ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

দুই দশকের বেশি সময় আগে, সন-তারিখ মনে নেই। একদিন সহকর্মী ইউসুফ ভাই (ইউসুফ শরীফ, সাংবাদিক, কথাশিল্পী) বললেন, ফুলতলী যাবেন? হঠাৎ তার এ প্রস্তাবে কিছুটা হতচকিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন, কোনো উপলক্ষ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, উপলক্ষ একটা আছে। কী সেই উপলক্ষ, জানতে চাইলে ইউসুফ ভাই বললেন, ‘ছাহেব কিবলাহ’র প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’ বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কিত বিষয়ে কয়েকদিনের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আপনি গেলে আপনাকে অন্তত দুটি বিষয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। কোনো কিছু না ভেবেই তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

সিলেটের প্রান্তিক থানা জকিগঞ্জের বিখ্যাত ফুলতলী গ্রাম, সেই গ্রামের বিখ্যাত ‘ছাহেব বাড়ি› সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি ইউসুফ ভাইসহ অনেকের মুখে। সবচেয়ে বেশি শুনেছি যার কথা, তিনি হলেন, হযরত আল্লামা মো. আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.)। তিনি ‘ফুলতলীর পীর ছাহেব’, ‘ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী’ কিংবা শুধুই ‘ছাহেব কিবলাহ› নামে সাধারণ্যে খ্যাত ও পরিচিত। তিনি প্রচলিত অর্থে পীর নন, তার চেয়েও অধিক। এক ব্যতিক্রমী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, মানবমুক্তির অনন্যসাধারণ দিশারি, মানবসেবা ও মানবকল্যাণে বিরল নজির সৃষ্টিকারী এক মহাপুরুষ। তার কথা, তার প্রশংসা এত মানুষের কাছে শুনেছি যে, তাকে এক নজর দেখার কিছুটা সান্নিধ্য লাভ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে লালন করতাম। ইউসুফ ভাইয়ের প্রস্তাব ও আমন্ত্রণ সে আকাক্সক্ষা পূরণ সহজ ও সম্ভব করে দেবে, এই চিন্তা থেকেই রাজি হওয়া। জিজ্ঞেস করলাম, আর কে কে যাবেন? ইউসুফ ভাই বললেন, আমি, আপনি আর হারিস ভাই (হারিস উদ্দিন, খ্যাতিমান ফটো সাংবাদিক)।

নির্দিষ্ট দিনে দুপুরের পরপরই আমরা ফুলতলী পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট। সিলেট থেকে ফুলতলী। সিলেট গিয়েই আমরা হাওলা হয়ে গিয়েছিলাম ছাহেব কিবলাহর ছোট ছেলে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর। তাদের পারিবারিক গাড়িতে তিনিই পথপ্রদর্শক। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি। যখন ছাহেব বাড়িতে পৌছলাম, দেখলাম ইলাহী কাণ্ড। চারদিকে গিজ গিজ করছে মানুষ। মনে হলো, যেন কোনো উৎসব। একটি কামরায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, যা আগেই আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা ছিল। আমরা তিনজনই কামরায় ঢুকে কিছুক্ষণ যে যার মতো বসে যখন কাপড় বদলানোর আয়োজন করছি, ঠিক তখনই কামরায় প্রবেশ করলেন এক সৌম্যদর্শন, আলোকস্তম্ভস্বরূপ বর্ষীয়ান পুরুষ। ইউসুফ ভাই ‘ছাহেব কিবলাহ’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। তিনি আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, বললেন, বাবারা, আপনাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। এখন খাওয়া-দাওয়া করুন, বিশ্রাম নিন। আমি বিশেষ প্রয়োজনে এখন সিলেট যাচ্ছি, তাই বলতে এলাম। ফিরে এলে কথাবার্তা হবে। শুরুতেই এক বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। প্রথমত, এমন সুপুরুষ, সৌন্দর্যবান পুরুষ, নূরানী পুরুষ, এমন মনোহর, দৃষ্টিআকর্ষণকারী, মুগ্ধকর মানুষ এর আগে চোখে পড়েনি। যেন চোখ জুড়িয়ে গেল! দ্বিতীয়ত, তার কাছে আমরা কিছুই নই। তার কাছেই আমাদের আগে যাওয়ার কথা। অথচ সে সুযোগ না দিয়েই তিনিই এলেন আমাদের কাছে। এ রকম মহানুভব, মেহমাননেওয়াজ, সদাচারী মানুষ দুর্লভ বললেও কম বলা হয়। তিনি চলে গেলেন। আমরা তিনজন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম। আমাদের ভেতরে তখন চলছে তোলপাড়। প্রকৃতিস্থ হতে লেগে গেলো আরো কিছু সময়। এর পর অবশ্যই আমাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে গেল ছাহেব কিবলাহ।

রাতেই আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, ছাহেব কিবলাহর সঙ্গে আমরা কিছুটা সময় একান্তে কাটাবো। তার কথা তার মুখে শুনবো। তিনি তার জীবনস্মৃতির পাতা উল্টাবেন, আমরা দেখবো। হারিস ভাই তুলবেন ছবি। সেই মতে, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার অনুষ্ঠানসূচির ফাঁকে এক সকালে তার সান্নিধ্যে উপনীত হলাম। তার কাছে শুনতে চাইলাম তার জীবনের কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ। তার বিশাল জীবন, বর্ণাঢ্য জীবন, সংগ্রামী জীবন, কোথা থেকে কী বলবেন তিনি? আমাদের অনুরোধ ফেললেন না। তার শিক্ষা জীবনের কিছু ঘটনা বর্ণনা করলেন। বললেন, তিনি তখন তার উস্তাদ ও মুরশিদ হযরত মাওলানা আবু ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরীর তত্ত্বাবধানে বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা শেষ করেছেন। কি করবেন ভাবছেন। এমন সময় করিমগঞ্জে তার এক সম্পর্কিত ভাই তাকে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দিলেন। তিনি সে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং ব্যবসা শুরু করলেন। বিভিন্ন ব্রিটিশ কোম্পানির পণ্যের হোলসেলের ব্যবসা কিছুদিনের মধ্যেই জমে উঠলো। লাভও বেশ ভালোই হতে লাগলো। কয়েক মাসেই একেক জনের ভাগে কয়েক হাজার টাকা লাভ হয়ে গেলো। একদিন হযরত বদরপুরী ছাহেব তাকে তলব করে বললেন, ব্যবসা তোমার কাজ নয়। তোমার অন্য কাজ আছে। তোমাকে আরও লেখাপড়া করতে হবে, উচ্চ শিক্ষা নিতে হবে। রামপুরে যাও। মুরশিদের নির্দেশ যথা আজ্ঞা করে ব্যবসা ছেড়ে দিলেন তিনি। এমনকি লাভের ভাগও নিলেন না। প্রস্তুতি নিলেন রামপুর যাওয়ার।

তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামপুরের মাদরাসায়ে আলিয়ায় ভর্তির জন্য যাবেন তিনি। সব কিছুই তার অজানা-অচেনা। শুনেছিলেন, ওই মাদরাসায় সিলেটের একজন ছাত্র পড়েন। ভাবলেন, তার কাছেই প্রথমে যাবেন। ভর্তি ও ছাত্রাবাসে থাকার ব্যাপারে তার সহায়তা নেবেন। মাদরাসায় পৌছে তার দেখা পেলেন বটে, তবে ছাত্রাবাসে থাকার ব্যাপারে তিনি কোনো সহায়তা করতে পারলেন না। কি করবেন, কোথায় থাকবেন, এই ভাবনায় তখন তিনি কিছুটা বিচলিত। সিদ্ধান্ত নিলেন আশপাশের মহল্লায় কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া গেলে, নেবেন। বাসা খুঁজতে শুরু করলেন। এমন সময় এক মহল্লার মসজিদে মাগরিবের আজান হলো। তিনি নামাজ পড়তে গেলেন। গিয়ে দেখলেন, ইমাম সাহেব কী কারণে যেন অনুপস্থিত। একজন বয়স্ক মুসল্লি এগিয়ে এসে তাকেই ইমামতি করতে বললেন। তিনি নামাজ পড়ালেন। নামাজ শেষে যখন বেরিয়ে আসছেন তখন সেই মুসল্লি এগিয়ে এসে তার খোঁজ-পরিচয় নিলেন। তখন তার কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি। বাসা ভাড়া পাওয়ার ব্যাপারে তার সহায়তা চাইলেন। ভদ্রলোক বললেন, তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনি আমার বাসাতেই থাকবেন। আমার সন্তানদের কোরান শিক্ষা দেবেন। আপনার কোরান পাঠ আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভদ্রলোকের এ অনুরোধ তিনি এড়াতে পারলেন না। সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য তার অর্থের অভাব ছিল না। তার ম্যানেজারকে তিনি বাড়িতে থাকতেই বলে গিয়েছিলেন প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা পাঠাতে।

যথারীতি তিনি তার বাসায় গিয়ে উঠলেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। তিনি ভর্তি হলেন। কিছুদিনের মধ্যে বাড়তি কিছু আয়ের ব্যবস্থাও হয়ে গেল। মহল্লায় বিভিন্ন বয়সী আরও কিছু ছাত্র তিনি পেয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের সম্মানীও পেতে থাকলেন।

তিনি বললেন : বাড়ি থেকে ম্যানেজারের পাঠানো টাকা এবং ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া সম্মানীর টাকা খরচের জায়গা না থাকায় জমতে থাকলো। কি করবেন এই টাকা দিয়ে? খরচের পথও বের করলেন। মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে যাদের অভাব ছিল, কেতাবাদি কেনার সঙ্গতি-সামর্থ্য ছিল না, তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে থাকলেন।

এ পর্যন্ত বলার পর ছাহেব কিবলাহ কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে পড়লেন। এই সুযোগে হারিস ভাই তার ছবি তোলার উদ্যোগ নিলেন। তার কাছে তখন দুটি ক্যামেরা। একটি দামি, উন্নতমানের। অন্যটি কম দামি, সাধারণ। দামি ক্যামেরাটি দিয়ে ছবি তুলতে গেলেন, তুলতে পারলেন না। ফের চেষ্টা করলেন, কিছুই হলো না। দ্বিতীয়টি দিয়ে তুলতে গেলেন, দেখলেন সেটিও বিকল। শত চেষ্টা করেও বিখ্যাত এই ফটো সাংবাদিক তার প্রিয় ক্যামেরা দুটি দিয়ে একটি ছবিও তুলতে পারলেন না। আমরা বিস্মিত ও হতবাক। তখন অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, ছাহেব কিবলাহর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাওয়ার আর সম্ভব হলো না। তিনিও ভক্ত, অনুরাগী, দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা অন্য কোনো জরুরি কাজের জন্য বললেন, এখন থাক। আমরাও আর কিছু বললাম না। ফিরে এলাম আমাদের নির্ধারিত কামরায়। হারিস ভাই ক্যামেরা দুটির ব্যাপারে যারপরনেই বিরক্ত। বারবার ঝাকাঝাকি করছেন, কেন এমন হলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ দেখা গেলো, ক্যামেরা দুটি সচল হয়ে গেছে। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। আগের মতই ছবি উঠছে। হারিস ভাই ও আমাদের তখন বিস্ময়ের অবধি নেই। ঘটনা শুনে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী শুধু বললেন, ছাহেব কিবলাহ ছবি তোলা পছন্দ করেন না।

ছাহেব কিবলাহর ব্যস্ততা এবং আমরা যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম সে কাজে সময় দেয়ার কারণে তার সঙ্গে আর ওই ‘বৈঠকী আলোচনা› করার সুযোগ হয় না। এ আফসোস এখনো রয়েছে। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে আসার পর আর কখনো তার নিকট সান্নিধ্য উপভোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ঢাকায় এলে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। তবে একান্তে কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি। এত মানুষ তার পাশে সব সময় ভীড় করে থাকতো যে, তাকে একা পাওয়া সম্ভব হতো না। বহুবার ফুলতলী যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে। নানা কারণে সে ইচ্ছাও পূরণ হয়নি। এরপর তিনি তো চলেই গেলেন। এখনো তিনি স্মৃতিতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন। তাকে একবার যিনি দেখেছেন, তার পক্ষে কি তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব? এখনো মাঝে-মধ্যে তার অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রফেসর মাওলানা সালাহ উদ্দীন তার সম্পর্কে লিখেছেন : ‘তার চেহারা মুবারকে এত নূর ছিল যে, দেখে স্বাদ মিটতো না। আর সবুজ পাগড়ী যখন পরতেন, যেন আরও ভালো লাগতো। তিনি এমনিতেই ছিলেন নূরানী মানুষ, পাগড়ী পরলে আরো সুন্দর লাগতো। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। মনে হত, দেখি আরো দেখি।› কবি আল মাহমুদ তার এক কবিতায় বলেছেন :

মানুষকে ভালোবাসার নামই ইসলাম
একদিন একথা আমাকে বলেছিলেন
হুজুর ফুলতলী।
বড়ই ভালো লেগেছিল তাঁর কথা আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম
কী সুন্দর সৌম্য শান্ত চেহারা।
এখন এ ধরনের মানুষ কমে এসেছে
কার কাছে যাই?
তিনি হৃদয়ের ভেতরে আমাকে ধ্যানের
আসর বসাতে পরামর্শ দিয়েছেন
ধ্যান কি? আল্লাহকে কল্পনা করা।
আজকাল এসব মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যায় না
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই আমি
সেই পবিত্র মুখছবি দেখতে পায়।

দুই
ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী দীর্ঘ জীবনের অধিকারী ছিলেন। ১৯১৩ সালে জন্ম। জন্মস্থান ফুলতলী। ইন্তেকাল ২০০৮ সালে, সিলেট শহরের সুবহানীঘাটস্থ নিজ বাসভবনে। অন্তিম শয়ানস্থল ফুলতলী ছাহেব বাড়ির জামে মসজিদের উত্তর পাশে। তার প্রায় শতবর্ষের এই জীবন ছিল অত্যন্ত কর্মমুখর। তিনি তার জীবনকালে এত কাজ করেছেন যে সংক্ষিপ্ততম বিবরণ দেয়াও এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। অনুপুঙ্খ বর্ণনা ও বিবরণ দিতে গেলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে। বহু উৎসের তিনি ছিলেন সফল উত্তরাধিকারী। হযরত শাহ জালাল (র.)-এর সঙ্গে আগত ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম শাহ কামাল (র.)-এর বংশের অধঃস্থন পুরুষ বিশিষ্ট বুযুর্গ হযরত শাহ আলী বখশ (র.) ছিলেন তার পূর্বপুরুষ। তার পিতা মুফতি মাওলানা আবদুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন আসাম-বাংলার বিখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ। তিনি আজীবন শিক্ষকতাসহ দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত থাকেন।

ছাহেব কিবলাহর উস্তাদ ও মুরশিদ হযরত আবু ইউসুফ শাহ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী ছিলেন হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী (র.)-এর ছাহেবজাদা ও খলিফা হযরত হাফিয আহমদ জৈনপুরী (র.)-এর খলিফা। হযরত মাওলানা কারামত আলী (র.)-এর ঊর্ধ্বমুখী পীর পরম্পরায় দেখা যায় তিনি ছিলেন হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ব্লেলভী (র.)-এর খলিফা। তার মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র.) তার পিতা ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ আহমদ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) এবং তাঁর পিতা ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ আবদুর রহীম দেহলভী (র)।

ছাহেব কিবলাহ ছাত্রকালেই তরীকতের বায়াত হন এবং মাত্র ১৮ বছর বয়সে খেলাফত লাভ করেন। তিনি তাঁর মুরশিদের কাছে পাঁচ তরীকায় বায়াত হন। এই পাঁচ তরীকা হলো : চিশতীয়া, কাদিরিয়া, নকশ বন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া ও মুহাম্মদীয়া। তিনি ছিলেন এই পাঁচ তরীকায় প্রতিনিধি। তরীকতের বিশিষ্ট এই পাঁচটি ধারা তাঁর মধ্যে একাত্ম ও মিলিত হয়েছে। এই সব উত্তরাধিকারের পাশাপাশি তিনি লাভ করেছিলেন তার বিখ্যাত বিখ্যাত উস্তাদগণের উত্তরাধিকার। বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় পড়ার সময় তিনি তার উস্তাদ ও মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.)-এর কাছে ইলমে কেরাতে তালিম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত কারী হযরত মাওলানা হাফিয আবদুর রউফ করমপুরী শাহবাজপুরীর কাছে ইলমে কেরাত শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরও পরে মক্কা শরীফ গমন করে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারী শায়খুল কুবরা হযরত আহমদ হিযাযী (র.)-এর কাছে কেরাত শিক্ষা ও সনদ লাভ করেন।

রামপুরের মাদরাসায়ে আলিয়ায় উচ্চশিক্ষা সমাপণ করে ছাহেব কিবলাহ ইলমে হাদিসের শিক্ষা গ্রহণের জন্য মাতলাউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে হাদিসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন, সনদ লাভ করেন। ছাহেব কিবলাহর শিক্ষা জীবনের এই অতি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, তার শিক্ষার বিষয় ও লক্ষ্য ছিল ইলমে তরিকত, কোরআন ও হাদিস। দেখা গেছে, গোটা জীবন তিনি এই তিনটি বিষয়ের চর্চা প্রসার ও শিক্ষাদানে অতিবাহিত করে গেছেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মোহনাতুল্য। বিভিন্ন নদীর স্রোতধারা মোহনায় এসে মিলিত হয়ে সম্মিলিত স্রোতধারা হিসাবে পতিত হয় সাগরে। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে, সাফল্যের সঙ্গে মোহনার ভূমিকা পালন করে গেছেন। এর পাশাপাশি চিন্তাশীল ও সচেতন মানুষ হিসাবে সহৃদয়, মানবকল্যাণকামী মানুষ হিসাবে সেবা ও কল্যাণ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে কখনোই তিনি কুণ্ঠিত ও পিছপা হননি। রাষ্ট্রশক্তির বা অন্য কারো তোয়াক্কা করেননি। তিনি ছিলেন এক অকুতভয় মর্দে মুজাহিদ। ছাহেব কিবলাহ তার কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। আর সারা জীবনই এই শিক্ষকতা অব্যাহত রাখেন। তার শিক্ষকতার প্রধান বিষয় ছিল তিনটি : ইলমে তরীকত, ইলমে কেরাত এবং ইলমে হাদিস। ১৯৪৬ সালে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত হাদিস শিক্ষাদান করেন। এর পর যথাক্রমে গাছবাড়ী জামেউল উলুম আলিয়া মাদরাসা, সৎপুর আলিয়া মাদরাসা ও ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে ইলমে হাদিস শিক্ষা দান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় সপ্তাহে দুদিন কামিল জামাতে বুখারীশরীফের দরস দিতেন।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ইলমে কেরাত শিক্ষা দান শুরু করেন ১৯৫০ সালে ফুলতলীর নিজ বাড়িতে। পরবর্তীতে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট গঠন করেন। ট্রাস্টের নামে ৩৩ একর জমি ওয়াকফ করে দেন। এই ট্রাস্টের অধীনে দেশে-বিদেশে অন্তত দেড় হাজার কেন্দ্রে ইলমে কেরাতের শিক্ষাদান চলছে। তরীকতের শিক্ষক হিসাবে তিনি কেমন ছিলেন সে বিষয়ে তার মুরিদ ও খলিফারাই উত্তম সাক্ষ্য দিতে পারেন। দেশে-বিদেশে তার লাখ লাখ মুরিদ, অনুসারী ও ভক্তের। আমল-আখলাক, আচার-স্বভাব ইত্যাদি দেখে সহজেই বুঝা যায়, এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক ও রাহবার। তাকে অভিহিত করা হয় ‘আধ্যাত্মিক শিক্ষক’, ‘শরীয়ত, তরীকত ও মারেফতের আফতাব’, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক›, তাসাউফের আকাশে নক্ষত্র›, ‘ওলীয়ে কামেল’, ‘বুযুর্গ’ ও ‘সুফী’ ইত্যাদি হিসাবে।

ছাহেব কেবলাহ দেশে-বিদেশে বহু মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তার অনুপ্রেরণায় ও নির্দেশে ভক্ত - মুরিদরাও দেশে-বিদেশে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ফুলতলীর ছাহেব বাড়িকে কেন্দ্র করে মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ছাহেব বাড়িকে রীতিমত ‘সাম্রাজ্য’ বলা যায়। তার অবর্তমানে তার সুযোগ্য সন্তানগণ ও নাতিরা তা সফলভাবে পরিচালনা করছেন। তার প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো : দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, লতিফিয়া এতিমখানা, হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা, লতিফিয়া কমপ্লেক্স, মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে মাদারিছে আরাবিয়া, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে সংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ, ছাত্রদের সংগঠন বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া প্রভৃতি। তার নির্দেশ ও প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ড, মুসলিম হ্যান্ডস প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। দেশের মতো বিদেশেও বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন কিংবা তার নির্দেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এখনো সেসব প্রতিষ্ঠান সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো : যুক্তরাজ্যভিত্তিক দারুল হাদীস লতিফিয়া, আঞ্জুমানে আল ইসলাহ ইউকে, লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে, লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে, আল ইসলাম ইয়ুথ ফোরাম, কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আল মজিদিয়া ইভনিং মাদরাসা, লতিফিয়া গার্লস মাদরাসা ইত্যাদি। তার নির্দেশ ও প্রেরণায় তার মুরিদ ও অনুসারীরা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরের গড়ে তুলেছেন মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশেও তার নির্দেশ ও প্রেরণায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়েছে।

ছাহেব কিবলাহ ছিলেন ইনসানে কামেলির প্রতিকৃতি। জীবনের এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই যেখানে তার হস্ত ও আধ্যাত্মিক স্পর্শ পড়েনি। যেখানেই তিনি স্পর্শ করেছেন সেখানেই সফলতা তার পায়ে লুটিয়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে। তিনি তার কালে ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ প্রচারক ছিলেন। তরীকত-তাসাউফের সুধা বিতরণের মাধ্যমে তিনি অসংখ্য মানুষকে প্রকৃত জীবন উপভোগের উপযুক্ত করে দিয়েছেন ও জীবনের দিশা দিয়ে ধন্য করেছেন। কোরআন-হাদিসের খিদমত করেছেন। সেবা ও কল্যাণের হাত বাড়িয়ে মানুষের খিদমত করেছেন। অনেকেরই জানা নেই, তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান কবি, গবেষক ও লেখক। তার রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটি হলো : আত তানভীর আলাত তাফসীর, মুন্তাখাবুস সিয়র আনোয়ারুস ছালিকিন, আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া, নালায়ে কলন্দর, আল কাউলুছ ছাদীদ।

কেমন মানুষ ছিলেন ছাহেব কিবলাহ? তার মতো সজ্জন, বিনয়ী, স্বল্পভাষী, সহৃদয়, স্নেহবৎসল, সদাচারী, মানবহিতৈষী মানুষ বিরল, এ কথা বলেছেন সবাই। মানবিক সকল গুণের সমাহার ছিল তার চরিত্রে। তিনি ছিলেন, সুন্নাতে রাসূল (সা.) এর পরিপূর্ণ অনুসারী। প্রতিটি কাজেকর্মে তিনি রাসূল (সা.)কে অনুসরণ করতেন। তার রাসূল (সা.)প্রীতি ছিল কিংবদন্তী তুল্য। তিনি সপ্তাহের অন্তত পাঁচ দিন দাওয়াত ও অন্যান্য কর্মে অতিবাহিত করতেন। দু›দিন থাকতেন পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্যে। এই সময়টার ও একাংশ তিনি মুরিদ, ভক্ত ও অনুরাগীদের সাক্ষাতে ব্যয় করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন, যা কিছু করতেন, বলতেন সবক্ষেত্রেই রাসূল (সা.) এর প্রসঙ্গ উঠে আসতো। তিনি নিজে যেমন রাসূল (সা.)কে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতেন, তেমনি তাঁকে অনুসরণ করার কথা বলতেন সবাইকে। রাসূল (সা.) এর প্রতি তার অনুরাগ, ভক্তি ও মহব্বত কত প্রগাঢ় ছিল, তার কাব্যগ্রন্থ নালায়ে কলন্দরের এই দু›টি লাইন উদ্ধৃত করলেই সম্যক উপলব্ধি করা যাবে। লাইন দু›টি এই :

‘নবীজীর পদধূলি হোক সুরমা এই দু’চোখে
মনের যত কালিমা ঘুচুক জিয়ারত আলোকে।’

শুধু রাসূল (সা.) এর প্রতি নয়, তার বংশধর বা আহলে বায়তের প্রতিও ছিল ছাহেব কিবলাহের অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান। রাসূল (সা.) এর বংশধরদের, যারা সৈয়দ উপাধিতে ভূষিত, কোথাও দেখা পেলেই তিনি বিচলিত হয়ে যেতেন। তাদের কোথায় স্থান দেবেন, কিভাবে সেবা করবেন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন দিতেন উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা। তার ছোট ছাহেবজাদা মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর কাছে এ সম্পর্কে অনেক কাহিনী শুনেছি। তিনি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছেন। ওই নিবন্ধে তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন : ‘তিনি সায়্যিদগণকে মহব্বত ও সম্মান করাকে নবী করিম (সা.) এর মহব্বত লাভের ওসিলা মনে করতেন। এ কারণে তাদের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন তিনি। হযরত সায়্যিদ নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (র.) এর বংশধর তরফের সায়্যিদ খান্দুরা হাবেলী ও পৈল হাবেলীতে ছাহেব কিবলাহ তার দুই মেয়ের বিয়ে দেন। এসকল পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সুসম্পর্কের পাশাপাশি সায়্যিদ বংশীয় হিসাবে তাদের তিনি যথাযথ গুরুত্ব দিতেন। অন্যদিকে ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে কোনো সায়্যিদ পরিবারের সঙ্গে বিয়ের আলাপ আসলে তিনি রাজি হতেন না।’

মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন বহু ঘটনার উল্লেখযোগ্য নজির হিসেবে। তার বিবরণ থেকে জানা যায়, একবার ফুলতলী মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে ভারতের করিমগঞ্জের রাফি নগরের সায়্যিদ সায়্যিদ ছাহেবকে দাওয়াত করা হয়। তাকে আনার জন্য ছাহেব কিবলাহ পালকি পাঠান। যখন তিনি মাহফিলে বয়ান করছিলেন, তখন খবর আসে সায়্যিদ ছাহেব মাহফিলে তশরীফ আনছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বয়ান বন্ধ রেখে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ছুটে যান ভক্ত-মুরিদানসহ। ছাহেব কিবলাহকে দেখে সায়্যিদ ছাহেব পালকি থেকে নামতে চাইলে তিনি বাধা দেন। এমনকি নিজ কাঁধে পালকি তুলে নেন। এ দৃশ্য দেখে সমবেত লোকদের সঙ্গে সায়্যিদ ছাহেবও হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সায়্যিদ ছাহেবের অনুরোধে তিনি পালকি অন্যের কাঁধে তুলে দেন। রাসূল (সা.) এর প্রতি প্রেম-মহব্বতের এমন নজির দেখা যায় না।

তিন
উত্তরাধিকার সূত্রে ছাহেব কিবলাহর চরিত্রে কোমলের সঙ্গে কঠোরতার অপূর্ব সম্মেলন প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি ইসলামের ব্যাপারে, রাসূল (সা.) এর ব্যাপারে, বিশ্ব মুসলিমের ব্যাপারে এবং দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে আজীবন কোনো আপোষ করেন নি। যখনই কোথাও আঘাত এসেছে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দ্বীনের স্বকীয়তা সুরক্ষার আন্দোলনে যেমন তিনি অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি মুসলিম বিশ্বের কোথাও আগ্রাসন ঘটলে, দমন-পীড়ন হলে এবং ইসলাম ও বিশ্ব মুসলিমের স্বার্থে আঘাত এলে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন। ব্রিটিশ ভারতের আসাম অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষার ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে ফজলুর রহমান বিরোধী আন্দোলন, বাংলাদেশে তসলিমা বিরোধী আন্দোলন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ বিরোধী আন্দোলন, দৈনিক ইনকিলাব বন্ধের প্রতিবাদে আন্দোলন, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে চক্রান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন, ইত্যাদিতে তার অগ্রবর্তী ভূমিকা ও অবদানের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। একইভাবে স্মরণ করা যেতে পারে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা।

ইনকিলাব-এর নির্বাহী সম্পাদক বিশিষ্ট কবি মাওলানা রূহুল আমীন খান তার এক নিবন্ধে ছাহেব কিবলাহর মুখে শোনা তাঁর জীবনের আন্দোলন- সংগ্রামের কিছু ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। ওই বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালের দিকে ভারতের আসামের মুসলমানরা এক কঠিন সংকটের মুখে পড়ে। আসাম সরকার মুসলিম এডুকেশন বোর্ড বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এতে মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও আমল-আকিদা হুমকির মুখে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। এখবর এপারে জকিগঞ্জে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ছাহেব কিবলাহ সেখানে ছুটে যান। গড়ে তোলেন দুর্বার গণআন্দোলন। একের পর এক সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। প্রতিবাদ জানাতে থাকেন সকল অন্যায় সিদ্ধান্তের। প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি গড়ে তোলেন বিশাল আন্দোলন। আসাম সরকার এই আন্দোলনের মুখে তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়। এতে ফলোদয় না হওয়ায় গুলির নির্দেশ জারি করে। তিনি এই আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে যে ঝুঁকি নেন, দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন তা অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়।
আইয়ুব খানের এডভাইজারি কাউন্সিলের ড. ফজলুর রহমান ইসলামের অপব্যাখ্যা দেয়ায় তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। ছাহেব কিবলাহ শুধু প্রতিবাদ নয়, গড়ে তোলেন সিলেটকেন্দ্রিক বিশাল আন্দোলন। সিলেটে আয়োজন করেন বিক্ষোভ-সমাবেশের। সরকারী তরফ সোচ্চার হয় সমাবেশ বন্ধে। সিলেটেরই সন্তান ও তৎকালীন মন্ত্রী দেওয়ান বাসিত তাকে অনুরোধ করেন সমাবেশ না করতে। তিনি তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তাকে জানানো হয়, সমাবেশ হলে গুলিবর্ষণ করা হবে। তিনি এ হুমকি পরোয়া না করে সমাবেশের আয়োজন অব্যাহত রাখেন এবং যথাসময়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী তখন নিউস্কিম মাদরাসা বিলোপের সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা হাইকোর্ট বারে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ছাহেব কিবলাহ সরকারী নির্দেশের কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ঘোষণা করেন, ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলাম। এ জিহাদ চলবে। এই ঘোষণার পর আন্দোলন আরও তীব্র ও বেগবান হয়ে ওঠে। ছাহেব কিবলাহর জীবনে এ ধরনের সব ঘটনার বিবরণ, বলা বাহুল্য, এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমরা অতঃপর জমিয়াতুল মোদার্রেছীন, দৈনিক ইনকিলাব পরিবার ও এর প্রতিষ্ঠাতা তার সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করবো।

চার

বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাণের সংগঠন, বাংলাদেশের পেশাজীবীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অবিসংবাদী নেতা হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.)-এর সঙ্গে ছাহেব কিবলাহর অকৃত্রিম সখ্য ছিল। উত্তরাধিকারগত মিলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তারা ছিলেন পরস্পরের সাথী। অধ্যাত্মিক ও কর্মগত সূত্র ধরেই তাদের দুই পরিবারের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তাদের অবর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অন্যতম উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক ছাহেব কিবলাহ হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.) এর জীবিতকালে যেমন তেমনি তার ইন্তেকাল পরবর্তীকালেও যতদিন জীবিত ছিলেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঙ্গে তার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সকল আন্দোলন- সংগ্রামে তিনি অংশ নিয়েছেন, তার বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, অভয় ও মদদ দিয়েছেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বর্তমান সভাপতি ও ইনকিলাব-এর সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনকে তিনি আপন সন্তানের মতো ভালো বাসতেন, স্নেহ করতেন। আধ্যাত্মিক নিদের্শনা ছাড়াও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তাকে নিয়মিত পরামর্শ দিতেন। স্বভাবতই ছাহেব কিবলাহর ইন্তেকালে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তার একজন অকৃত্রিম উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হারিয়েছে। আর এ এম এম বাহাউদ্দীন হারিয়েছেন একজন অভিভাবক ও মুরব্বীকে।

জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের তরফে যখনই কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচী দেয়া হয়েছে, ছাহেব কিবলাহ বিনা প্রশ্নে তা সমর্থন করেছেন এবং তাতে শরিক হয়েছেন। বিগত এক সরকারের আমলে কয়েকশ› মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়। চলে আরো মাদরাসা বন্ধের পাঁয়তারা। এর প্রতিবাদে সারাদেশে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ-সমাবেশ করতে থাকে। এরকমই এক প্রতিবাদ সমাবেশে ডাকা হয় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে। সে সমাবেশে উপস্থিত হন ছাহেব কিবলাহ। সমাবেশ থেকে সিদ্ধান্ত হয় বিক্ষোভ মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হবে। কিন্তু বিক্ষোভ মিছিল আর শুরু হয় না। চারদিকে পুলিশের প্রাচীর। তা ভেদ করে ঝুঁকি নিয়ে মিছিল শুরু করতে সবাই যখন ইতস্তত করছেন তখন সামনে এসে দাঁড়ান ছাহেব কিবলাহ। ঘোষণা করলেন, আমি থাকব মিছিলের সামনে। গুলি হলে আমার বুকে লাগবে আগে। আমি শহীদ হব। এর পর যেন বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সামনে এগিয়ে চলে দৃপ্ত মিছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা শিক্ষার ফাজিল ও কামিল স্তর ন্যস্ত করার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য বিনাশ করার যখন চক্রান্ত চলে তখন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনসহ দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এক যোগে তার প্রতিবাদ জানান। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। মাঠে-ময়দানে সরকারের পরিকল্পনা ও পাঁয়তারা বন্ধ এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওইসময় ছাহেব কিবলাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে তিনি ও শর্ষিনার পীর ছাহেব যৌথভাবে একটি খোলা চিঠি দেন। চিঠিতে তারা বলেন, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং তার অধীনে মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্স মান প্রদানের দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য দেশের ওলামায়ে-কেরাম, মাশায়েখ এজাম, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এ শিক্ষার শুভাকাঙ্ক্ষীগণ দীর্ঘদিন থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে এজন্য গঠিত কমিশন ও কমিটিসমূহ এর অনুকূলে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করেছে। এর আলোকে সরকার দেশে একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করবে। এ প্রত্যাশা সকলের।

ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ জাতীয় দাবিকে পাশ কাটিয়ে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাজিল কামিলকে ন্যস্ত করে মান দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরে আমরা গভীর উদ্বেগ বোধ করছি। সরকারের অনুধাবন করা প্রয়োজন। মান প্রদানের নামে যদি মাদ্রাসার ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, ও স্বাতন্ত্র্য কোনো প্রকার ক্ষুণ্ন করা হয় কিংবা ফাজিল-কামিলের জন্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের যে কোর্স - কারিকুলাম আছে তা যদি রদবদল করা হয় অথবা মঞ্জুরিপ্রাপ্য ফাজিল-কামিল মাদ্রাসাসমূহের কোনোটিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয় কিংবা ওই সকল মাদ্রাসায় চাকরিরত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয় তবে সে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা মনে করি, এর দ্বারা সমস্যার কোনো সমাধান হবে না বরং তা নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে, জটিলতা বৃদ্ধি করবে যা কারোর কাম্য নয়।›
পীরদ্বয় ওই খোলা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমরা বিষয়টির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকষণ করছি এবং অবিলম্বে এফিলিয়েটিং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। এই সঙ্গে আরো আবেদন জানাচ্ছি যে, এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সাপেক্ষে আপাতত ফাজিল কামিল মাদরাসা সমূহকে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রেখেই অচিরেই ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্স মান প্রদান করা হোক!”

মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাহেব কিবলা ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ায় আন্দোলন ক্রমাগত জোরদার হয়ে ওঠে। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে সভা-সমাবেশ করেন। তিনি দাবি আদায়ে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেন এবং তার নেতৃত্বে শত শত গাড়ির লংমার্চ ঢাকায় আসে ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সমাবেশ। ওই সমাবেশে ছাহেব কিবলাহ বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা দেন, আমরা অবিলম্বে এফিলিয়েটিং আরবী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন চাচ্ছি। এর অধীনে ফাজিল ও কামিলের মান চাই। এর বিকল্প কোনো কিছু মানি না। মানব না। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছাহেব কিবলাহকে আমন্ত্রণ জানান আলোচনার জন্য। সে আলোচনায় তার সঙ্গী হন দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক কবি মাওলানা রুহুল আমীন খান এবং তার ছোট ছেলে মাওলানা হুছাদ্দীন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছাহেব কিবলার আলোচনায় তিনি তার বক্তব্য ও অভিমত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা ন্যস্ত করা হবে না। মহিলা শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যতামূলক আদেশ শিথিল করা হবে। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হবে। হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.) এবং ছাহেব কিবলার আজীবন স্বপ্ন ছিল ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন সেই ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন নয় বাস্তব। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন দীর্ঘ সংগ্রাম আন্দোলন ও প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সঙ্গতকারণেই হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.)-এর প্রতিষ্ঠিত ও এ এম এম বাহাউদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি, ইনকিলাব পরিবারের প্রতি ছাহেব কিবলাহর প্রশ্রয়, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা আজীবন অক্ষুণ্ন ও অটুট ছিল। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে ছাহেব কিবলাহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মিল ছিল। একারণেই যখন ১৯৮৮ সালে সরকার ইনকিলাবের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে তখন তার প্রতিবাদে ছাহেব কিবলাহ গর্জে ওঠেন। ইনকিলাব বন্ধের প্রতিবাদে ও বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী যে বিশাল আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয় ছাহেব কিবলাহ প্রতিষ্ঠিত আনজুমানে আল ইসলাহ, আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়াসহ বিভিন্ন সংগঠন। ছাহেব কিবলাহ তার সিলেট শহরের সুবহানীঘাটের বাড়িতে এক সুধী সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, অবিলম্বে ইনকিলাব খুলে দিতে হবে। নইলে সারাদেশে অবিরাম আন্দোলন কর্মসূচি চলবে। সামনে আমি থাকব। আপনাদের সহযোগিতা চাই।

সব প্রয়োজনে, সব বিপদাপদে যিনি সামনে এসে দাঁড়াতেন, সেই মানুষটি তার প্রিয়তমের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ায় দেশে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা আজও পূরণ হয়নি। জাতির এই অভিভাবকের কথা বিভিন্ন উপলক্ষে এখনো সবার স্মরণ হয়। আরও বহুদিন স্মরণ হতে থাকবে।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা