ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ঔপনিবেশিক পণ্ডিতদের ইসলামবিদ্বেষ

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের (১৭৬৯-১৮২১) মিসর আক্রমণ ইসলামের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ যুগের সুচনা ঘটায়। এর আগে মুসলমানরা খ্রিস্টানদের কাছে বহু যুদ্ধে হেরেছে। কিছু দিন পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ১৭৯৮ সালে উত্তর কায়রোর আমবাবাহ যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়নের সেনাদের কাছে মিসরীয় মুসলিমদের পরাজয় কেবল সামরিক পরাজয় ছিলো না, এটা ছিলো ইসলামের একটি যুগের পরিসমাপ্তি এবং ব্যাপকতর পরাজয়।

এরপরই মুসলিমরা নিজেদের পরাজিত ও শাসিত জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করলো। পশ্চিমারা নিজেদের বিজয়ী ও শাসক শক্তি হিসেবে দাঁড় করালো। মুসলিম জীবনের তখন ঘোর দুঃসময়। মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ শক্তি লুপ্তির দিকে ধাবমান। মুসলিম সভ্যতা হারিয়ে ফেলেছে গতি ও উদ্যম, প্রাণের সাড়া ও তরঙ্গ। বৃহত্তর সমাজ হয়ে উঠেছে জীবনের পড়োভূমি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, রাজনীতি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, জাতিগত আত্মপরিচয়, ঐক্যবোধসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এসেছে অবক্ষয়, গতিহীনতা। মানসিক পরাজয় সঙ্কীর্ণ করে দিচ্ছিলো মুসলিম সভ্যতার বোধের জমি। ধর্ম হয়ে উঠছিলো আচরিত প্রথা ও পদ্ধতির নাম। পশ্চিমা জীবনের যেসব প্রবণতা দু’দিন আগেও মুসলিমদের চোখে ছিলো হেয়তর, বানের পানির মতো তা ঢুকতে শুরু করলো মুসলিম জীবনে। এই যখন পরিস্থিতি, নবজাগরণের তরঙ্গে উদ্দাম ফরাসিদের কাছে মিসর বিজয় হয়ে উঠলো সহজ ব্যাপার। দেশ দখলের পর দেশ শাসনের প্রশ্ন এলো। এখানকার মানুষ মুসলিম। তারা পরাধীন হয়েছে। তাদের জীবনাদর্শ ইসলাম। সে কি কোনো শক্তি? কোনো প্রতিরোধ? কোনো হুমকি? সে কি মৃত কোনো অতীত? প্রাণহীন স্মৃতিচিহ্ন? কিংবা কোনো অসুখি ব্যবস্থা, যার মৃত্যু খুবই বাস্তব? নেপোলিয়ন এ প্রশ্নের জবাব খুঁজলেন কনস্টান্টাইন ফ্রান্সিসকো কোঁতে ডি ভোলনির (১৭৫৭-১৮২০) কাছে।
ভোলনির রচনায় নেপোলিয়ান দেখলেন এক গোয়েন্দা রিপোর্ট। মুসলিম সংস্কৃতির অন্তরতলে ঢুকে পড়া এক দৃষ্টিবান প্রতিবেদকের বয়ান। ভোলনি থেকে নেপোলিয়ন লাভ করেন ক্রমানুসারে সাজানো সমস্যা এবং ফরাসি দখলাভিযানে সেনাবাহিনীকে যে সব বাধার মোকাবেলা করতে হবে, তার তালিকা। বলাবাহুল্য, সেইসব বাধার প্রথমটিই হচ্ছে ইসলাম। নেপোলিয়ন ইসলামকে জানতেন গভীর অর্থে। কৈশোর থেকে তিনি পাঠ করছিলেন ইসলামকে। তরুণ বয়সে লিখেছিলেন ম্যারিনির ইস্তওয়ার দ্যা এরাবস-এর একটি সারসংক্ষেপ। তার আস্থা ছিলো ভোলনির ইসলাম বিশ্লেষণে। ফরাসী এই প্রাচ্যবিদ ১৭৭২ সালে ভ্রমণ করেন মিসর ও সিরিয়া। ভ্রমণ কাহিনী লিখেন ফরাসি ভাষায় ‘ভয়েজ আঁ মিসর আঁ সিরিয়া’, যার ইংরেজি অনুবাদ দুই খণ্ডে, Travels in Syria and Egypt নামে বিশ্বময় পঠিত। এ রচনা ছিলো সফরনামার চেয়ে অধিক কিছু। এ ছিলো এক গাইড বুক, প্রাচ্যবিজেতার জন্য। যে প্রাচ্যে অনাগ্রহী, এ ছিলো তার জন্য আগ্রহের নতুন এক হাতছানি। ভোলনি জানতেন, তার রচনা পশ্চিমা যুবকদের করবে প্রাচ্য দখলে আগ্রহী। অভিযাত্রী আর রাজাদের উদ্বুদ্ধ করবে অভিযান পরিচালনায়।

তার বই চলে গেলো পশ্চিমা শাসকদের হাতে। রাশিয়ার জার কাতরিনের হাতে। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের হাতে। কাজ হলো দ্রুত। বিচক্ষণ ও সতর্ক ভোলনি ইসলামকে জানতেন একটি জীবন্ত শক্তি হিসেবে। ওসমানী সালতানাতের মোকাবেলা তার বিবেচনায় ছিলো সাধারণ বিষয়। কিন্তু ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছিলো সবচেয়ে কঠিন ও গভীর। একজন পশ্চিমা দখলদার মুসলিম জগতের মুখোমুখি কীভবে হবেন, ভোলনির রচনায় এর প্রতিটি ধাপ পরিষ্কার। তার সফরবিবরণকে ভাবা হতো পাখির চোখে দেখা মুসলিম জীবন ও ভূগোলের চিত্র হিসেবে, যা প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের দখলদারিকে স্বাভাবিক করে তোলে। কিন্তু গ্রন্থটির আবেদন ছিলো আরো বেশি। কারণ দখলদারির পরে দেখা গেলো তার আসল উপযোগিতা। সে উপদেষ্টার কাজ করলো এবং বললো, এবার লড়াই অন্যরকম, এবার প্রতিপক্ষ ইসলাম।

অতএব, ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচিত ও দৃষ্টান্তহীন একটি যুদ্ধ শুরু করার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে নেপোলিয়ান সকলের জন্য সমান সুযোগের বিপ্লবাত্মক ভাবাদর্শের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নিয়োগ দেন একদল পণ্ডিত আর চিন্তার চর্চার জন্য গড়ে তোলেন আধুনিক ইউরোপীয় বুদ্ধজীবীদের একটি প্রতিষ্ঠান।

এ ছিলো এক অভিযান, ইসলামের বিরুদ্ধে; কিন্তু নেপোলিয়ন সর্বত্র প্রমাণের চেষ্টা করেন, এ প্রয়াস ইসলামের জন্যই। তিনি যা বলতেন, তার সবই কুরআনের ব্যবহৃত আরবিতে অনূদিত হতো। ফরাসি সেনাবাহিনীর উপরস্থ কামান্ডারদের উপর নির্দেশ ছিলো যেন সকল সময় ইসলামের ধর্মীয় আবেগের কথা মনে রাখা হয়। নেপোলিয়নের বক্তব্য থেকে ইসলামের প্রতি ঝরে পড়তো শ্রদ্ধা ও অনুরক্তি। তিনি কুরআনের উদ্ধৃতি দিতেন এবং পৃথিবীকে ইসলামের পরিবার বানাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন। জামে আল আজহারের প্রধান আলেমদের আমন্ত্রণ জানাতেন আপন ডেরায় এবং তাদের প্রতি জ্ঞাপন করা হতো সামরিক সম্মান। যখন নেপোলিয়ন পরিষ্কার উপলব্ধি করলেন মিশরীয়দের উপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্যে তার সেনাবাহিনী খুবই অপ্রতুল, তখন তিনি স্থানীয় ইমাম, কাজি, মুফতি ও আলেমদের দ্বারা কুরআনের এমন ব্যাখ্যা প্রচার করালেন, যাতে মনে হয়, তার সেনাবাহিনী ইসলামের পক্ষের শক্তি। অচিরেই দখলদারের প্রতি ঘোরতর অবিশ্বাসের কথা ভুলে গেলো মিসরের মানুষ। নেপোলিয়ন যখন মিসর ছাড়বেন, তখন তার ডেপুটি জন ব্যাপ্টিস্ট ক্লেবারকে (১৭৫৩-১৮০০) কড়া নির্দেশ দিলেন তার এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের জন্য। কারণ, অন্য যে কোনো রাজনীতি খুবই ব্যয়সাপেক্ষ মূর্খতা।

ফরাসি কবি ভিক্টর মেরি হুগো (১৮০২-১৮৮৫) নেপোলিয়নের এই কৌশলী যুদ্ধজয়কে অভিনন্দিত করেছেন তার কবিতায়। তাকে সকৌতুকে অভিহিত করেছেন পশ্চিমের মেহমুত (মুহাম্মদ) হিসেবে! মুসলিমরা সরল বিশ্বাসে তাকে মুসলিম হিসেবে ভাবতে চেয়েছে। আজো বহু মুসলিম নেপোলিয়নকে ইসলামের একজন হিসেবে ভেবে তৃপ্তি পায়। লেখালেখি করেন, নেপোলিয়ন কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বা ইসলামের প্রেমে পড়েছিলেন? নেপোলিয়নের চারপাশের মুসলিমরা ছিলেন অধিকতর বাহ্যিকতায় বিশ্বাসী। পোশাকী উপস্থাপন তাদের বিভ্রান্ত করেছিলো এবং তারা হেরে গিয়েছিলেন।
জয়ী হয়েছিলেন নেপোলিয়ন। তার জয় কেবল যুদ্ধ ও শাসনে সীমিত থাকলো না। মিসরে সংক্ষিপ্ত সময়ের অবস্থানকালে তিনি পাল্টে দিলেন মুসলিম আইন। রাষ্ট্রীয়ভাবে জারি করা হলো ফরাসি আইন ও বিচারব্যবস্থা। ইসলামি আইনকে আবদ্ধ করা হলো বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকারের আওতায়। এ হয়ে উঠলো কেবল ব্যক্তিগত রীতি। মুসলমানদের গোটা ইতিহাসে এ ছিলো প্রথম ঘটনা। ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগিজরা এতো সহজে এটা ভাবতেই পারছিলো না। তারা জানতে চাচ্ছিলো, কীভাবে এটা সম্ভব হলো ফরাসিদের দ্বারা? কিন্তু যা ঘটার, ঘটে গিয়েছিলো। মুসলমানরা মোহগ্রস্থ তখন নেপোলিয়নের আলেম ও প্রাচ্যবিদদের পরিবেশিত ইসলামে।

সেন্ট হেলেনায় জেনারেল হেনরি জেন্টেইন বার্টান্ডকে (১৭৭৩-১৮৪৪) শুনানো স্মৃতিচারণে নেপোলিয়ন মিসর ও সিরিয়ায় তার সাফল্যের জন্যে প্রাচ্যবিদ ভোলনির রচনাবলীর ঋণ স্বীকার করেছেন। ভোলনি তাকে বলে দিচ্ছিলেন, কী করতে হবে এবং কী না করা উচিত। প্রাচ্য তার কাছে ছিলো দুর্বোধ্য এক জটিল জগত, কিন্তু ভোলনি প্রাচ্যের অজ্ঞাত অংশগুলোকে নেপোলিয়নের হাতে তুলে দিলেন মটরের দানার মতো। তিনি বাতলে দিলেন দখল ও শাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা ও তার সমাধান।

অরিয়েন্ট নামক ফ্লাগশিপে বসে মিসরীয়দের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন যখন ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন, তখন তার চারপাশে ছিলেন একদল প্রাচ্যবিদ। মিসর শাসনের জটিল মুহূর্তগুলোতে তিনি যখন বিশেষ কক্ষে অস্থির পায়চারি করতেন, তখনও তার পাশে থাকতেন কিছু প্রাচ্যবিদ। মিসর আক্রমণের আগ থেকেই তিনি ব্যবস্থা করে রাখছিলেন যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্যের আর যথেষ্ট সংখ্যক প্রাচ্যবিদের, যার প্রমাণ মিলে ১৭৯৩ এর ৩০ মার্চ আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ইকোল পাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণায়।

ইকোল পাবলিকের প্রথম আরবি শিক্ষক ছিলেন সিলভেস্ত্র দে সেসি (১৭৫৮-১৮৩৮)। তার বহু ছাত্র ছিলেন মিসর আক্রমণে নিপোলিয়নের সঙ্গী। তারা কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তারা ছিলেন নেপোলিয়নের সবচেয়ে মূল্যবান যোদ্ধা। তিনি তাদের দক্ষ হাতে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ ব্যবহারের কৃতিত্ব তার একার নয়। কারণ তার আগে ও পরে ইউরোপ প্রাচ্যবিদদের কাজে লাগিয়েছে গোপন, প্রবল অস্ত্র হিসেবে।

দুই.

orientalist বলে প্রাচ্যবিদরা বিশেষ অভিধা নিয়ে বিকশিত হতে থাকেন এই সময়কালে। শব্দটির প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৬৩০ সালে, প্রাচ্যের এক চার্চ সদস্যের ক্ষেত্রে। পশ্চিমা কারো ক্ষেত্রে এর প্রথম ব্যবহার ১৬৯০ সালে। ব্রিটিশ দার্শনিক ও প্রাচ্যভাষাবিশারদ স্যামুয়েল ক্লার্কের (১৬৭৫-১৭২৯) পরিচয়ে শব্দটির প্রয়োগ হয় বিশেষ মাত্রায়। এরপর এটি স্বতন্ত্র স্বভাব লাভ করতে থাকে। ইংরেজি ভাষায় এ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয় ১৭৭৯ সালে, ফরাসি ভাষায় ১৭৯৯ সালে। ১৮৩৮ সালে ফরাসি অভিধানে শব্দটি জায়গা করে নেয়। প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির প্রতি যা কিছু নিবদ্ধ, তার পশ্চিমা চর্চা ও পাঠকে তখনই অভিধা দেয়া হয় ড়ৎরবহঃধষরংস নামে। বিশেষ অর্থে মুসলিম প্রাচ্যের ভাষা, ধর্ম, সমাজ, শিল্প, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে পশ্চিমাদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা orientalism নামে চিহ্নিত হতে থাকে। এ চিন্তাধারার লালন ও বিকাশে যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তারা মুখ্যত প্রাচ্যবিদ বলে পরিচিতি পেতে থাকেন। অষ্টাদশ শতকে প্রাচ্যবিদ বলতে একটি সর্বজনীন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের বুঝানো হতো। এ বুঝানোর মধ্যে থাকতো এক প্রভুত্ব। প্রাচ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন পাশ্চাত্যের কেউ, এ সেই প্রভুত্বের একটি দিক। এই শ্রেণির মধ্যে ছিলেন প্রাচ্য সংস্কৃতির বিচার, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও ‘পরিশোধনে’ লিপ্ত বিশেষজ্ঞ, যারা চিত্রকর, সংবাদবাহক বা গ্রন্থকার হয়েও ছিলেন এর অধিক কিছু। তারা মূলত বিস্তৃততর মাত্রার পণ্ডিতকূল, যাদের অনেকেই প্রাচ্যদেশীয় একাধিক সংস্কৃতিতে গভীর জ্ঞান রাখতেন এবং একই সঙ্গে ধারণ করতেন মানবতাবাদী পরিচয়। অতীত ও বর্তমানকালের প্রাচ্যদেশীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলা ও পূরাতত্ত্ব ছিলো তাদের প্রধান বিষয়। তারা ছিলেন সবকিছু নিয়ে সক্রিয় কিংবা মূলত সক্রিয় ছিলেন প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক স্মারক নিয়ে; গবেষণা ও অধ্যয়নে। এ অধ্যয়ন তাদের নিয়ে যায় এমন কোথাও, যেখানে রয়েছে প্রাচ্যের হৃদস্পন্দন। প্রাচ্যবিদ সেখানেও হাত রাখতে পারেন।

কিন্তু প্রাচ্যের যে মানচিত্রে তাদের চোখ ছিলো, সে কোন প্রাচ্য? উনিশ শতক পর্যন্ত সে ছিলো নিকট প্রাচ্য। প্রাচ্য মানেই বিশাল ভূভাগ। কিন্তু প্রাচ্যচর্চার এলাকা মানেই ছিলো ওসমানী সালতানাতের অধিনস্ত অঞ্চলসমূহ। ফরাসি ব্যবহাররীতি তাতে যুক্ত করলো উত্তর আফ্রিকাকে। উনিশ শতকের সমাপ্তি ও বিশ শতকের প্রথম প্রহরে প্রাচ্যচর্চা গোটা এশিয়া মহাদেশে নিজেকে প্রসারিত করলো। প্রাচ্যবাদ তখন ভাঙ্গা-গড়া করছে সংস্কৃতিসমূহের ইতিহাস। আবিষ্কার করছে কিংবা হত্যা করছে অব্যাহতভাবে। পাশ্চাত্য মানসকে উদ্দীপিত করছে, প্রাচ্যকে লাগাম পরাচ্ছে। সে নিজেই হয়ে উঠছে এক সংস্কৃতি। ইউরোপ ও আমেরিকার সাংস্কৃতিক প্রবণতার এক অংশ।

১৮৭৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব অরিয়েন্টালিস্ট। ১৯৫১ সালে গঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ওরিয়েন্টালিস্ট। ১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হলো প্রাচ্যবিদদের বৈশ্বিক কংগ্রেস। ১৯৭৩ সালে সেটা হলো প্যারিসে। এরপর যতো কংগ্রেস হয়েছে, প্রাচ্যবিদদের নাম নিয়ে হয়নি। বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ব্যানারে। প্রাচ্যবাদ ততদিনে আরো পরিশীলিত, আরো কৌশলী। সে দাবি করলো, প্রাচ্যের মানবিক বিভাগসমূহ নিয়েই তার কাজ। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কলা, ধর্ম, রাজনীতি, সর্বত্রই সে ডালপালা ছড়ালো। সে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করলো আরো বেশি ছড়িয়ে দেবার জন্য। সে গলিত বরফের মতো মিশে গেলো এশিয়াটিক সোসাইটি, বিজ্ঞানকেন্দ্র, ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, মিডিয়াগোষ্ঠী, মিশনারী কার্যক্রম, গির্জা ইত্যাদিতে। প্রাচ্যবিদরা সেসব অঙ্গণে দিকনির্দেশক অবস্থান গ্রহণ করলেন। এমনকি, খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ১৭০১ সালে গঠিত সোসাইটি ফর দি প্রপোগেশন অব দি গসপেল ইন ফরেইন পার্টস থেকে নিয়ে ১৭৯২ সালে দ্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটি, ১৭৯৯ সালের চার্চ মিশনারী সোসাইটি, ১৮০৪ সালের দ্য ব্রিটিশ এন্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি, ১৮০৮ সালের দি লন্ডন সোসাইটি ফর প্রমোটিং খ্রিস্টিয়ানিটি সাফল্য লাভ করে প্রাচ্যবিদদের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের ফলেই। তারা বিচিত্র ধারায় কাজ করছিলেন। কিন্তু তাদের অভিন্ন লক্ষ্য ছিলো, পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সীমানা সম্প্রসারণ। সেটা কী মনে ও ভাষায়, কী আচারে ও ধর্মে! কী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে, কী রাজনীতি ও অর্থনীতিতে!

তিন.

আমরা সতেরো শতক থেকে প্রাচ্যবিদদের দেখছি একটি নির্ধারক ভূমিকায়। তারা তত্ত্বীয়ভাবে দিকনির্দেশক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। পশ্চিমা সভ্যতার আধিপত্যের সবচেয়ে কার্যকর বাহিনী হয়ে উঠছেন। তারা এমন নৈপুণ্য ধারণ করেন, যা তাদের বহুমুখী কাজের যোগ্য করে তোলে। সাম্রাজ্যের পলিসি এবং তাদের কাজ একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হয়। পশ্চিমা আধিপত্যকে তারা সকল উপায়ে যুগিয়ে চলে তথ্য, জ্ঞান ও শাসনের ব্যবস্থাপত্র। এ পথে চালিয়ে যায় ক্লান্তিহীন গবেষণা। অতএব, একজন আর্নেস্ট রেনান (১৮২৩-১৮৯২) পশ্চিমা দখলদারীর চৈন্তিক উপাদান সরবরাহ করেন রচনাকর্মে। আবদুর রহমান বাদাবী (১৯১৭-২০০২) তাকে অভিহিত করেন, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রবক্তা হিসেবে। ফরাসি এ চিন্তাবিদ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বিশ্বময় পঠিত। সেসব অনুবাদের মধ্যে আছে Studies of Religious History and Criticism. (1864). Islam and Science: A lecture presented at La Sorbonne, ( 1883) Renan’s Letters from the Holy Land. (1904). History of the People of Israel. (1888–1895). Lectures on the Influence of the Institutions, Thought and Culture of Rome, on Christianity and the Development of the Catholic Church. (1885) My Sister Henrietta. (1895). An Essay on the Age and Antiquity of the Book of Nabathaean Agriculture (1862). ইত্যাদির মধ্যে প্রতিফলিত যে রেনান, তিনি শুধু একজন দ্রষ্টা ও দার্শনিক নন, একজন শাসকও। তার পরিধি ছিলো বিশাল। কাব্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন কর্তৃত্বের জায়গা থেকে। এস্ট্রোলজি গবেষণায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, যা পরে প্রথায় পরিণত হয়। ১৮১২ থেকে ১৮৯২ প্রায় একশতকের জীবনপরিধিতে তিনি হয়ে উঠেন এক প্রণালী, যা দিয়ে একমহাদেশের সংস্কৃতি ও যুদ্ধজাহাজ আরেক মহাদেশে প্রবেশ করে। লেবাননে ছিলো তার বসবাস। তিনি পরিচালনা করেন পশ্চিমাদের গোয়েন্দাকর্ম।

মুসলিম জাহানে গোয়েন্দাগীরির পশ্চিমা ধারাবাহিকতা আধুনিক রূপ লাভ করে যাদের হাতে, রেনান তাদের একজন নন, তাদের পুরোধা। তার উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এ কাজের সমন্বয় কীভাবে সম্ভব? যে রেনান অফিসিয়াল ডিসকোর্স রূপে প্রাচ্যতত্বের ভিত্তি রচনা করেছেন, এর অন্তর্দৃষ্টিসমূহকে দিয়েছেন পদ্ধতিগত স্থান ও শৃঙ্খলা, নির্মাণ করেছেন এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, তিনি ছিলেন সময়ের আর্কাইভ। ভাষ্য ও বিবৃতির এক রীতি। ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক জ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করা তার কাজ, দর্শন ও ভাষাতত্ত্ব তার বিশেষ এলাকা, ভাষাবিজ্ঞানে তার বিচরণ অবাধ; অনেকটা ফ্রেডরিখ নিটশে (১৮৪৪-১৯০০) বা আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০) এর মতোই। লা অভেনির ডি লা সায়েন্স গ্রন্থে তিনি হয়ে উঠেন ভাষাতাত্ত্বিক আধুনিক মনের প্রতিষ্ঠাতা। ভাষাতত্ত্বের মতো সকল মানুষের বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা রেনান কাজ করলেন মুসলিম দেশে একজন গোয়েন্দা হিসেবে! কারণ, তিনি যে শাখায় কাজ করতেন, তার মনে বৈরিতার এক ধর্ম বিরাজ করতো প্রভাবক হয়ে। নিজের কাল ও পরবর্তীকালের ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসকে প্লাবিত করা এ পুরুষ সকল পরিচয় নিয়েও মূলত সেখানে ছিলেন ক্রুসেডীয় মনের সন্তান!

এ ক্ষেত্রে তার সাথে তুলনীয় হতে পারেন লর্ড ক্রেমার। তার পরিধিও ব্যাপক। বৃটেনের তুখোড় এক রাজনীতিবিদ। ইসলামের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ভাষা ও শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে প্রতিপত্তিশীল কূটনীতিবিদ। মিসরে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, প্রশাসক। বাগ্মীতায় এক প্রবাধপুরুষ। প্রাচ্যে তিনি পাশ্চাত্যের নিযুক্ত এক ঋষী, শাসক ও গবেষক। কিন্তু এর আগে তিনি ছিলেন প্রধানত একজন গোয়েন্দা। মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি প্রভাবশালী মহলে তিনি বন্ধু তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছেন যে কোনো তথ্য, যা জেনেছেন, পশ্চিমাদের সরবরাহ করেছেন। রচনা করেছেন এক ভেতরগত ভাষ্য, যাতে মুসলিমদের সমস্যা এবং তার মধ্যে নিহিত প্রাচ্যমানস অধরা না থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেনো তার মতো সময় বিনিয়োগ না করেও তারা যেন মুসলিম জাহানকে জানতে পারে তার মতোই। ১৯০৮ সালে বিখ্যাত মডার্ন ইজিপ্ট প্রকাশের দুই বছর পরে তিনি বিস্তৃত দার্শনিক আলোচনা করেন দ্য এনশিয়েন্ট এন্ড মডার্ন ইম্পেরিয়ালিজমের। ব্রিটিশ প্রভূত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রস্তাব করেন ক্রোমার। তিনি চাইতেন প্রাচ্যের মন ও সমাজে একটি অমোচনীয় ব্রিটিশ ছাপ, মহাপ্লাবী এক প্রভাব। তিনি আশা করতেন এর মধ্য দিয়েই প্রাচ্যজন অথবা মুসলিমরা নিজেদের বদলাতে পারবে। ‘যার উপর দিয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তার তীব্র উত্তপ্ত পশ্চিমা নিঃশ্বাস একবার বয়ে গেছে এবং যেতে যেতে রেখে গেছে দীর্ঘজীবী ছাপ, সে কখনো আর আগের মতো হয়ে উঠবে না।’

শাসিতের উপর উত্তপ্ত পশ্চিমা নিঃশ্বাস প্রয়োজন। তাকে উষ্ণ করার জন্য নয়, বদলে দেয়ার জন্য। যেন সে আর আগের মানুষ থাকে না। যেন তারা আর তারা না থাকে। সে জন্যই তার প্রাচ্যচর্চা। প্রাচ্যবাদ তার কাছে একমাত্র ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে মুসলিমদের উপর বিজয়কে ধরে রাখা সম্ভব। ১৯০৯ সালের ২৭ সেটপ্টম্বর হাউস অব লর্ডসকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘প্রাচ্যের মানুষের ভাষার সাথে শুধু নয়, তাদের প্রথা, আচার, অনুভূতি, তাদের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ধর্মের উপর আমাদের বিজ্ঞতা, যাকে বলে প্রাচ্যের প্রতিভা, তা বুঝার ক্ষমতা হলো একমাত্র ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা বিজয়ী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবো। লর্ড ক্রেমারের ইসলাম গবেষণা ছিলো লর্ড কার্জনের মতোই। সাম্রাজ্যের প্রয়োজনীয় আসবাবের অংশ, যার মূল প্রেরণা ছিলো তার উপনিবেশ, তার দেশপ্রেম। অতএব শাসক ভূমিকা, গোয়েন্দা ভূমিকা আর ইসলাম গবেষক ভূমিকা সবই ছিলো একই লক্ষ্যের সোপান। তার চিন্তা ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কর্মনীতির সমান্তরাল।

সিলভেস্ত্রো ডি সেসির নাম আমরা উল্লেখ করেছি। ১৭৫৭ সালে বিখ্যাত এক ইয়ানসেনিস্ত পরিবারে তার জন্ম। বিডিস্টাইন গির্জা শিশু সেসিকে আরবি শেখান। পরে শিখেন সিরিয়, হিব্রু, তুর্কি, কালাদিয় ইত্যাদি। ১৭৬৯ সালে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবাসিক প্রাচ্যবিদ হিসেবে। এ দায়িত্ব সেসির কাছে ছিলো পবিত্র ও মহান। গির্জা তাকে এভাবেই তৈরি করেছিলো। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন কোনো বেতন গ্রহণ না করেই। মিসরে আক্রমণকারী গ্রান্ড আর্মির আরবি বুলেটিনের কাজ করেন তিনি। নেপোলিয়নের ১৮০৬ সালের মেনিফেস্টো আরবি করে দেন। ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখলের পর দখলদার ফরাসিদের ঘোষণাপত্র আরবি করে দেন, তিনি ১৮২২ সালে হন সেখানকার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তাকে গ্রহণ করে উপদেষ্টা হিসেবে। ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইনস্ক্রিপশন একাডেমির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। হন রয়েল বিবলিওথিকের জন্য ইসলাম বিষয়ক পান্ডুলিপি সংগ্রহের কিউরেটর। তার হাতে পুনর্গঠিত হয় ফরাসি শিক্ষাব্যবস্থা। তিনি সংস্কার সাধন করেন ফরাসি সিলেবাস ও কারিকুলামের। ১৮৩২ সালে তিনি ঘোষিত হন ফ্রান্সের নতুন পিয়ের। তার রচনা কর্ম বিপুল। কালিলা দিমনার অনুবাদ (১৮১৬), হারিরির মাকামাতের বিস্তৃত আলোচনা (১৮২২), আলফিয়া সম্পাদনা (১৮৩৩), ইবনে রুশদ বিশ্লেষণ (১৮০৬) কিংবা মিসর-আরব আইন ও বিজ্ঞানগবেষণা (১৮০৫-১৮১৮) তার বিশাল কর্মপরিধির এক অংশ মাত্র। আরব শিলালিপি, মুদ্রা, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ও পরিমাপ পদ্ধতি থেকে নিয়ে অ্যারাবিক গ্রামার, মুসলিম ধর্মতত্ত্ব এবং শিল্প ও বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তৃত ছিলো প্রজ্ঞা ও তার কাজ। তার অধিকাংশ সৃষ্টি সংকলনমূলক। বৃহৎ একটি দল বৃহৎ আয়োজনে যা করত, সেসি একা তা করেছেন। ডেসিআর রিপোর্ট মতে সেসির শ্রেষ্ঠতম প্রবণতা হচ্ছে প্রাচ্য অধ্যয়নে তার অবদান। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ তিন খণ্ডের ত্রেস্তোমাথি অ্যারাবল; যা শুরু হয়েছে আরবি চরণ দিয়ে: কিতাবু আনিসিল মুফিদ লিত্তালিবিল মুস্তাফিদ ওয়া জামিউশ শুজুর মিন মানজুমিন ওয়া মানসুর, অধ্যবসায়ী ছাত্রের জন্য এক আনন্দময় ও লাভজনক গ্রন্থ। এটি ধারণ করে গদ্য-পদ্যের খণ্ডসমূহ। তার তৈরি টেড লিউ ইস্তরিকের ভূমিকা হচ্ছে সকল মানবীয় জ্ঞানকে একত্রে স্থাপন করার প্রয়াস। এটি রচনা সম্ভব করে তুলেছিলো নেপোলিয়নের মিসর জয়। একজন ইউরোপীয় হিসেবে তিনি প্রাচ্যদেশীয় সকল অর্কাইভ তছনছ করে ফেলেন এবং তা করেন ফ্রান্সে বসেই। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রাচ্যবিদ তৈরি। উনবিংশ শতকের সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ কোনো না কোনোভাবে তার সাথে সম্পর্কিত। ফ্রান্স, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও বিশেষ করে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এমন ছাত্র ছিলেন প্রচুর, যারা নিজেদের গঠন করেছেন তার পদতলে কিংবা তার সংকলনের মাধ্যমে। সেসিকে আমরা কীভাবে বিচার করবো? তিনি যুদ্ধে, শিক্ষায়, গবেষণায়, অনুবাদে, ভাষাতত্ত্বে, কূটনীতিতে একটি মাত্রই কাজ করে চলেছিলেন, সেটা হচ্ছে, একটি অধীনস্থ মুসলিম বিশ্ব এবং একটি প্রভু হিসেবে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব দান। সেক্ষেত্রে তিনি উদযাপন করেছেন পশ্চিমের ধর্মগুরু শিক্ষক অভিভাবক ও নির্দেশকের ভূমিকা। সেসির পূর্বসূরী ছিলেন জেস্তুল বুরখ হার্ট। বুরখ হার্টের পূর্বে এমন ভূমিকা উদযাপন করেন এডওয়ার্ড পুকোক। তার আগে ডি হারবেল্ট। এই যে ধারাবাহিকতা, এর সূচনা কোথায়?

চার.
আমরা মুসলিম স্পেনে প্রত্যক্ষ করি ইউরোপের ইসলামচর্চার সূচনা। ফ্রান্স হয়ে ইউরোপের গহীনে একে পৌঁছে দেয় স্পেনে আরবি ভাষার সংস্পর্শে জন্মলাভকারী মুযারিবদের ভাষা এবং বৃহৎ আকারে ল্যাতিন ভাষা। মুসলিম স্পেনে খ্রিস্টান বা ইহুদির ইসলামচর্চা একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়। যদিও কোনো খ্রিস্টানের ইসলামচর্চার ধারা আরবেই শুরু হয়। পশ্চিমা দুনিয়া বহন করেছে তার উত্তরাধিকার। সে ক্ষেত্রে তারা গুরু হিসেবে মেনেছেন যাকে, তিনি Seint John Damascene (৬৭৫-৭৪৯)। ক্রাইসেসাটোম বা সোনার অভিলাষী বলে পরিচিত এই পাদ্রীকে নিয়ে একধরনের ফ্যান্টাসি অনুভব করেন পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা। এন্টিয়কের এ পাদ্রী গ্রিক ভাষায় লেখালেখি করতেন, গ্রিক না হয়েও। কথা বলতেন সিরিয় বা আরামি ভাষায়। জানতেন আরবী ভাষাও। তার পিতামহ মনসুর ইবনে সারজুন ছিলেন দামেশকের অর্থদপ্তরের প্রশাসক। মুসলিমরা যখন দামেশক জয় করেন, তিনি এ পদে ছিলেন। যখন মুসলিমদের জয় ঠেকানোর কোনো সম্ভাবনা ছিলো না, তিনি শহরকে মুসলিমদের হাতে সমর্পণের প্রশ্নে ছিলেন ইতিবাচক। যেমন ইতিবাচক ছিলেন দামেশকের বিশপ ও মুক্তিকামী জনগণ। বিজয়ী মুসলিমরা মনসুরকে তার পদে রেখে দেন। মনসুর অবসর নিলে জনের পিতা সারজুন ইবনে মনসুর একই পদে সমাসীন হন। পদ লাভ করে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের প্রশাসনে তিনি হয়ে উঠেন প্রভাবশালী। মুসলিম খিলাফত খ্রিস্টান বা ইহুদিকে উচ্চপদে সমাসীন করতে অপ্রস্তুত ছিলো না। যোগ্যতা ও কাজের সক্ষমতা থাকলে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তাদের প্রতিষ্ঠা ছিলো নিয়মিত ব্যাপার। জনও লাভ করেন সরকারি পদ। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যান সেন্ট সাবায়, যা ছিলো জেরুসালেমের নিকটস্থ এক মঠ। সেখোনে সন্যাসসাধনায় জীবন কাটাতে তিনি সংকল্প করেন। তাদের পরিবার মুসলিম সাম্রাজ্যের উচ্চপদে সুযোগ লাভ করলেও নিজেদের পরাজয়ের বেদনা বহন করতো। ইসলামের হাতে শাসিত সিরিয়া তাদের মনে রক্তক্ষরণ ঘটাতো। কিন্তু তারা সচেতন ছিলেন যে, ইসলামের মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। উমাইয়া খেলাফত ভিন্ন ধর্মের অনুসারী পণ্ডিতদের আহবান করতো ইসলাম ও নিজ ধর্ম নিয়ে কথা বলার জন্য। সেন্ট জন খ্রিস্টানদের তরফে আগত পণ্ডিতদের বহু সংলাপ প্রত্যক্ষ করেন। তাদের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখেন। জ্ঞান ও যুক্তিতে তাদের হেরে যাওয়া দেখেন, যা তাকে বিচলিত করতো, পীড়া দিতো। তিনি মঠজীবনে নিজ ধর্মকে আরো নিবিড়ভাবে জানার চেষ্টা করলেন এবং অনুসন্ধান করলেন এমন প্রক্রিয়া, যা মুসলিমদের সাথে সংলাপে তার বিশ্বাসের বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। অতএব, তিনি লিখলেন এক গ্রন্থ, যা শেখাবে, একজন খ্রিস্টান কীভাবে পরাজয় এড়িয়ে এক মুসলিমের সাথে বিতর্ক করবেন? খ্রিস্ট্রীয় বিশ্বাস অনুযায়ী যিশুর ঈশ্বরত্ব ও মানবীয় ইচ্ছার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে এ বইয়ে সংলাপ আকারে একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে একজন খ্রিস্টানের তর্ক বিবৃত। পি.কে. হিট্টি ঠিকই লিখেছেন, ‘এটি খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে মুসলিম বিরোধিতার পথপ্রদর্শক সারগ্রন্থ।’

সেন্ট জনকে পশ্চিমা ইতিহাস যতোটা গুরুত্ব দিয়েছে, ততোটাই গুরুত্বহীন মনে করেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকরা। পশ্চিমা দুনিয়া বরাবরই তার থেকে প্রেরণা নিয়েছে এবং তাকে মহিমান্বিত করেছে। খ্রিস্টীয় ইতিহাসে তাকে প্রাচ্যের গ্রিক গীর্জার মহান ও শেষ ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে গণ্য করা হয়। পাদ্রীসাহিত্যে যেসব স্তোত্র তিনি রচনা করেন, সেগুলো গীর্জার সেরা সৌন্দর্য। এসব স্তোত্র প্রায় হারিয়ে গেলেও এখনো প্রোটেস্টান্টদের ব্যবহারে তার অবশেষ বিদ্যমান রয়েছে। বাইজান্টোইন সঙ্গীতের জনক হিসেবে জনকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা বাড়াবাড়ির মতো শুনালেও এর মূলে আছে তাকে মহিমান্বিত করার উদ্যম। গীর্জা তার গ্রন্থগুলোকে ইউরোপে পৌঁছে দেয়। কারণ, সেখানেও মুসলিমসভ্যতা বিজয়ী হয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা করছিলো। সেখানেও পাদ্রীদের মুখোমুখি হতে হতো ইসলামের সাথে। মুসলিম স্পেনে একটি মিশ্রসমাজ গড়ে উঠেছিলো। যেখানে সবধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থানের পাশাপাশি সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের তুলনামূলক চর্চার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিলো। এ পরিস্থিতির দাবি ছিলো, একটি ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী বুদ্ধিজীবী অন্য ধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞান রাখবেন। এর সাথে যুক্ত ছিলো আপন বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অভিপ্রায়ও। মূলত তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম স্পেনে। এর আগে ইসলামী দুনিয়ায় এর বহুমুখী চর্চা হলেও এর বৈজ্ঞানিক রূপায়ন ঘটে ইবনে হাযম উন্দুলুসীর ( আ. ৯৯৪-১০৬৪) হাতে। তার আল ফাসলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নিহাল গ্রন্থ সব ধর্ম ও মতবাদ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। এর ধারায় জরুরি হয়ে পড়ে ইহুদি ও খ্রিস্টীয় প্রচেষ্টা। ইহুদি প্রচেষ্টা দেখা যায় yahuda Halevi (আনু. ১০৮৫-১১৪৩) এর রচনায়। আল খুযারী (প্রকাশ: ১১৪০) গ্রন্থে তিনি ইহুদিধর্মের জায়গা থেকে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের সাথে কথা বলেন। খ্রিস্টীয় প্রচেষ্টার প্রকাশ ঘটে নানা মাত্রায়। ইসলাম ও আরবিভাষা অধ্যয়নে স্পেনিশ খ্রিস্টানদের বড় একটি অংশ অনুপ্রাণিত ছিলো। এর মূলে প্রধানত ছিলো উন্নত সভ্যতার অনুগমন। তারা লিখতেন আরবিতে, পড়তেন আরবি সাহিত্য, অনুসরণ করতেন মুসলিম সংস্কৃতির। যদিও খ্রিস্টান পরিচয়ে ছিলেন স্বচ্ছন্দ। এ রকম খ্রিস্টানরা বিবেচিত হচ্ছিলেন অগ্রসর ও প্রগতিশীল হিসেবে। পাদ্রীরা তাদের নিয়ে আক্ষেপ করতেন। যার বিবৃতির জন্য দেখা যেতে পারে আর ডব্লিউ সাউদার্নের ওয়েস্টার্ন ভিউজ অব ইসলাম ইন দ্য মিডল এজস এর ভাষ্য। সাউদার্ন শুনাচ্ছেন আক্ষেপ: এসব খ্রিস্টান পছন্দ করতো আরবদের কাব্য ও প্রেমকাহিনী, পড়তো। তারা পাঠ করতো আরব ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের রচনা। এই পাঠ প্রত্যাখানের জন্য ছিলো না, ছিলো বিশুদ্ধ ও অগ্রসর আরবি জানার জন্য। পবিত্র গ্রন্থের ল্যাটিন ব্যাখ্যা পড়ুয়া সেই সাধারণ মানুষটি কোথায় হারালো? কোথায় সেই গবেষক, যার অনুসন্ধান গসপেল, পয়গম্বর বা সহচরদের নিয়ে? হায়! কী আগ্রহ নিয়ে মেধাবী তরুণ খ্রিস্টানরা পাঠ করছে আরবদের বই, গবেষণা করছে আরবদের নিয়ে!

কিন্তু একটি অংশ আরবি ও ইসলাম অধ্যয়ন করে এর মুখোমুখি হবার আগ্রহে। তারা ছিলেন প্রবলভাবে ইসলামের প্রতিপক্ষ। তারা দেখতে রাজি ছিলেন না বিজয়ী ইসলামকে, যার হাতে খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যসমূহ বিধ্বস্ত হয়েছে, খ্রিস্টীয় গরিমা ম্লান হয়ে গেছে এবং যে ইসলাম মূলত শয়তানের কারসাজি। অতএব, এর বাহকদের উচ্ছেদ করতে হবে, প্রয়োজনে এদের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে গৌরবের মৃত্যুকে বরণ করতে হবে। এ ধর্মের কেন্দ্রে যেহেতু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, অতএব তাকে চিত্রায়িত করতে হবে সর্বোচ্চ মন্দের সাথে। এ এক পূণ্যকর্ম। ধর্মান্ধ ও বিবেচনারহিত মানুষদের এমন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ করা ছিলো সহজ এবং সেটাই হচ্ছিলো।
এসবের প্রতিক্রিয়া ছিলো বিপজ্জনক। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে পরেফেকটাস নামের এক মঙ্ক মুসলিম স্পেনের বাজারে প্রকাশ্যেই মহানবী সা. কে অশ্রাব্য গালাগালিতে লিপ্ত হয়। যেসব প্রচার তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেগুলোই সে বলে চলছিলো। তিনি ভণ্ড, বিকৃতকামী, যিশুর দুশমন ইত্যাদি। সামাজিক উত্তেজনা ও সহিংসতা ছিলো অবধারিত। পারফেক্টাসকে বন্দি করা হলো। কিন্তু অচিরেই তার অনুসরণে তৈরি হলো এক আন্দোলন। তাকে দেয়া হলো পথিকৃতের মর্যাদা। পল আ্যালভারো তাকে জাতীয় বীর হিসেবে চিত্রিত করলেন। চরমপন্থী খ্রিস্টান নারী-পুরুষরা জনতার ভিড়ে বা আদালতে এসে মহানবীকে নিকৃষ্ট ভাষায় আক্রমণ করে চললো, যা ছিলো রাষ্টীয় আইনের প্রতি দলবদ্ধ চ্যালেঞ্জ। কিন্তু একে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে প্রচার করা হলো।

পারফেক্টাস কারাগারে কঠোর শাস্তি থেকে বেঁচে যান। কিন্তু অচিরেই তার ক্ষোভ বেসামাল হয় এবং আরো নোংরা এবং বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ সে জারি রাখে মহানবীর বিরুদ্ধে। ফলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছাড়া কোনো পথ ছিলো না কাযীর সামনে। ক্যারেন আর্মস্ট্রং জানান, মঙ্ককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং খ্রিস্টসমাজের প্রান্তিক অবস্থানের একদল খ্রিস্টান তার মৃতদেহকে খণ্ড বিখণ্ড করে পবিত্র স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নিয়ে যায়। ক’দিন পরে ইসহাক নামে এক মঙ্ক এবং এরপর মনেস্টারির দুই মঙ্ক প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য পেশ করা এবং মহানবীকে সা. ভয়াবহভাবে আক্রমণ করার জন্য আদালতকে বেছে নেয়। কাজীর সামনে এসে চূড়ান্ত হিংসাত্মকভাবে তারা ঘৃণ্য বক্তব্য রাখে। এটি ছিলো রাষ্ট্রের প্রতি সঙ্ঘবদ্ধ চ্যালেঞ্জ। কাজী তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনান। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলো ইউলোজি এবং পলএলভারো নামের দুই খ্রিস্টান নেতা। তারা এমন আত্মঘাতীদের ঈশ্বরের সৈনিক বলে ঘোষণা করেন এবং এ প্রচেষ্টাকে পবিত্র যুদ্ধের অংশ বলে প্রচার করেন। কর্ডোভার বিশপ নতুন এই যুদ্ধপ্রচেষ্টার সমালোচনা করেন। কিন্তু সমাজের ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছিলো এই চরমপন্থা। লোকালয়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ, মুসলিম বিশ্বাসকে আক্রমণ, মহানবীর বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষী প্রচারের মাধ্যমে এমন এক সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চলে, যাতে অগণিত প্রিস্ট, পাদ্রী, পণ্ডিতসহ সাধারণ অনেকেই জড়িত ছিল। তবে শান্তিকামী মুসলিম ও খ্রিস্টানদের যৌথ প্রতিরোধে এ আন্দোলন স্তিমিত হয়।

পাঁচ

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে রচিত একটি Glossarium Latino-Ara-bicum আরবি ও ল্যাতিন অধ্যয়নের জনপ্রিয়তার জানান দেয়। এটি ছিলো আনুমানিক ১১ হাজার মৌল ল্যাটিন শব্দসমৃদ্ধ, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অনুবাদ করা হয়নি। খ্রিস্টীয় তেরো শতাব্দীতে প্রণীত Vocabulista in Arabica ছিলো অপেক্ষাকৃত অগ্রসর। এতে ছিলো প্রায় ৪০০০ মৌলিক ল্যাটিন শব্দ এবং প্রায় ৮০০০ আরবি নির্দেশক শব্দ। এগুলো ব্যবহৃত হয় ল্যাতিন ভাষা থেকে আরবি অনুবাদে এবং আরবি ভাষা থেকে ল্যাতিন অনুবাদে। পশ্চিমা দুনিয়ায় ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়ক লিখিত গ্রন্থের আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় Moses Sefardi (১০৬৫-১১২১) এর কিছু রচনাকে। সেফার্ডি ছিলেন স্পেনিশ ইহুদি। ১১০৬ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং petrus alphonsi নাম গ্রহণ করেন। ইতিহাসে তিনি Pedro De Alfonso নামে বিখ্যাত। মুসলিম স্পেনে তিনি উন্নত শিক্ষা লাভ করেন, আরবীয় চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যায় হন পারদর্শী। অনুবাদ করেন এরাবিয়ান নাইটস এর। কিংডম অব এরাগনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ফ্রান্সে অবস্থান করেন লম্বা সময়। তারপর চলে যান ইংল্যান্ডে। সেখানে রাজা হেনরি-১ (মেয়াদ-১১০০-১১৩৫) এর চিকিৎসক নিযুক্ত হন। সেখানে আরববিজ্ঞান ও জ্ঞানকলার বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি বরিত হতে থাকেন। তার De Dracone, in which he calculates movements of the stars কিংবা অধিকতর প্রসিদ্ধ ফব de Astronomia, contains an astronomical grid according to the arab ছিলো এ সময়ের গুরুত্ববহ রচনা। ইসলামবিষয়ক তার রচনার স্বাক্ষর রয়েছে তার প্রণীত Dialogi in quibus impiac Judaesrum Confutantur গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে।

Peter The Venerable (১০৯৪-১১৫৪) ছিলেন ঈষঁহু এর বেনেডিকটাইন গির্জার প্রধান। টলেডো নগরে তিনি গেলেন, ইসলামের পাঠলাভ করলেন এবং জ্ঞান ও নবচিন্তা তাকে আলোড়িত করলো। স্পেনের টলেডো মুসলিমদের কাছ থেকে তখন দখল করে নিয়েছে খ্রিস্টশক্তি। ১০৮৫ সালের এ ঘটনার পরে শহরটি হয়ে উঠে রোমান চার্চের প্রধান এক কেন্দ্র। এ শহর ছিলো একটি চ্যানেল, যেখান থেকে আরব জ্ঞান ইউরোপে পাচার করা হতো। শত শত আরবগ্রন্থ ল্যাতিনে অনূদিত হয় এখানে। আর্চবিশপ ডন রেমেুনদো (কার্যকাল: ১১২৫-১১৫১) এ প্রক্রিয়াকে করেন ত্বরান্বিত। আরবি গ্রন্থ অনুবাদের কাজে আরোপ করেন ধর্মীয় ও জাতিগত মহিমা। ধীরে ধীরে টলেডোকে অনুসরণ করে কার্তেজ, টোলাইজড, রেইমস, টুরস এবং প্যারিস। অগণিত আরবি গ্রন্থ এসব শহরে জড়ো হয় এবং ল্যাতিন অবয়ব পেতে থাকে। ট্টাবজোনের গ্রিক অনুবাদ স্কুল হতে থাকে মুসলিমদের গ্রন্থে একাকার। বার্সেলোনার লেপিটাস অগণিত গ্রন্থ সংগ্রহ করেন ঘুরে ঘুরে। দশম শতক থেকে এটি এক ধারাবাহিক উদ্যমে পরিণত হয়। দ্বাদশ শতকে দেখি, এক গেরহার্ড ভন ক্রিমোনা অনুবাদ করেন ইবনে সিনা, রাজি, ফারাবি, কিন্দিসহ সেরাদের বিশালাকার নব্বইটি গ্রন্থ। প্লেটো ভন টিতোলি ১১২০ সালে সম্পন্ন করেন আল বাত্তানি অনুবাদ, যার নাম তিনি দেন Handbook of Astronomy, এক পর্যায়ে তা ইউরোপে জনপ্রিয় হয় এবং টলেমির জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাত্তানির নাম গ্রন্থ থেকে উধাও হয়ে যায়। অনুবাদক ও অগ্রসর যাজকদের কাছে এটা ছিলো নতুন ধরনের এক যুদ্ধ। পিটার দ্য ভেনারেবল এ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। আরবি ভাষায় পণ্ডিত কিছু সহযোগীর প্রয়োজন তিনি অনুভব করেন। যারা মুসলিম জামেয়াসমূহে শিক্ষালাভ করবেন এবং মুসলিম জ্ঞানকলায় হবেন প্রাজ্ঞ। এমন সহযোগী লাভ করতে তার বিলম্ব হলো না। পিটার সিদ্ধান্ত নিলেন, শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ অনুবাদে চলবে না। ইসলামের শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলী তাদের ভাষায় যাওয়া প্রয়োজন। আল কুরআন, আল হাদিস, ফিকহসহ মৌলিক ও প্রধান বিষয়সমূহ তাদের চর্চায় থাকুক। অতএব, কুরআন মজিদ ও আরো চারখানা গ্রন্থ অনুবাদের এক পর্ষদ গঠনে তিনি সক্ষম হলেন। এ পর্ষদে ছিলেন Robart of ketton Ges Harmanan Of Delmatia. . বিশাল কর্মযজ্ঞ। ১১৩৪ সালে সমাপ্ত হলো অনুবাদ। পিটার নিজে এসব অনুবাদের টীকা সংযোজন করলেন এবং ব্যাখ্যা দুটি রচনা করলেন। যার একটি হলো, Summa Totius Haeresis Saracenorum আরেকটি হচ্ছে, বিতর্কপ্রবণ ও বিস্তৃত গ্রন্থ ষরনবৎ ঈড়হঃৎধ ঝরাব liber Contra Sive Haeresim Saracenorum। এগুলো পশ্চিমা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে Cluniac Corpus নামে।

পিটার তার সহযোগীদের নিয়ে সম্পন্ন করেন ইসলামী আইনের ল্যাতিন সঙ্কলন প্রণয়ন। যার নাম ছিলো খবী Lex Mahumet pseudoprophete যার ইংরেজি দাঁড়ায় Law of Muhammad the pseudo-prophet/false prophet. . মানে ভণ্ডনবী মুহাম্মদ এর বিধান! পিটারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন টলেডোর আরবি অনুবাদকেন্দ্রের প্রধান ও ধর্মগুরু pedro Alvarez De Toledo উভয়ের প্রচেষ্টায় বিচিত্রসব গ্রন্থ ও ভাষ্য রচিত হচ্ছিলো। যা ইউরোপীয় মেধাকে নতুন এক পথের পথিক বানায়। তাদের তত্ত্বাবধানে অনূদিত হয়ে প্রচারিত হয় Apology of al-Kindi. . ইউরোপের পরবর্তী জ্ঞানেতিহাসে যার প্রভাব অবর্ণনীয়।

ভেনারেবলের সময়টি ছিলো ক্রুসেডের ডামাডোলে কম্পমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রুসেডে লড়ছে, মরছে। ছয়টি ক্রুসেড ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং এর রক্ত ও জখমে পশ্চিমা মনে ইসলাম মানেই প্রধান প্রতিপক্ষ। যাকে পরাজিত করতে না পারার গ্লানিতে তারা জর্জরিত। এবোট বার্নার্ড অব ক্লেয়ারভক্স (১০৯০-১১৫৩) এর আহবানে ইউরোপ তখন সপ্তম ক্রুসেডের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১১৪৭ থেকে ১১৪৯ অবধি যা জারি থাকবে। এতে নেতৃত্ব দেবেন সপ্তম লুইস এবং তয় কনরাড। এ ক্রুসেডের প্রধান আহবায়ক ছিলেন ক্লেয়ারভক্স। তিনি অভিহিত ছিলেন সম্মানজনক সেন্ট বার্নার্ড অভিধায়। ছিলেন ফরাসি গির্জার প্রধান। বেনেডিক্টাইন সন্যাসবাদের পুনরোজ্জীবন হয় তার হাত দিয়ে। তার প্রভাব ছিলো প্রশ্নাতীত।

ক্লেয়ারভক্সের ক্রুসেড আহবানের প্রতিবাদ করেন ভেনারেবল। তার কথা ছিলো, এভাবে সফল হওয়া যাবে না। যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে হয় না। এটা অনেক গভীর, অনেক ব্যাপক। ইউরোপ ভেনারেবলের কথা শোনেনি। ক্লেয়ারভক্সের ডাকে সাড়া দিলো এবং লক্ষ লক্ষ সৈন্যের আরেকটি অভিযান প্রাচ্যের দিকে প্রেরিত হলো। কিন্তু এ অভিযানের ফলাফল ছিলো চরম হতাশাজনক। পরাজয় ও বিপর্যয় ছাড়া এ থেকে তারা কিছুই লাভ করতে পারেনি।

ভেনারেবলই সঠিক প্রমাণিত হলেন। তিনি ও তার অনুসারীরা আরো জোরে বলতে লাগলেন, সশস্ত্র যুদ্ধ দিয়ে নয়, মুসলিমদের হারাতে হবে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে। তাদের মেরুদণ্ড গুড়া করতে হবে আগে। সেটা সম্ভব কেবল সাংস্কৃতিক যুদ্ধে। তাদেরকে হারাতে হবে আদর্শিক যুদ্ধে। সে আদর্শ খোঁজে নিতে হবে ইসলাম থেকেই। তাদেরকে মোহগ্রস্ত করতে হবে খ্রিস্টীয় ভাবধারায়। জাগতিক প্রতিটি উপকরণে অর্জন করতে হবে সমৃদ্ধি। তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করতে হবে। কারণ এতে পশ্চিমারা তাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে সীমাতিরিক্ত পর্যায়ে। তাদের আসল শক্তি ইসলাম। একে করতে হবে নিস্প্রাণ। রোধ করতে হবে ইসলামের প্রচার। সেজন্য হতে হবে ইসলামবিশেষজ্ঞ। তারা যে সাংস্কৃতিক প্রাণরস লাভ করেছে ধর্ম থেকে, সেটা থেকে তাদের করতে হবে বিচ্ছিন্ন। এটা সম্ভব হলে তাদের হারানো কোনো ব্যাপারই নয়।

ছয়

ইউরোপের অসংখ্য মেধাবী ভেনারেবলের চিন্তাকে অবলম্বন করলো। ইসলামচর্চার উদ্যম বেড়ে গেলো। পশ্চিমা স্কুলসমূহ ত্যাগ করে মেধাবীরা ভর্তি হতে থাকলো আরবি স্কুলে। ব্রিটেন থেকে নিয়ে জার্মান-গ্রিস, ফ্রান্স-ইতালি কিংবা নর্মানদের মধ্যেও এ প্রবণতা ছড়ালো। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখা-প্রশাখার চর্চা ও বিকাশ ত্বরান্বিত হতে থাকলো। অনেকেই কেবল ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতিবিশেষজ্ঞ হলেন। তাদের হাতে সম্পন্ন হতে থাকলো বহু রচনাকর্ম। Raymond Martin (আনু.১২৩০-১২৮৬) রচিত Pugio Fidei Adveros Mauros et judaaeos পশ্চিমা দুনিয়ার তখনকার অন্যতম জ্ঞানপুরুষ Raymond Hull (আনু. ১২৩১১১-১৩১৫) রচিত Liber De gentili et Tribus sapientibus Ges liber de Taratari et Christiani, Ges Ricoldo de monte crocc (মৃত্যু- ১৩২১) রচিত Dispotatio Contra Sarasenos et Alchoranum ( Improbatio Alchorani) এবং libellus ad Nationes Orientales ইত্যাদি গ্রন্থ ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা মনে নতুন ভাবধারা তৈরি করে। যা নতুন বিজয়ের আবেগে, ঘৃণার বিস্তারে, হিংস্র চিত্রায়নে এবং আধিপত্যের উদ্দীপনায় উদ্বেলিত।

অল্প ব্যবধানে ইউরোপে ইসলাম সম্পর্কিত রচনার বন্যা বয়ে যায়। সেসব লেখার প্রায় সবই ছিলো উদ্ভট, মিথ্যা ও আজগুবি। কারণ ইসলামকে মূল উৎস থেকে জানার জ্ঞান এসব লেখকদের মধ্যে তখন ছিলো না। তখনকার খ্রিস্টান লেখকদের মধ্যে আরবি ভাষায় সুদক্ষ ছিলেন সর্বোচ্চ বিশজন।

মধ্যযুগের পশ্চিমা দার্শনিক Raymond lull প্রতিষ্ঠা করলেন একটি মাদরাসা। ম্যাজোরকা দ্বীপের মিরামার এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারীদের শিক্ষার জন্য সে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে কুরআন-হাদীসসহ ইসলামী জ্ঞানের বিবিধ বিষয় পঠিত হতো। এ নিয়ে শেখানো হতো সংলাপ ও বিতর্কপদ্ধতি। ১২৭৬ থেকে ১২৯৪ সাল অবধি এ মাদরাসা চালু ছিলো। এ মাদরাসা পরবর্তী ইউরোপকে ইসলামচর্চার নতুন দিশা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ইসলামী অনুষদসমূহে হারিয়ে গেলো। তারই সুপারিশের ফসল অচিরেই ডালপালা বিস্তার করলো। The Council of Vienna প্রাচ্য ভাষার অধ্যয়নকে নিয়মিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ১৩১১ সালে। প্রাচ্যভাষা বলতে বুঝানো হবে, আরবি, গ্রিক, হিব্রু ও সিরিয়াক ভাষা। ইউরোপের প্রধান পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ক পৃথক শাখা তৈরি হলো। দুইজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এসব শাখার পাঠদান জারি রাখা হবে। রোম, বোলোগানা, প্যারিস, অক্সফোর্ড , স্যালামাঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হলো অন্যান্য ভাষার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক আরবিচর্চা।

চার্চের তরফে ইসলাম জানার প্রয়াস বাড়ে। ফ্রান্স-ইতালিতে প্রভাবশালী ক্লুনিয়াক মঠের নবীন রূপ বেনেডিকটাইন এ ব্যাপারে ছিলো বিশেষ উদ্যমী। সম্রাট শার্লেমন এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো এ ক্ষেত্রে। পশ্চিম ইউরোপে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উন্মেষের এ লগ্নে ইসলাম হয়ে উঠে এমন শত্রুদের জ্ঞান, যাকে জানতে হবে। ডোমিনিকান ও ফ্রান্সিসক্যান গির্জাগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। ইসলাম ও খ্রিস্টবাদের দ্বন্দ্ব চলমান ছিলো। পাদ্রীদের জবানীতে ইসলাম হাজির হচ্ছিলো নিকৃষ্ট অবয়বে। এই অবয়ব তৈরির পেছনে ছিলো না আদৌ কোনো পাঠ। আলবার্ট হুরানি দেখিয়েছেন এ সময়ে পশ্চিমা খ্রিস্টবাদ ইসলাম সম্পর্কে এতো মিথ্যাচারী ও বিদ্বেষবিষাক্ত প্রোপাগাণ্ডা চালাতো, যা দেখলে কোনো মুসলিম তাদেরকে সুস্থ মনে করবে না।

এ পরিস্থিতি তৈরি করলো অধিকতর পরিশীলিত চাহিদা। ইসলামকে জেনে আক্রমণ করতে হবে এবং দেখাতে হবে, তার তুলনায় খ্রিস্টবাদ কতো ভালো। ইতোমধ্যে দুই জনগোষ্ঠীর নানা অংশে তৈরি হয়ে গেছে পারস্পরিক যোগাযোগ। ফলত পরস্পরের বিশ্বাসের মূল্যায়নও আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ক্রুসেডের ভয়াবহ পরিস্থিতি মুসলিম জাহানকে তেমন কিছু না দিলেও খ্রিস্টবিশ্ব তা থেকে লাভ করে নবজীবন। ইসলামকে জানা ও উপস্থাপনের প্রশ্নে এ সময় বিশেষ মাত্রা পায় প্রাচ্যবিদ্যা। উইলিয়াম মন্টোগোমারী ওয়াট দেখিয়েছেন, তখনকার প্রাচ্যবিদ্যা ইসলামকে দেখাতো চারটি প্রধান অবয়বে। এক ইসলাম এক মিথ্যাচার, সত্য থেকে বিচ্যুতি এবং প্রকৃত সত্যের সাথে সচেতন প্রতারণা। দুই. এ হচ্ছে ঘৃণা, হিংস্রতা ও আগ্রাসনের এক ঢেউ। অস্ত্র ও সংঘাতকেন্দ্রিক এক ধর্ম। তিন. এর চরিত্র হচ্ছে ভোগপরায়ন। ইহ ও পরকালীন ভোগের লোভ উস্কে দেয় সে। মানুষের ঋপুকে সকল পথে উত্তেজিত করে এবং সরবরাহ করে প্রবৃত্তির খাবার। চার. হযরত মুহাম্মদ সা. হচ্ছেন যিশুখ্রিস্ট্রের দুর্মর এক দুশমন। যিশুর আদর্শ রাখতে হলে তার আদর্শের উচ্ছেদ জরুরি। কেননা যিশুর আদর্শের প্রতিপক্ষ আদর্শ এটি। এন্টিক্রাইস্টের বৈশিষ্ট্য সে ধারণ করে। তার অনুসারীদের মধ্যে পাওয়া যায় গগমেগগের মিল।

একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় এ ইসলামচিত্রায়ন পরবর্তী ইউরোপ যে পরিহার করতে পারেনি, এর নমুনা দেখায় নরম্যান ডানিয়েল এর ইসলাম এন্ড দি ওয়েস্ট। ১৯৬০ সালে এডিনবরা থেকে প্রকাশিত এ গ্রন্থ ইসলামপ্রশ্নে পশ্চিমা মনের যে ছবি আঁকে, তা কেবল উল্লেখিত চার বৈশিষ্ট্যকে আরো গভীর ও সূক্ষ্ম অর্থে উপস্থাপন করে এবং প্রসারিত করে। ইসলামপ্রশ্নে এই দীর্ঘ শতক সমূহে পশ্চিমা মন বস্তুনিষ্ঠতার পথে খুব কমই এগিয়েছে। হয়তো ইচ্ছে করেই প্রাচীন ঘৃণার ঐতিহ্যকে সে আকড়ে ধরেছে এবং এই ধারণকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে রোমান চার্চ। ইউরোপে যখন রিফর্মেশন হলো, তখনও এই চার বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম আকারে দেখা ও দেখানোর ধারায় ছেদ পড়েনি। রিফর্মেশন এই ভ্রান্তিকে প্রশ্রয় শুধু দেয়নি, নানাভাবে জোগান দিয়েছে রক্তজল!

সাত.
আল্লাহর পয়গম্বর হিসেবে হযরত মুহম্মদ সা. কে পশ্চিমা অধ্যয়ন হাজির করেনি বললেই চলে। এ অবশ্য ঠিক যে, খ্রিস্টান অবস্থান ধরে রাখা কোনো পণ্ডিতের কাছে তাঁকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে মেনে নেয়ার আশা করাটা একটু বেশি হয়ে যায়। কিন্তু মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধার আশাটা তো করাই যায়। কিন্তু এ জায়গায় প্রাচ্যবাদ কখনোই নির্মোহ হতে পারেনি। যদিও একাডেমিক অধ্যয়নের জন্য নির্মোহ হওয়াটা একান্ত জরুরি। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাচ্যবিদরা যখনই মুহম্মদ সা.কে উল্লেখ করেছেন, তীর্যক ভাবটা সযতনে ধরে রেখেছেন। যখন প্রশংসা করেছেন, নানামুখী নিন্দার ভেতর থেকে করেছেন। ফলত এ প্রশংসাকেও পরিহাসের মতো শুনিয়েছে। মহানবীকে একটি নকল ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং ইসলামকে ব্যক্ত করা হয়েছে নীতি ও পদ্ধতির এমন এক কাঠামো হিসেবে, যার মধ্যে রয়েছে উদ্দেশ্য ও পদ্ধতিগত বহু মন্দের সমাবেশ। ওহীর অবতরণ, বহুবিবাহ, জিহাদ, আরব সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্রুপের সাথে ব্যক্ত হয়েছে, এর সাথে যখন কোথাও ইতিবাচক কোনো বর্ণনা এসেছে, দেখে মনে হয়েছে, করুণা দেখানো হচ্ছে মাত্র! তবে যেসব এলাকায় মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময় জারি ছিলো, সেখানে ইসলাম শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছে নানাভাবে। ক্রুসেডারদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সিরিয়া-ফিলিস্তিনে এসে ইসলামে দীক্ষিত হন। তাদের উত্তরপুরুষরা আরবে রয়ে যান। অনেকেই গ্রহণ করেন বেদুইন জীবন। যাদের উল্লেখ আমরা পাই মুহম্মদ আসাদের ভ্রমণকাহিনীতে, রোড টু মক্কা এর শিহরণময় আখ্যানে। ক্রুসেডে অংশগ্রহণকারী কিছু জবানী এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করে।William of Tyre (আনু. ১১৩০-১১৮৪) রচিত Historia Rerum in Paritbus Transmarinis Gestarum গ্রন্থটি ১০৯৪ থেকে ১১৮৪ সালের বিবরণী শোনায়। এতে তার যে পর্যবেক্ষণ, তা ছিলো তখনকার বাস্তবতায় অগ্রসর জ্ঞানকর্ম। নিকট থেকে দেখার ফলে তিনি মুসলিমদের সেই জীবন অঙ্কন করতে চেয়েছেন, যাতে তাদের জীবনকে কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। প্রাচ্যবাদী অনুসন্ধানে এ বই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে রয়েছে বাস্তবভিত্তিক প্রচেষ্টার স্বাক্ষর, যা তখনকার অনেক খ্রিস্টানের মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকবে। বস্তুত, এ সময়ে মুসলিম জীবন ও সমাজ যে কোনো বিবেচনায় পশ্চিমাদের চেয়ে ছিলো বিপুলভাবে অগ্রসর। ফলত আরব দুনিয়ায় আগত খ্রিস্টানদের একটি অংশ মুসলিম সভ্যতায় মুগ্ধ ও দীক্ষিত হবে, এ ছিলো স্বাভাবিক। অতএব আমরা দেখি, ক্রুসেডার লেখকের তরফে সালাউদ্দীন আইয়ুবীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল বিবরণ, যে সালাউদ্দীন ছিলেন ক্রুসেডের প্রধান প্রতিপক্ষ। wolfram von Eschenbash এর বিখ্যাত Parzifal I Willchalm গ্রন্থ ইসলামের সৌন্দর্যকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার প্রাচ্যবাদী স্মারক।

মুসলিম শাসনাধীন স্পেন ও সিসিলিতে এর দৃষ্টান্ত রয়েছে বিপুল। দ্বাদশ শতকে Godfrey Of Viterbo রচিত Universal Chronicle গ্রন্থ ব্যতিক্রমের এক উদাহরণ। ইসলাম ও মহানবী সা. প্রশ্নে এতে তার ভাষ্য হিংসাশ্রয়ী প্রচারের খপ্পরে পড়েনি। সত্যের প্রতি থাকতে চেয়েছে নিষ্ঠাবান। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে আর্চবিশপ Don Rodrigo Jimenez de Rada ছিলেন আরেক দৃষ্টান্ত। প্রাচ্যচর্চাকে তিনি সত্যচর্চার দৃষ্টিতে দেখতেন। বিশেষত ইসলামপ্রশ্নে। তার Historia Arabum গ্রন্থটি ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আরব ইতিবৃত্ত শুনিয়েছে। কিন্তু যেখানেই রোমান চার্চ ও প্রশাসন, ইসলামবৈরী রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠান, পাদ্রী ও সমাজপতিদের ঘৃণাত্মক নানা মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামবিচারকে শাসন করেছে, সেখানে সুস্থ ও ইতিবাচক ভাবধারা প্রত্যাখাত হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে খ্রিস্টবাদী আবেগকে ভুল পথে জোরদার করা হয় এবং এর কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করা হয় খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্যের প্রেরণা, যা ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে কেবল যথার্থ জ্ঞান আহরণকে বাধা দেয়নি, বরং এর ভেতর থেকে মাথা বের করেছে মুসলিমদের জাতিগত উচ্ছেদ, ইনকুইজিশন, দেশে দেশে নির্বিচারে মুসলিম গণহত্যা, তাদের দেশ দখল, সম্পদ ডাকাতি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ, তাদেরকে নিজেদের দ্বারা শাসিত হতে না দেয়া, তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-চৈন্তিক স্বাধীনতাহরণ, জ্ঞান ও মেধাসত্ত লুণ্ঠনসহ অগণিত বিপর্যয়কে বৈধকরণের ‘যুক্তি’!

সেই ধারা কি আধুনিক কালপর্বে গতি হারিয়েছে? মোটেও নয়। আজও সে নতুন রং, রূপ, মাত্রা ও চাতুর্যসহ পুরনো সেই মানসের চর্চা জারি রেখেছে সবলে, সদর্পে।

লেখক: কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা