ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৬ মাঘ ১৪৩১

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যার মর্মমূলে স্বাধীন জাতিসত্তার চেতনা

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম

নতুন বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার স্বপ্নেরা ওড়ে ওড়ে এবারের বিজয় দিবস এনেছে। ৫ অগাস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর জাতির বুকের উপর থেকে অপসারিত হয়েছে। ভারতের পদলেহী তাবেদার হাসিনা জনরোষের শিকার হয়ে দুপুরে পাতে ভাড়া ভাত রেখে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তার প্রভুদেশ ভারতে। ফলে জাতি দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করেছে, দীর্ঘদিনের স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পেয়েছে, নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় হয়েছে। শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ ও জাতিকে ভারতের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন কেউ ভাবতে পারেনি চোখের পলকে তার আশা-ভরসা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে।

১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ ও রাম-বামরা স্বাধীনতার চেতনার দোহাই দিয়ে দেশ ও জাতিকে ভারতের গোলামীতে বন্দি করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু স্বৈরাচার চিরদিন স্থায়ী হয় না, নমরূদ-ফেরাউনদের পতন অনিবার্যÑ এই সত্যটি শেখ হাসিনার বেলায় কীভাবে আবার প্রমাণিত হলো, তা নতুন প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেল।

৭১-এর স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন দল দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা ও প্রত্যাশার বিষয়ে তারা দ্ব্যর্থহীন বিশ্বাসে বলিয়ান হতে পারেনি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে হলে জাতিকে স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনায় উজ্জীবিত করতে হবে। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ ও চার মূলনীতিতে পরিবর্তন এনে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘মহান আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাসকে সবকিছুর মূল’Ñ এ কথা সংযোজন করে বাংলাদেশী পরিচয়ে স্বাধীন জাতিসত্তার সৌধমালা রচনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিচ্ছিন্নতাবাদের পরিণতি আগাম আঁচ করতে পেরে পাহাড়ে পাহাড়ে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও বাঙালিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ছিল স্বতন্ত্র জাতিসত্তা রচনার তার সেই উদ্যোগের অংশ। পরবর্তী জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর উপলব্ধি করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে একটি স্বতন্ত্র চেতনা ও আদর্শের উপর জনগণকে উজ্জীবিত করতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংযোজন করেন। কিন্তু তার সেই উপলব্ধি থেকে তিনি সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করলেও তাকে বাস্তব রূপ দেয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। স্পষ্ট বলতে পারেননি যে, বাংলাদেশ নামক ভূখ-টিকে স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকিয়ে রাখতে হলে মদীনা সনদের আদলে জনগণের বোধ, বিশ্বাস ও ঐতিহ্য চেতনার আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। সবচে দুর্ভাগ্য হলো, কোনো নেতা তার উপলব্ধির মর্মবাণী বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ফলে তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ধারণা ছিল, দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় নষ্ট সিনেমা ও বস্তুতান্ত্রিক প্রচারণা ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবে নতুন প্রজন্ম জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে দুনিয়া দেখেছে, আমাদের ছেলেরা-মেয়েরা নিজস্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস, ধর্মীয় চেতনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজেয় মনোবল থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। আজ নতুন প্রজন্মের চোখেমুখে ঝিলিক দিচ্ছে স্বাধীনতার শাশ্বত প্রত্যাশা ও স্বপ্নের দ্যুতি। তাদের প্রত্যাশার স্বরূপ সন্ধান করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসের দিকে। কারণ, ‘৪৭ সালের ভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা-চৌহদ্দির উপরই বর্তমান বাংলাদেশের বিশ্বমানচিত্র দাঁড়িয়ে আছে। সেই সময় এই ভুখ-ের মানুষ যে স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও চেতনা লালন করেছিল তা পূরণ না হওয়ার কারণেই বারবার রক্তের নজরানা পেশ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। এই হিসাব মিলানো একেবারে সোজা।

তখনকার বঙ্গদেশ বা বৃহত্তর বাংলা দুইভাগ হয়ে একভাগ পশ্চিমবঙ্গ নামে এখন ভারতের অঙ্গরাজ্য। পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সত্তায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তবে উভয় খ-ের ভূপ্রকৃতি অভিন্ন, মানুষের চেহারা, গায়ের রং, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও মুখের ভাষায় উভয় বঙ্গের মানুষকে আলাদাভাবে চেনা অসম্ভব। এরপরও আমরা পরস্পর থেকে পৃথক এবং আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের কাছে স্বাধীনতা দুগ্ধপোষ্য শিশুর কাছে মায়ের কোলোর মতো প্রিয়তম।

নিশ্চয়ই বাংলাদেশ আমাদের এবং এখানে আমাদের একটি নিজস্বতা আছে। এখানে এমন একটি জিনিস, এমন এক মহাসম্পদ আছে, যা হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমরা আতঙ্কিত, আমাদের নতুন প্রজন্ম উদ্বিগ্ন আর ভারত তা ছিনিয়ে নেয়া বা ধ্বংস করার জন্য হরেক রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেই জিনিস, সেই সম্পদ হলো আমাদের নিজস্বতা, স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। অন্যকথায় আমাদের বিশ্বাস, আমাদের মুসলমানিত্ব। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আচরিত জীবনবোধ আমাদের দিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান মুসলিম দেশ হিসেবে গর্বিত পরিচয়।

এই পরিচয়ের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে হলে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসের আরো পেছনে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীন নবাব, নবাব সিরাজুদ্দৌলার পলাশির প্রান্তরে পরাজয়ের নেপথ্যে মীরজাফরের সঙ্গে জগতশেঠ, উর্মিচাঁদরা কী ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তা পড়তে হবে। রাজ্যহারা মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের হাতে চরমভাবে নিপীড়িত হওয়ার পর খোদ ইংরেজরাই পূর্ব বাংলার মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিল। এখানকার মুসলিম প্রজা ও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন পাস করেছিল। তাতে রাজধানীর মর্যাদা পেয়েছিল ঢাকা। কিন্তু কলিকাতার হিন্দু বাবুদের তা সহ্য হয়নি। কলিকাতায় বসে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শোষণের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে তারা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ বা প্রত্যাহার করার জন্য সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা বাধ্য হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করে ১৯১১ সালে। নিপীড়িত বঞ্চিত মুসলমানদের সান্ত¦না দেয়ার জন্য ইংরেজরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনও রবিন্দ্রনাথসহ কলকাতার হিন্দু বাবুরা চরম বিরোধিতা করেন।

মূলত ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বৃটিশ আমল থেকে লালিত স্বাধীনতার চেতনা ও প্রত্যাশার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সত্যিই আমাদের আজকের ছাত্র নেতারা আমাদের স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাসের নতুন নির্মাতা। তাদের জন্য আমাদের প্রাণউজাড় করা ভালোবাসা।

নতুন বাংলাদেশে যারা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন তাদের অনেকের ব্যাপারে জনগণের আপত্তি আছে। এরপরও জনগণ প্রত্যাশা করে, বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার সংস্কার ও আগামী দিনের সঠিক পথ প্রদর্শনে সফল হবে। আমরা তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও জিয়ার বাংলাদেশ
শহীদ জিয়ার বিএনপির সাথে কি আজকের বিএনপির মিল আছে?
জিয়াউর রহমানের রাজনীতি
ফিরে দেখা রাজশাহী ২০২৪
বিচারবিভাগ ওলটপালটের বছর
আরও

আরও পড়ুন

সরকারের সমর্থন ছাড়া ব্যাংক লুটপাট করা সম্ভব হতো না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সরকারের সমর্থন ছাড়া ব্যাংক লুটপাট করা সম্ভব হতো না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

শিল্পে উৎপাদন খাতের অবদান কমেছে

শিল্পে উৎপাদন খাতের অবদান কমেছে

জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করলে রাজনীতির অধিকার হারাবে শিবির: ছাত্রদল

জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করলে রাজনীতির অধিকার হারাবে শিবির: ছাত্রদল

ভারতে কুম্ভ মেলায় পদদলিত হয়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু

ভারতে কুম্ভ মেলায় পদদলিত হয়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু

কারিগরির সাড়ে ৩ হাজার জনবল নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই

কারিগরির সাড়ে ৩ হাজার জনবল নিয়োগে কোনো বাঁধা নেই

স্ত্রীসহ ইভ্যালির রাসেলের দুই বছরের কারাদণ্ড

স্ত্রীসহ ইভ্যালির রাসেলের দুই বছরের কারাদণ্ড

আদালতের পৃথক নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের দাবি বিচারকদের

আদালতের পৃথক নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের দাবি বিচারকদের

সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন সাশ্রয় হবে ৫শ’ থেকে ৭শ’ কোটি টাকা

সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন সাশ্রয় হবে ৫শ’ থেকে ৭শ’ কোটি টাকা

আওয়ামী লীগের অপকর্ম জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে :  নাসের রহমান

আওয়ামী লীগের অপকর্ম জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে : নাসের রহমান

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে হত্যায়  ঘাতকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে হত্যায়  ঘাতকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

নেতারা 'পলাতক', কীভাবে হরতাল-অবরোধ পালন করবে আওয়ামী লীগ?

নেতারা 'পলাতক', কীভাবে হরতাল-অবরোধ পালন করবে আওয়ামী লীগ?

হায়ার পার্টনার্স মিট ২০২৫ এ ট্রিপল সম্মাননায় ভূষিত টিভি হাট

হায়ার পার্টনার্স মিট ২০২৫ এ ট্রিপল সম্মাননায় ভূষিত টিভি হাট

ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি পুনঃতদন্ত চেয়ে ঢাবি উপাচার্যকে স্মারকলিপি

ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি পুনঃতদন্ত চেয়ে ঢাবি উপাচার্যকে স্মারকলিপি

মস্কোর কাছে আসাদকে ফেরত চাইলেন আল-শারা

মস্কোর কাছে আসাদকে ফেরত চাইলেন আল-শারা

দেশের বাজারে আরো বাড়ল সোনার দাম

দেশের বাজারে আরো বাড়ল সোনার দাম

ভূমি ও নদী দখল

ভূমি ও নদী দখল

বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা  অর্জনে গুরুত্বারোপ রাবিডের সেমিনারে নেতৃবৃন্দ

বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বারোপ রাবিডের সেমিনারে নেতৃবৃন্দ

আইসিটি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

আইসিটি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চরমোনাইর পীরের দল

গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চরমোনাইর পীরের দল

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ সদস্যের দল

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ সদস্যের দল