‘সমাগম’ যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক অনন্য উপন্যাস
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
শওকত ওসমানের (১৯১৭:১৯৯৮) নিরীক্ষাধর্মী অভিনবত্বের জাজ্জ্বল্যমান প্রতিচ্ছবি ‘সমাগম’ উপন্যাস। এ উপন্যাসের প্রতীকের অন্তরালে বিশ্বমানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্বের পক্ষে এবং সাম্রাজবাদ ও যুদ্ধবিরোধী একটি গভীর বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে। সমকালীন জীবনবোধের প্রেক্ষাপটে মৃতলোকের বাসিন্দা কয়েকজন বিখ্যাত মনীষীর নাটকীয় আবির্ভাব, তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে কয়েকটি বাণীর মধ্য দিয়ে সুস্থ জীবনবোধ ও আশাবাদী চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সমাজের অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে মানুষের নৈতিক অবমূল্যায়নের ফলে, মানবিকবোধের অবলুপ্তি ও আত্মিক শূন্যতার পরিণাম যে তার বিকৃতি ও মূল্যবোধহীনতা, তা এ উপন্যাসে লেখক অত্যন্ত সার্থকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘সমাগম’ উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। ঢাকার একটি পত্রিকার সাব-এডিটর জুহার কাছে মধ্যযুগীয় রোসাঙ্গের রাজকবি মহাকবি আলাওল চিঠি পাঠিয়ে উপযাচক হয়ে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। প্রায় তিনশ’ বছর আগেকার তুলট কাগজে মধ্যযুগীয় বাংলায় লেখা চিঠির পাঠোদ্ধার করে জুহা জানতে পারেন ‘সহস্র বাইশ মঘী সন রোজ রবিবার’ অর্থাৎ পরবতী রবিবার মহাকবি আলাওল তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। চিঠিটি তুলে ধরেছেন লেখক এভাবে : ‘বিসমিল্লা প্রভুর নাম আরম্ভ প্রথম/ অতঃপর নিবেদিত সালাম আলেকন/খাহেস হৈল তাহে মুসাফির হৈয়ে। পৌঁছাইমু একা একা তুহ্মার আলয়ে/ মুনশী করিয়ে দেহ কুশল-খবর/ নেক নাম নেক কাম পুত্র-বরাবর/ দোওয়া খায়ের মাঙ্গিঁ তুহ্মার কারণে। রোসাঙ্গের হীন কবি আলাওল ভনে ॥’
মহাকবি আলাওলের এ চিঠি জুহাকে যার পর নাই পুলকিত ও শিহরিত করে। তিনি স্ত্রী জাইদুনকে চিঠির মর্মার্থ খুলে বলেন। আলাওলের আগমন উপলক্ষে মেয়েদের মধ্যে কবি চন্দ্রাবতীকে রাখতে চাইলে জাইদুন বেগম রোকেয়াকে ডাকার প্রস্তাব করেন। কিন্তু, উপন্যাসে চিঠিতে উল্লেখিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কবি চন্দ্রাবতী বা বেগম রোকেয়া শেষ পর্যন্ত অনুপস্থিত।
আলাওলের আগমন উপলক্ষে আমন্ত্রিতদের মধ্য থেকে এসেছেনÑ আলাওল, বার্নার্ডশ’, রমাঁ রলা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মোহাম্মদ মহসীন এবং রাতের শেষ পর্যায়ে অনাহূত অবস্থায় আবির্ভূত হন লিও টলস্তয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাদের জ্ঞানগর্ভ কথোপকথন এবং বিতর্কে অত্যন্ত মোহনীয় হয়ে ওঠে সেই রাত্রি। এমন একটি কাল্পনিক ও উদ্ভট আখ্যান রচনার কারণ উপন্যাসের সূচনায় পাঠকচিত্তে কৌতূহলের সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত তা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। লেখক এক বিশ্বজনীন সর্বমানবিক চেতনায় উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ডক্টর রফিকউল্লাহ খানের একটি উদ্ধৃতি স্মরণীয়, ‘সমাগম-এ শওকত ওসমান জাতীয়Ñআন্তর্জাতিক পটভূমিতে সমকালের জীবনসত্যকে উম্মোচন করেছেন। নাট্যদৃশ্যের আঙ্গিকে ঔপন্যাসিক বর্তমানের বাস্তবতা এবং মৃতলোকের ব্যবধানকে লুপ্ত করে সুখী, সমুন্নত এক বিশ্বজীবনের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা শহরের একটি গৃহে সমাগত হয়ে হাসি, গান, কৌতুক, বিতর্ক এবং জ্ঞানগর্ভ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রয়াত মনীষীবৃন্দ সমকালীন বিশ্বসংকটের স্বরূপ নির্দেশ করেছেন এবং সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। উপন্যাসটির আদ্যন্ত অভিব্যক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবিক ঘৃণা ও ক্ষোভ। উচ্চারিত হয়েছে বিশভ্রাতৃত্ব ও মানবতার জয়গাঁথা।’ (ডক্টর রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ, বা/এ, ঢাকা, জুন,১৯৯৭,পৃষ্ঠা-১৩৫)।
‘সমাগম’ উপন্যাসে শওকত ওসমান মৃতলোকের বিখ্যাত মনীষীদের চরিত্রের বিপরীতে জীবিত লোকের জুহা চরিত্রকে ঘিরে জাইদুন, ফুয়া, সৈয়দ বোকজা, পাষ- তেছোদীন ও মোসাদেদ বখতের চরিত্র অংকন করেছেন। এই দুই শ্রেণীর চরিত্রকে গভীরভাবে দেখলে একটা বিষয় লক্ষ করা যায়। সেটি হলোÑমৃতলোকের বাসিন্দাদের এ উপন্যাসে অবাস্তব মনে হলেও নিজস্ব কালের বিচারে এদের সবার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। পক্ষান্তরে জীবিতলোকের বাসিন্দাদের বাস্তবলোকের মনে হলেও তাদের সব ক’টি চরিত্রই লেখকের কল্পনার ফসল।
জীবিতলোকের বাসিন্দাদের মধ্যে উপন্যাসের গল্প ঘটনার মূল কেন্দ্রে রয়েছেন সাংবাদিক জুহা। তার বাসগৃহে অতিথি সমাগমের পর প্রতিটি চরিত্রই তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, গান, আনন্দ এবং সমকালীন বিশ্বের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন ও সেসব সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজেন। এই আলোচনায় অতীত বর্তমান উভয়ই সমানভাবে প্রাধান্য পায়। আসর শেষে হবার মুহূর্তে শেষ রাতে আকস্মিকভাবে মৃতলোক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও টলস্তয় এসে যোগ দেন। অতিথি সমাগম শেষে শ্লোগানের ভাষায় মহৎ মানবিক বক্তব্য উচ্চারিত হয়। জুহার বন্ধু সৈয়দ বোক্জার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘মানুষের বিশ্বভ্রাতৃত্ব অক্ষয় হোক। ‘বার্নার্ডশ’ ঘোষণা করেন, ‘ধ্বংস হোক, সাম্রাজাবাদীগণ ও অনুচরেরা ধ্বংস হোক’। টলস্তয় উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, মানুষের নির্বোধতম সংগঠন হিসেবে ধ্বংস হোক যুদ্ধ’। আর সব শেষে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে সুললিত রাগের মতো শোনায় তাঁর আবেদনমুখর কণ্ঠস্বর, ‘সুখীতর, আরো সমৃদ্ধতর হোক আগামী দিনের পৃথিবী’।
‘সমাগমে’র এই ফ্যান্টাসিপূর্ণ আলোচনা সভার জীবিত ও মৃতলোকের বাসিন্দারে মধ্যে নানাবিধ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানের বাস্তবতার তুলনামূলক বিচারে মনীষীদের জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনা স্থান পায়। মহাকবি আলাওল ফরিদপুর থেকে তৎকালীন আরাকান যাত্রার সময় মেঘনায় যে পর্তুগীজ হার্মাদের কবলে পতিত হয়েছিলেন, সেই কাহিনী দিয়ে কথোপকথন শুরু হয়। সেদিনের হার্মাদের সেই বীভৎসতার সাথে আজকের দিনের বীভৎসতার কোনো পার্থক্য নেই। আজ পৃথিবী জুড়ে আগ্রাসন মানবতাকে হতচকিত করে। তাদের সেই আড়াইশ’ বছরের শাসন-ত্রাসন থেকে রক্ষা পাননি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা জর্জ বার্নাডশ’। এ কারণে মাইকেলের ক্ষোভও ব্যক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মাইকেল সমাগত অতিথিদের বলেছেন: ‘বুকে অনেক জ্বালা ছিল বন্ধু। দেশবাসীদের অজ্ঞতাপ্রসূত জ্বালা, দারিদ্র্যের দাবদাহÑ তাই মাইকেল কোনদিন স্থির থাকতে পারেনি। মদ্যপের মতোই ডাইনে-বামে ঝুঁকে ভারসাম্য রাখতে গিয়েছিল।’ (সমাগম, শওকত ওসমান, পৃষ্ঠ-৬০)।
আলোচনার এক পর্যায়ে মনীষীবৃন্দ ‘ক্ষণোক্ত’- শীর্ষক নাটকে অভিনয় করেন। এই নাটকের মধ্যেই মানব সমাজের নানা অসঙ্গতি ও তার থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করা হয়। নাটকীয় সংলাপে মাইকেলের জিজ্ঞাসা ছিলো: ‘আমি বহুবার ভেবেছি এই অমঙ্গল আসে কোত্থকে? কেন মানুষের মধ্যে এক শ্রেণীর জানোয়ার জন্মায়, আর তারা হঠাৎ কত প্রাণ ঘরবাড়ি ধ্বংস করে চলে যায়। উত্তরে বার্নাডশ’ বলেছেন- ‘ব্যাপারটা কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় সমাজের কলকব্জা ঠিকমত সমাজও তখন প্রকৃতির মত প্রতিশোধ নেয়। অজ্ঞতা থেকেই অমঙ্গলের উৎপত্তি’।
উপন্যাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ ও টলস্টয়ের উপস্থিতি বিশ্বমানবতার মহিমান্বিত বাণীকে আরও বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপনার সাহায্য করেছে। আলোচনার উপান্তে সম্মিলিত অতিথিবৃন্দের মুখে বিশ্বভ্রাতৃত্বের উন্মোচন ও দৃঢ় বন্ধনের জন্য সোচ্চার উচ্চারণ ও আন্তর্জাতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে।
উপন্যাসে এই বিচিত্রধর্মী মনীষীবর্গ একটি জায়গায় এসে প্রত্যয়ী ঘোষণার মধ্যদিয়ে একমত হতে পেরেছেন যে, তারা বন্ধ্যাযুগের অচলায়তন ভাঙবার জন্য, সত্যের অপমৃত্যুকে রোধ করবার জন্য, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কল্যাণসাধনের জন্য বিশ্বভাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা চান- ‘চান সাম্রাজ্যবাদীদের ধংস আর যুদ্ধের অবসান।’ শওকত ওসমান ‘সমাগম’ উপন্যাসে ইতিহাস চেতন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সংকীর্ণ শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গির খাত পরিত্যাগ করে বৃহত্তর ধারাপ্রবাহে একাত্ম হতে পেরেছেন। এ উপন্যাস এক মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ লেখকের সামষ্টিক পরিকল্পনার ফসল।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জি.কে. আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজ, মাগুরা।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু
দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ
বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার
ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের
শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা
অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া
একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে
তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ
‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর
২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ
ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত
মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি
আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ
অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না
হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু