কারণ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং নর্দারন অ্যায়ারল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়। রাজ্য দুইটি শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভ্রমণকালীন সময় আমার জামাতার কাছ থেকে বহু তথ্য পেয়েছি, যা নিবন্ধটি লিখতে প্রচুর সাহায্য করেছে। ভ্রমণকালীন সময় দেখেছি ছুটির দিনে লন্ডনে ঐসব দেশগুলোর মানুষের উপচে পড়া ঢেউ।

লন্ডনের যে কোনো ধরনের যানবাহনে মানুষ যাতায়াত করুক না কেন, সড়কের দুই পাশে দেখতে পাবে শুধু সাজানো গুছানো সবুজ গাছগাছালি, ফল আর ফুলের বাগান। সবুজায়নের এমন মনোমুগ্ধকর ক্লান্তিহীন দৃশ্য বাংলাদেশে কল্পনাও করা যায় না। আমরা গাছ কাটি আর বন উজাড় করি। তারপর নির্মাণ করি বহুতল বিশিষ্ট অট্টালিকা। তারপর বড় বিলবোর্ড টানিয়ে লিখে দেই ‘ফর সেল’।

একদিন আমরা ট্রেনে করে ঝড়ঁহঃযবহফ পবহঃৎধষ এলাকায় ঝড়ঁঃযবহফ ড়হ ংবধ দেখতে গেলাম। এটা সমুদ্রবেষ্টিত ট্যুরিস্ট এলাকা, মনোরম সাজে সজ্জিত ছোট শহর। এই শহরটি লন্ডন শহরের বাইরে অবস্থিত। এটা নিয়ে আমরা চারটি সমুদ্রবেষ্টিত শহরে গেলাম। এখানে ট্রেনে করে সমুদ্রে প্রায় দেড় কিলোমিটার যাওয়া যায়। এলাকাটি ঝড়ঁঃযবহফ চরবৎ ধহফ জধরষধিু নামে বিখ্যাত। ট্রেনে করে সমুদ্র ভ্রমণ ইংল্যান্ডে আর কোথায়ও নেই। শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক নানা ধরনের ম্যাজিক শো, খেলাধুলা এবং বিভিন্ন দেশের মুখরোচক খাবারদাবারের দোকানপাট সমুদ্রেই নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় চার-পাঁচ শত বছরের অনেক ঐতিহাসিক পুরানো ঐতিহ্য এখানে দেখেছি। যদিও দেখলে মনে হয়, এখানকার ইমারতগুলোর নির্মাণ বেশি দিনের নয়। সংস্কারের কারণে দেখতে নতুন মনে হচ্ছে।

সময় পেলেই মেয়ের বাসার পাশেই টেমস নদী দেখতে যেতাম। নদীর তীরবর্তী আবাসিক এলাকার ফ্লাটগুলোর ডিজাইন সবগুলো একইরকম। চারতলা বিশিষ্ট বাড়িগুলোর চতুর্দিকে সরকার অনুমোদিত নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রেখে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব না হয়। ফ্লাটগুলো সামনে এবং পিছনে পুরোপুরি খোলা। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত প্রতিটি ফ্লাট বাড়ি থেকে দেখা যায়। লন্ডনের আবাসিক এলাকায় গাড়ি রাখার জন্য রয়েছে আলাদা বিশাল চত্বর। আবাসিক ভবনের প্রতিটি বাসাবাড়ির মালিকদের গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় নম্বর দেয়া থাকে, সেখানেই রাখা হয়। এতে নদীর এবং আবাসিক এলাকার সৌন্দর্য এতটাই মনোমুগ্ধকর ও আরামদায়ক অনুভূতি দেয়, যা না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে না। এ দেশের মানুষ টেমস নদীকে লন্ডনের প্রাণ বলে মনে করে। কথাটা যথার্থই। আমি নিজেই পাঁচ কিলোমিটার পযর্ন্ত পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেছি। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। টেমস নদীর দুই পাড়ে বর্জ বা আবর্জনা নির্গত হয় এমন ধরনের কোনো কলকারখানা নির্মাণ করা হয়নি। নদীটির দৈর্ঘ ৩৪৬ কিলোমিটার। দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে নদীটির অবস্থান। অববাহিকা ১২,৯৩৫ বর্গকিলোমিটার। মিষ্টিপানি ও সমুদ্রের লবণযুক্ত পানি দুই-ই আছে। নদীর বাঁধ নিমার্ণ করেছে মিস্টার কস্টেইন। বাঁধের ধরন ইস্পাতবাঁধ। উচ্চতা ২০.১ মিটার। দৈর্ঘ ৫২০ মিটার। টেমস নদীর উপরে লন্ডন শহর এবং মধ্য লন্ডনের সাউথওর্য়াক এলাকাকে সংযোগকারী কয়েকটি ঐতিহাসিক ব্রিজ বা সেতুকে বোঝায়। বর্তমান সংযোগ সেতুটি পারাপারের জন্য ১৯৭৩ সালে খুলে দেওয়া হয়, যা মূলত কংক্রিট এবং লোহায় তৈরি একটি বক্স গার্ডার সেতু। সড়কে কোথায়ও হাট-বাজার বসিয়ে বেচাকেনার দৃশ্য কোথাও দেখিনি। ইংল্যান্ড কীভাবে নদী ভাঙন রোধ করেছে, লন্ডনের টেমস নদীই তার বড় প্রমাণ। দেখেছি পুরো লন্ডন শহরকে রক্ষা করার জন্য তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বহুমুখী নির্মাণ কৌশল। নদীর দুই পাড় ইস্পাত ও পাথরের তৈরি ঢালাই করা প্রাচীর যার উচ্চতা প্রায় ১০ থেকে ১২ ফুট এবং প্রস্থ ১ থেকে দেড় ফুট। নির্মাণ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তিন স্তরের ঢালাই করা ইস্পাত ও পাথরের দ্বারা নির্মিত প্রাচীর নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। লন্ডনে কয়েক বছর আগে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল। কিন্তু প্রাচীর ভাঙতে পারেনি। মূলত টেমস নদীর চতুর্দিকে লন্ডন সিটি গড়ে উঠেছে। একশ’ তলার চেয়েও বেশি ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ ব্যাংক এবং বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির অফিস এই টেমস নদীর তীরঘেঁষা এলাকায় অবস্থিত। টেমস নদীর উপরে ১৩টি আকর্ষণীয় ব্রিজ আছে। প্রতিটি ব্রিজেরই ঐতিহাসিক পরিচয় আছে।

বিশ্বের বিখ্যাত ডিজাইনারের তুলিতে আঁকা ব্রিজের ডিজাইনগুলো দেখতে এত সুন্দর, যা ভাষায় বর্নণা করা সম্ভব নয়। এসব স্থাপনা বহু বছর আগে নির্মিত হয়েছে। বুঝতে পারলাম ব্রিজ নির্মাণ প্রকৌশলী ও পর্যবেক্ষণ এবং তদারককারীরা বহু অভিজ্ঞ এবং কর্মে তারা নিষ্ঠাবান। একদিন আমরা টেমস নদীর নন্দিত ব্রিজগুলো দেখার জন্য প্রথমে ‘লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ’ নামে বিখ্যাত স্থানটি দেখতে গেলাম। টেমস নদীর দুই পারের দৃশ্য, যা বাংলাদেশের কোনো নদীর সাথে মেলানো যাবে না। টেমস নদীর দুই তীরে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট সবুজ পার্ক। হাঁটা পথ এবং সাইকেল চালানোর সুপ্রশস্থ রাস্তা আছে। বৈকালিক দৃশ্য দখলে মনে হয় প্রকৃতি যেন উপচে পড়া সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে নদীর দুইতীরে। টিকেট করে আমরা জাহাজে উঠলাম। অনেক বিদেশি টুরিস্টও টিকেট করে উঠলো। প্রায় দেড় ঘণ্টার ভ্রমণ। টেমস নদীর দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লন্ডন সিটির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিদিন পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। নদীর উপর বেশ কয়েকটি ব্রিজ আছে। এসব ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন এবং যাত্রীবাহী দ্বিতল বাস চলাচল করে। এছাড়া পথচারী মানুষের চলাচলের জন্য রয়েছে একাধিক ব্রিজ। বড় বড় আধুনিক জাহাজ এবং নানা ধরনের পাল তোলা নৌকা, স্পিড বোট, ট্রলার ব্রিজের নিচ দিয়ে চলাচল করে। টেমস নদীতে ১১৬ প্রজাতির মাছ আছে। রাতের লন্ডনকে অপূর্ব সুন্দর বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। নানা রংয়ের বৈদ্যুতিক লাইট দিয়ে টেমস নদীর দুই পাশের ১৩টি ব্রিজসহ বহুতল বিশিষ্ট হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং আন্তর্জাতিক অফিসগুলোর প্রধান দপ্তর আছে। এ ছাড়া পরন্ত বিকালে দর্শনীয় স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জিত হয়ে যায়। টেমস নদীতে জাহাজ ভ্রমণ, নদীতে আছে উবার বোট। চলে খুব দ্রুত গতিতে। আছে ক্যাবল কার। এখানে এসব উপভোগ করতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন।

ওয়েস্টমিনিস্টার স্টেশন থেকে নেমে আমরা একদিন দেখতে গেলাম, বিগবেন, পার্লামেন্ট ভবন, লন্ডন আই, লন্ডন টাওয়ার এবং স্কাই গার্ডেন। ‘লন্ডন আই’ থেকে পুরো লন্ডন শহরের সৌন্দর্য্য পুরোটা উপভোগ করা যায়। সময় লাগে ৪৫ মিনিট। পাশেই রয়েছে বিগ বেন। এখান থেকেই পুরো যুক্তরাজ্যের টাইম নির্ধারণ করা হয়। এর পাশেই আছে পার্লামেন্ট ভবন। একসাথে কয়েকটি আকর্ষণীয় জিনিস দেখে ঐ দিনই দেখতে গেলাম গ্রিনিচ মান সময়। গোটা বিশ্বের টাইম এখান থেকে নির্ধারণ করা হয়। সমতল ভূমি থেকে এই প্রসিদ্ধ স্থানটি সাড়ে ৪শ’ ফুট উঁচু। পরিবারের সবাই উঠতে পারেনি। আমি এবং আমার জামাতা সাহস করে উঠলাম। জিএমটি নির্মাণে যাদের অবদান সৌরজগত ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে সেইসব খ্যাতনামা ব্যক্তিদের ছবি এবং তারিখসহ নাম খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা আছে। সাড়ে ৪শ’ ফুট উঁচু স্থান থেকে লন্ডন শহরের আরো প্রসারিত উপভোগ্য দশর্নীয় স্থানগুলো দেখা যায়। গ্রিনিচ মিন টাইম এর পাশে আছে বিশাল গ্রিনিচ পার্ক, গ্রিন উইচ পিয়ার, গ্রিনউইচ মিউজিয়াম এবং গ্রিনউইচ স্ট্রিট মার্কেট। এই মার্কেটটি দেখতে অনেকটা ইউরোপের ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন শহরের মতো। শুনেছি, এ ধরনের ছোট ছোট স্ট্রিট মার্কেট অনেক দেশেই আছে। এখানে মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রচুর ভিড়। খাবারদাবার থেকে প্রায় সবধরনের জিনিসপত্র একটু কম দামে পাওয়া যায়। দাম কম হলেও পণ্যসামগ্রী মানসম্পন্ন। ইংল্যান্ডে খাবারে ভেজাল পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তি এবং আর্থিক জরিমানা দিতে হয়। তাই কেউ ভেজাল দেয়ার চিন্তাও করতে পারে না।

একদিন সময় করে শেকস্পিয়রের বাড়ি দেখার জন্য বের হলাম। ব্রিটেনের জাতীয় কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের বাড়ি স্ট্যাটফোর্ড অন-অ্যাডনে। এটাই তার জন্মস্থান এবং এখানেইই তাকে সমাধিস্ত করা হয়েছে। দেখেছি শেকস্পিয়ার গ্লোব মিউজিয়াম এবং থিয়েটার। তাকে ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি বা বার্ড অব অ্যাডন চারন কবি নামেও অভিহিত করা হয়।

লন্ডন হাইড পার্কের নামেই একটি ট্রেন স্টেশন আছে। স্টেশনের কাছেই হাইড পার্ক। হাইড পার্ক লন্ডনের একটি রাজকীয় পার্ক। হাইড পার্কের আয়তন সাড়ে তিনশত একর। এই পার্কটির বয়স পৌনে পাঁচশত বছর। কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে সৃজনশীল মুক্তমনা মানুষরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনে হাইড পার্কটিকে বেছে নেন। ঐতিহাসিকভাবে পার্কটির মর্যাদা লিখে শেষ করা যাবে না। এখানে প্রিন্সেস ডায়নার স্মৃতি উপলক্ষে একটি বিশাল ঝর্ণা নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই আছে কেনসিংটন প্যালেস এবং কেনসিংটন গার্ডেন। তার পাশেই আছে একটি ঐতিহাসিক হ্রদ। আছে অগণিত পানির ফোয়ারা। চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শতবর্ষী গাছ। নানা প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। লেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, কাঠবিড়ালির দৌড় ঝাপ আর বাচ্চা হরিণের আনাগোনা। জানলাম, শুধু লন্ডন শহরে ৩ হাজারের উপরে পার্ক আছে। এসব পার্ক না দেখলে বোঝা যাবে না এর সৌন্দর্যের রহস্য কোথায় লুকিয়ে আছে। আমরা একদিন লন্ডনের সবচেয়ে বিখ্যাত যাদুঘর ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম। এখানে কয়েকটি মহাদেশের ঐতিহ্যগত এবং কয়েকশত বছর আগের মুদ্রা, চলচ্চিত্র, বিখ্যাত আবিষ্কারক, যুদ্ধাস্ত্র শতশত বছর আগের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠিপত্র লেখার পদ্ধতি, সেসময়ের মানুষরা দেখতে কেমন, তাদের ব্যবহার, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আচরণগত তথ্যাদি এবং রাজা-রাণির শাসনপদ্ধতিসহ প্রাগ-ঐতিহাসিক অনেক কিছু দেখার বিষয় আছে।

একবার বের হলাম লন্ডনের প্রসিদ্ধ কয়েকটি স্থান দেখার জন্য। বিশেষ করে বাংলাদেশ হাই কমিশন অফিস এবং বাঙালি ও এশিয়ান বসতির উল্লেখযোগ্য এলাকা। সাউথ কেনসিংটন স্টেসন থেকে হাঁটাপথ, ১৫ মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেলাম বাংলাদেশ হাই কমিশনের অফিস ২৮ কুইন্স গেইট, সাউথ কেনিসিংটন, লন্ডন। পৃথিবীর আরো কয়েকটি বড় বড় হাইকমিশনের অফিসও একই এলাকায় অবস্থিত। এর পর বাঙালিদের বিখ্যাত এলাকা হোয়াইটস চ্যাপল, ব্রিক লেইন এবং আপটন পার্ক। বাঙালি পাড়া হলেও বাংলাদেশি সিলেটি এলাকা হিসেবে বেশি পরিচিত। আরো কয়েকটি এশিয়ান এলাকা আছে। সেখানেও সিলেটি লোক আছে। লন্ডনে সিলেটের একটি শক্তিশালী কমিউনিটি আছে। হোয়াইট চ্যাপেলে ইস্ট লন্ডন মস্ক নামে একটি মসজিদ আছে। শুনেছি, ইউরোপেও এত বড় আর কোনো মসজিদ নেই। এই মসজিদে নামাজ পড়েছি। এর পাশে ইসলামি শিক্ষার একটি বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে একটি বিখ্যাত ‘দি রয়েল হাসপাতাল’ আছে।

আমরা লন্ডনের বাইরে কেমব্রিজ শহরটি দেখার জন্য একদিন রওনা হলাম। কেমব্রিজ স্টেশনের পাশেই রয়েছে ইংল্যান্ডের সুন্দর মসজিদগুলোর অন্যতম মসজিদ কেমব্রিজ সেন্ট্রাল মসজিদ। এখানে যোহর ও আছরের নামাজ পড়েছি। তুরস্ক সরকারের অনুদানে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরে অবস্থিত, এটি ইংরেজিভাষী বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে) এবং বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি হিসেবে পরিগণিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে, সরকার পরিচালিত। বিশ্ববিদ্যালটির আচার্য রাজপুত্র ফিলিপ এডিনবার ডিউক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ৩,৬৬,৪৪৪ বর্গমিটার। পোশাকের রং কেমব্রিজ নীল। কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দুইটাকে একত্রে অনেক সময় ‘অক্সব্রিজ’ নামে ডাকা হয়। একে অপরের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ববিদ্যালয় দুইটি বহু শতাব্দী যাবৎ ইংরেজ সমাজেরই সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে।

ইংল্যান্ডে কয়েক মাস অবস্থানকালে যে শহরগুলোতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তা হলো: ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন সিটি, লন্ডন সিটির বাইরে শহর ব্রাইটন, ম্যানচেস্টার, নিউহ্যাবেন, পিচহ্যাবেন, কেমব্রিজ, উইলিংডন, সিফোড সিটি, কেন্ট সিটি, ইস্টব্রাউনিং, হাসটিংস, সোবুরিনেস, গেটইউক, সাউথইনড সেন্ট্রাল প্রভৃতি।

আমি একজন প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ বলেই ইংল্যান্ডের সর্বত্র সবুজায়নের দৃশ্যাবলি এবং টেমস নদীর নয়নাবিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ইংল্যান্ডের চতুরমুখী সমুদ্রের বিশুদ্ধ-নির্মল বায়ু আমাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। ইংল্যান্ডে চারটি সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা ভ্রমণ করে অনেকটাই অবাক হলাম এক প্রজাতির সুদর্শন পাখির আনাগোনা দেখে। আসলে সমুদ্র এলাকায় ভ্রমণের আনন্দটাই আলাদা। আমি লক্ষ করেছি, উন্নত বিশ্বের মানুষরাও এসব দৃশ্য মনোমুগ্ধকরভাবে উপভোগ করে। পর্যটক বিশেষজ্ঞরাই বলে থাকেন, লন্ডনের প্রাণ টেমস নদীর হৃদয় জুরানো প্রশান্তি, যা একাকিত্বকে ভুলিয়ে দেয় এবং ইংল্যান্ডের সর্বত্র প্রকৃতির সবুজায়নের অফুরন্ত নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ইংল্যান্ডে বিদেশি পযর্টকদের ভিড় প্রতিবছরই বাড়ছে।

লেখক: গ্রন্থকার ও গবেষক।
[email protected]


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা