ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৬ মাঘ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের বেলাগাম পুঁজিলুণ্ঠন

Daily Inqilab ড. মইনুল ইসলাম

১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম

আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত অনেকেই এখনো গলাবাজি করে চলেছেন যে, হাসিনা সরকারের সাড়ে পনেরো বছরে বাংলাদেশে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে। এসব গলাবাজি যারা করেন, তারা প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নন। শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল, সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্লাসিক উদাহরণ। ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনামলে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সাথে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনী তার পতনের পর উদ্ঘাটিত হচ্ছে। ৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আটশ’ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পনেরো লক্ষ আটান্ন হাজার দুইশ’ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চ-প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণ চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অংকের ঋণের সুদাসলের কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে।

হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগাপ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারাদেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগাপ্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশে^র সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজিলুণ্ঠনের মহোৎসবকাল। হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যার সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই পুঁজিলুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনাপুত্র জয়, রেহানাকন্যা টিউলিপ ও রেহানাপুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তার ভাই শেখ জুয়েল ও তার পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তার পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আর ছিল এস আলম, সালমান এফ রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে, দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্পব্যয় একান্ন হাজার কোটি টাকার বেশি। হাসিনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং অলিগার্ক ব্যবসায়ীরাই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের প্রায় সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চ-স্তরের নেতাকর্মী এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও গত সাড়ে পনেরো বছরে কোনো না কোনভাবে দুর্নীতি, পুঁজিলুণ্ঠন ও পুঁজিপাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ক্ষমতাসীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই দুর্নীতি ও পুঁজিলুণ্ঠনের বেলাগাম তৎপরতা শুরু করার জন্য আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের ও তার আত্মীয়-স্বজনদের সরাসরি আদেশ দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসার কয়েকদিন পর শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য ছিল, ‘বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদেরকে দু’হাতে টাকা বানাতে হবে’। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের পুত্র সোহেল তাজ সম্প্রতি হাসিনার এই মন্তব্যটির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তখন সোহেল তাজ ছিলেন হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি আরো বলেছেন যে, তার কয়েক মাসের দায়িত্ব পালনের পুরোটা সময়েই তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, তার মন্ত্রণালয়ের কোনে সিদ্ধান্তই তার কথামত নেয়া হতো না। হাসিনা নাকি বলে দিয়েছিলেন, সোহেল তাজের কথায় কান না দিতে। হাসিনার নির্দেশমত প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তেই নাক গলাতো হাসিনার কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত শেখ সেলিম। চরমভাবে হতাশ হয়ে ২০০৯ সালের মে মাসে সোহেল তাজ পদত্যাগ করেছিলেন।

অতি সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে দেড় লক্ষ কোটি টাকার বেশি লুট করেছে, তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান এফ রহমান নিজেও তার মালিকানাধীন বেক্সিমকোর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ছত্রিশ হাজার আটশ’ পঁয়ষট্টি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাকি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে নাকি তার আরো অনেক বাড়িঘর রয়েছে। জনমনে একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। পুরো ব্যাপারটিই এখন ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। হাসিনার পতিত সরকার ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পুঁজিলুণ্ঠন ও পুঁজিপাচারকে ছড়িয়ে দিয়ে হাসিনা উন্নয়নের এই ‘মিথ্যা বয়ান’ রচনা করেছেন, যার প্রকৃত রূপটি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিটির শে^তপত্রে ফুটে উঠেছে। ১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সরকারের কাছে জমা দেওয়া শে^তপত্রটির নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইতোমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। শে^তপত্রটির পূর্ণাঙ্গ অবয়ব এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি সাধারণ জনগণের। তবুও বলব, প্রকাশিত অংশগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, শে^তপত্রটি সত্যিকারভাবেই স্বৈরশাসক হাসিনার কথিত উন্নয়ন বয়ানের আড়ালে লুক্কায়িত ‘অবিশ^াস্য লুটপাটতন্ত্রের একটি নির্মোহ ব্যবচ্ছেদের দলিল’ হিসেবে দেশের ইতিহাসে স্থান করে নেবে।

বিশেষত, অজ¯্র ঋণ করার কৌশল পুরো জাতিকে যে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদী ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়েছে এজন্য যে, ঐ ঋণের সিংহভাগই ¯্রফে পুঁজিলুণ্ঠনের মাধ্যমে লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। হাসিনা আমলের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল পুঁজিপাচার। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দাবি করেছিল, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। গত ২ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছিলেন যে, গত দশ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় দেশ থেকে বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। শে^তপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইনেন্সিয়াল খাত, তারপর জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্য প্রযুক্তি খাত। শে^তপত্রে খাতওয়ারী লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত উদঘাটন করে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে। শে^তপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়াড়, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, হাসিনার আত্মীয়-স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলার-ডিলাররা’ এই লুটপাটতন্ত্রের প্রধান খেলোয়াড়। এই লুটেরারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারি রাজস্ব আহরণ বিভাগসমূহ ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগসমূহকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে এরা দুর্বল করে ফেলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামিয়েছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।

তাত্ত্বিকভাবে জিডিপি হলো: ভোগব্যয়+বিনিয়োগব্যয়+সরকারিব্যয়+রফতানিআয়-আমদানিব্যয়। বিনিয়োগ ব্যয় দেশের সঞ্চিত পুঁজি থেকে হয়েছে নাকি বৈদেশিক ঋণের অর্থে হয়েছে সেটা এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়, উভয় ক্ষেত্রেই জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য হয় না। তেমনিভাবে সরকারিব্যয় সরকারি রাজস্বের অর্থায়নে হয়েছে নাকি দেশীয় অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক ঋণের অর্থায়নে হয়েছে সেটাও জিডিপিতে সরকারিব্যয়ের অবদান নির্ধারণে তারতম্য সৃষ্টি করে না। হাসিনার সরকার গত সাড়ে পনেরো বছর ধরে যেনতেনভাবে অজ¯্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ করে বিনিয়োগব্যয় ও সরকারিব্যয় বাড়ানোর নীতি বাস্তবায়ন করে দেশের জিডিপি কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর ব্যবস্থা করায় আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর উচ্চস্তরে দেখানো যাচ্ছিল, যা প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন ছিল না। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার, যা অস্বাভাবিক গতিতে কমতে কমতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। বৈদেশিক ঋণ নেয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগব্যয় গত এক দশক ধরে জিডিপির অনুপাত হিসেবে ২৩/২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু বিশেষত সরকারিখাতে অজ¯্র ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থ ব্যয় করায় জিডিপি বেড়ে গেছে। সরকারি রাজস্ব আহরণ এদেশে কমতে কমতে জিডিপির শতাংশ হিসেবে ৮ শতাংশে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে প্রতি বছর সরকারিব্যয় বাড়ানোয় জিডিপি দ্রুত বেড়ে গেছে। ঋণ বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ালে তা জিডিপিকে বাড়িয়ে দেয়, সরকারিঋণ বাড়লে জিডিপি কমে না।

মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় মাথাপিছু জিডিপি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল যখন পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। তার নির্দেশে ঐ সময় থেকে ‘ডেটা ডক্টরিং’ এর সহায়তায় মোট জিডিপিকে বাড়িয়ে দেখানো এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো পরিসংখ্যান ব্যুরোর খাসলতে পরিণত হয়েছিল। পরিকল্পনা মন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে এহেন ‘ম্যানুফেকচারড’ তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। গত এক দশক ধরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে কাহিনী প্রচার করে হাসিনার সরকার দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল তার সিংহভাগই ছিল ভুয়া ও ভিত্তিহীন। দেশের রফতানি আয়কে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারকে সবসময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্যনিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়। দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহারকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একইসাথে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেটকে’ কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে প্রচার করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ অর্থ-বছরে রফতানিআয় আগের বছরে সরকার যতখানি দেখিয়েছিল তার চাইতে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সাবেক সরকার দাবি করলেও তা প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি। দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার হার ১৮ শতাংশে নেমে গেছে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি। আরো গুরুতর হলো, এই দারিদ্র্যহার টেকসই নয়। মাসে দু’দিন কাজ না পেলে দেশের দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায় বলে দাবি করেছে শে^তপত্র কমিটি।

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত চার মাসে অর্থনীতিবিদদের কাছে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়ে চলেছে যে, স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ক্ষমতা না হারালেও ‘অর্থনৈতিক মেল্টডাউনে’র অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারতেন না হাসিনা। এদিক থেকে দেখলে মহান আল্লাহতাআলাকে শোকরিয়া জানাতে হয় যে, তিনি আমাদের আরেকটি শ্রীলংকা হওয়ার লজ্জা থেকে রক্ষা করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়োচিত নীতি-পরিবর্তন ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে আবার গতি সঞ্চার করতে শুরু করেছে। কিন্তু, বিদেশে পাচার হওয়া ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (বা আরো বেশি) অর্থ আদৌ দেশে ফেরত আনা যাবে বলে আমি মনে করি না। বর্তমান সরকার রফতানিআয় এবং ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্সপ্রবাহের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু কয়েক লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পুঁজিপাচারকারীদের মাধ্যমে যে হারিয়ে গেলো সেটা জাতি কখনোই ফিরে পাবে না। বরং, যে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করে পাচারকৃত অর্থের মাধ্যমে হাসিনা, তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন, কয়েকজন অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং কয়েক হাজার অর্থপাচারকারী তাদের বাকি জীবন বিদেশে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারবে চিন্তা করলে মনের জ¦ালা কয়েকগুণ বেড়ে যায় বই কী!

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জিয়ার বাংলাদেশ
শহীদ জিয়ার বিএনপির সাথে কি আজকের বিএনপির মিল আছে?
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি
ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
আরও

আরও পড়ুন

সরকারের সমর্থন ছাড়া ব্যাংক লুটপাট করা সম্ভব হতো না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সরকারের সমর্থন ছাড়া ব্যাংক লুটপাট করা সম্ভব হতো না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

শিল্পে উৎপাদন খাতের অবদান কমেছে

শিল্পে উৎপাদন খাতের অবদান কমেছে

জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করলে রাজনীতির অধিকার হারাবে শিবির: ছাত্রদল

জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করলে রাজনীতির অধিকার হারাবে শিবির: ছাত্রদল

ভারতে কুম্ভ মেলায় পদদলিত হয়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু

ভারতে কুম্ভ মেলায় পদদলিত হয়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু

কারিগরির সাড়ে ৩ হাজার জনবল নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই

কারিগরির সাড়ে ৩ হাজার জনবল নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই

স্ত্রীসহ ইভ্যালির রাসেলের দুই বছরের কারাদণ্ড

স্ত্রীসহ ইভ্যালির রাসেলের দুই বছরের কারাদণ্ড

আদালতের পৃথক নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের দাবি বিচারকদের

আদালতের পৃথক নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের দাবি বিচারকদের

সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন সাশ্রয় হবে ৫শ’ থেকে ৭শ’ কোটি টাকা

সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন সাশ্রয় হবে ৫শ’ থেকে ৭শ’ কোটি টাকা

আওয়ামী লীগের অপকর্ম জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে :  নাসের রহমান

আওয়ামী লীগের অপকর্ম জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে : নাসের রহমান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে হত্যায়  ঘাতকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে হত্যায়  ঘাতকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

নেতারা 'পলাতক', কীভাবে হরতাল-অবরোধ পালন করবে আওয়ামী লীগ?

নেতারা 'পলাতক', কীভাবে হরতাল-অবরোধ পালন করবে আওয়ামী লীগ?

হায়ার পার্টনার্স মিট ২০২৫ এ ট্রিপল সম্মাননায় ভূষিত টিভি হাট

হায়ার পার্টনার্স মিট ২০২৫ এ ট্রিপল সম্মাননায় ভূষিত টিভি হাট

ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি পুনঃতদন্ত চেয়ে ঢাবি উপাচার্যকে স্মারকলিপি

ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি পুনঃতদন্ত চেয়ে ঢাবি উপাচার্যকে স্মারকলিপি

মস্কোর কাছে আসাদকে ফেরত চাইলেন আল-শারা

মস্কোর কাছে আসাদকে ফেরত চাইলেন আল-শারা

দেশের বাজারে আরো বাড়ল সোনার দাম

দেশের বাজারে আরো বাড়ল সোনার দাম

ভূমি ও নদী দখল

ভূমি ও নদী দখল

বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা  অর্জনে গুরুত্বারোপ রাবিডের সেমিনারে নেতৃবৃন্দ

বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বারোপ রাবিডের সেমিনারে নেতৃবৃন্দ

আইসিটি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

আইসিটি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চরমোনাইর পীরের দল

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চরমোনাইর পীরের দল

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ সদস্যের দল

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ সদস্যের দল