ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

সিলেটের কয়েকটি মসজিদ

Daily Inqilab ফয়সাল আমীন

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম

আয়তনে খুবই ছোট একটি মসজিদ। মাত্র ৭ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ পড়তে পারেন এ মসজিদে। শুনে চমকিত হবেন অনেকেই। স্থানীয়দের ধারণা, এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মসজিদ। সেই মসজিদটি সিলেটের গোয়াইনঘাট সদর ইউনিয়নের হাইডর কালাইউরা গ্রামে অবস্থিত। এর আকার সাত ফুট বাই সাত ফুট, যার ভিতরে নামাজ পড়তে পারেন সাত জন মুসল্লি। মসজিদটি কখন প্রতিষ্ঠিত, জানে না কেউ। এলাকার মুরব্বি ফরিদ উদ্দিন জানান, মসজিদটি আজ থেকে আনুমানিক ২০০ বছর পূর্বে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে পাওয়া যায়। পরে এলাকার পূর্ব পুরুষরা সেটির সংস্কার কাজ করেন। পরবর্তীতে মসজিদটি এলাকার মানুষের কাছে ইবাদতের অন্যতম স্থান হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। ইউনিয়নের মানুষের কাছে মসজিদটি ডিমের মসজিদ নামেও পরিচিত। দীর্ঘ ২০০ বছর পর ২০২২ সালে স্থানীয় একজন দানশীল ব্যক্তির অর্থায়নে সংস্কার হয় মসজিদটির। সেকারণে এ মসজিদের আদি চিত্র এখন লোকচুক্ষর অন্তরালে চলে গেছে। কিন্তু মুখে মুখে রয়েছে এ মসজিদ গোড়াপত্তনের নানা গল্প। মূলত অধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পীর-আউলিয়া, দরবেশের মাজার ও নানা স্মৃতি চিহ্ন। কারণ, ওলি-দরবেশের হাত ধরেই ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে এ অঞ্চলে। এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারকালে বিভিন্ন এলাকায় তাদের সাময়িক বিশ্রামের স্থানও পেয়েছে ‘মোকাম’র খ্যাতি। অস্থায়ী বিশ্রামের এসব জায়গাকে স্মরণীয় করে রাখতে ভক্তরা সংরক্ষণ করেছেন প্রার্থনার স্থান বা মসজিদ হিসেবে। যদিও সময়ের পরিক্রমায় প্রাচীন সেই মসজিদগুলোকে নতুন আদলে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক শিল্পস্থাপত্যে। কিন্তু মুছে যায়নি মসজিদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য। এরকম একটি মসজিদ হলো গায়েবি মসজিদ। নামটার মধ্যে একটা রহস্যের ছোঁয়া রয়েছে। এলাকার প্রবীণ অনেকের ধারণাটাও রয়েছে ধূম্রজালে।

সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর-বালাগঞ্জ সড়কের পাশে হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উছমানপুর জামে (গায়েবি) মসজিদ। মসজিদটি কত সালে নির্মাণ করা হয়েছিল সে নিয়ে রয়েছে নানামত। এ বিষয়ে সঠিক প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শাহজালাল (রহ.) এর সিলেট আগমনেরও আগে মুসলিম বসতির নিদর্শন এই মসজিদটি প্রায় ৮শ’ থেকে হাজার বছরের পুরনো স্থাপনা। কেউ কেউ ধারণা করছেন, শাহজালাল (রহ.) এর সফর সঙ্গী উছমান বোগদাদী, সৈয়দ মাহবুব খন্দকার ও সৈয়দ তাহির খন্দকারের সাধনার স্থান হিসেবে অলৌকিকভাবে স্থাপিত হয়েছিল মসজিদটি। ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত শাহজালালের (রহ.) গৌড় বিজয়ের আরও পূর্বে আরবীয় বণিক বা ধর্ম প্রচারক দল বুড়ি বরাক (বরবক্র) নদীপথে এসে (তৎকালীন ভগবানপুর) উছমানপুরে আস্তানা স্থাপন করেন। সে সময় এলাকায় বাস ছিল বৌদ্ধ বা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। তখন আরবীয় বণিক বা ধর্ম প্রচারকরা মসজিদটি নির্মাণ করান। পরবর্তীতে এলাকায় বিভিন্ন রোগ বালাই, ভয়াবহ বন্যা-খরাজনিত দুর্ভিক্ষসহ বিভিন্ন কারণে মুসলমানরা ওই স্থান ত্যাগ করেন। এরপর সম্পূর্ণ মসজিদটিই ঘন জঙ্গল ও মাটিতে ঢাকা পড়ে। পরবর্তীতে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর তিন সফর সঙ্গী (১৩০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) উছমান বোগদাদী, সৈয়দ মাহবুব খন্দকার ও সৈয়দ তাহির খন্দকার তৎকালীন ভগবানপুর এসে বসতি গড়ার জন্য স্থান খুঁজতে থাকেন। উঁচু একটি টিলা পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপনের জন্য মাটি কাটতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মাটির নিচ থেকে পাকা স্থাপনার একটি অংশ বেরিয়ে আসে। এ সময় এটি মসজিদ নাকি হিন্দু বা বৌদ্ধদের উপাসনালয় তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরবর্তীতে কাঠামো, সুলতান খানা ও পূর্বমুখী দরজা দেখে স্থাপনাটি মসজিদ বলেই প্রতিয়মাণ হয়। এরপর থেকে এটি গায়েবি মসজিদ নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে। অতঃপর এলাকার নাম ভগবানপুর পরিবর্তন করে উছমান বোগদাদীর নামানুসারে ওই এলাকার নামকরণ করা হয় ‘উছমানপুর’।

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, মসজিদটি কীভাবে স্থাপিত হয়েছিল তা তাদের পূর্ববর্তীরাও জানেন না। তবে তারা এটিকে গায়েবি মসজিদ নামেই জেনে আসছেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মসজিদটি দেখার জন্য অসংখ্য মানুষ ছুটে আসেন। মসজিদটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে সচেষ্ট রয়েছে গ্রামবাসী। ‘বালাগঞ্জের ইতিবৃত্ত’ বইয়ের লেখক আব্দুল হাই মোশাহিদ বলেন, উছমানপুর গায়েবি মসজিদ কবে বা কারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই মসজিদটি সাক্ষ্য বহন করে হযরত শাহজালালের (রহ.) আগমনের অনেক পূর্ব থেকে এ অঞ্চলে মুসলিম বসতির। এছাড়া আরও প্রাচীন মসজিদের নিদর্শন মিলে শাহজালালের (রহ.) সমাধিতে কমপক্ষে চারটি শিলালিপির অস্তিত্বে। এরমধ্যে সবচে প্রাচীন শিলালিপিতে সুলতান ইউসুফ শাহের শাসনামলে (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.) মজলিস উজাল কর্তৃক নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। শিলালিপিটি আরাবি হরফে তুঘরারীতিতে উৎকীর্ণ। এতে ইউসুফ শাহের নাম আছে, কিন্তু তারিখের অংশটি ভেঙে গেছে। শিলালিপিটি প্রোথিত ছিল চৌকি দিঘি মসজিদে। দরগায় আস্তানা করার আগে শাহজালাল (রহ.) সেখানে থাকতেন। ১৬৫৮ সালে তখনকার ফৌজদার ইস্ফেন্দিয়ার খান মসিজিদটি ভেঙে ফেলেন। রয়েছে পীর মোকাম মসজিদ। হিজরি ১০৬৩/১৬৫৩ সনে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, পাঁচ পীর মোকাম নামক স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের লামা গাভুর টিকি গ্রামে ঐতিহাসিক এ মোকাম মসজিদের অবস্থান। স্থানীয়রা জানান, সিলেটের সুফি সম্রাট হযরত শাহ জালালের (রহ.) সফর সঙ্গী হযরত শাহ গরীব বা শাহ গাবরু (রহ.) এর আস্তানা ছিল এটি। একটি উঁচু ঢিবির উপর সাধনা করতেন তিনি। তার নামানুসারেই এই এলাকার নামকরণ ‘গাভুর টিকি’ করা হয়। এখানে বহুকাল পূর্বে ইসলাম প্রচার করতে আসা ৫ জন দরবেশের একটি কাফেলা সাময়িক আস্তানা গড়েন। একটি গাছের মাথায় লাল সামিয়ানা ঝুলিয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন তারা। কেউ কেউ বলেন, এরাও ছিলেন হযরত শাহ জালালের সফর সঙ্গী। তবে, শুরু থেকে সংরক্ষণ না হওয়ায় মোকামের সঠিক ইতিহাস নিয়ে এলাকায় নানা গল্প প্রচলিত আছে। কারো কারো ধারণা, ব্রিটিশ আমলে তারা (পাঁচ পীর) পারস্য থেকে এসেছিলেন। তবে এই পাঁচ পীরের নাম-পরিচয় ও আগমনের তথ্য নিশ্চিত করে বলতে পারেনি কেউ। এছাড়া রয়েছে দরগাহ মসজিদ। এটি হিজরি ১১৫৭/১৭৪৪ সালে ফৌজদার বাহরাম খান নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মুঘল আমলের এই মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে শ্রীহট্টের ম্যাজিস্ট্রেট মি. জন ওয়ালিস এটির সংস্কার করেন। অপরদিকে, সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার বারঠাকুরী ইউনিয়নে অবস্থিত একটি অতি প্রাচীন গায়েবী দিঘি মসজিদ রয়েছে। এখানে ৪০০ বছরের পুরাতন পাথরের শিলালিপি পাওয়া গেছে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে রাখা আছে। শিলালিপি থেকে ধারণা করা হয়, এটি ১৭ শতকে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া প্রাচীন সময়ের বার্তা দেয় হযরত শাহ পরাণের মসজিদ ও দরগাহটিও। সিলেট নগরীর প্রায় ৮ কি. মি. পূর্ব দিকে সিলেট-তামাবিল সড়ক থেকে প্রায় ০.৩ কি. মি. ভিতরে সু-উচ্চ ও মনোরম টিলায় অবস্থিত হজরত শাহ পরাণ মসজিদ ও দরগাহ্। মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে সমাধিটি। শাহ পরাণ মসজিদটি আয়তকার তিন গম্বুজবিশিষ্ট এবং এর দেয়াল চার ফুট চওড়া, মসজিদটির বহির্ভাগে চার কোণে চারটি অর্ধ গোলাকৃতির পার্শ্ব বুরুজ রয়েছে। এ মসজিদটির শিলালিপি ভিত্তিক নির্মাণকাল পাওয়া যায়নি। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি নির্মিত বলে অনুমিত।

লেখক : সিলেট জেলা সংবাদদাতা, দৈনিক ইনকিলাব।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা