বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফেনীর নদীগুলো, পানিশূন্য মুহুরি ও সিলোনিয়া, শুকিয়ে যাচ্ছে ফেনী নদী : হুমকিতে মুহুরী সেচ প্রকল্প
০৬ মে ২০২৩, ০৫:০৩ পিএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২৩, ০৫:০৩ পিএম
বাঁচানো যাচ্ছে না ফেনীর নদ-নদীগুলো। এতদিন ফেনীবাসী জানতো ফেনীর দাগনভূঞার একটি অংশে ছোট ফেনী নদী বিলীনের পথে। এবছর দেখা যাচ্ছে ফেনীর ফুলগাজীর মুহুরি নদী ও সিলোনিয়া নদীও রয়েছে বিলীনের পথে। ভারতের উজান থেকে পানি না আসায় ও বেশ কয়েকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে মুহুরি ও সিলোনিয়া নদী।
ফেনী নদীর পানির ওপর নির্ভর করছে মুহুরী, কহুরা, কালিদাস পাহাড়িয়া সহ অসংখ্য ছড়া ও খাল। এগুলোর অস্তিত্ব ফেনী নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এসব নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদী তীরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ইরি-বোরো চাষ হুমকির মুখে পড়েছে ।
শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার ও বর্ষা মৌসুমে একতরফা পানি ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টিসহ নানা দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর মুহুরী সেচ প্রকল্পের ইরি-বোরো আবাদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফেনী সীমান্তের ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ওইসব এলাকায় বোরো চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের নামে পাকা দেয়াল নির্মাণ, বড় বড় ২৭টি পাইপ বসিয়ে পাকা রাস্তা ও কালভার্ট তৈরি করে তার ওপর তিন স্তরবিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করে পানির উৎসমুখগুলো ভরাট করে দেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশে পানি প্রবাহ একেবারে কমে গেছে। এতে নদীতে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে কৃষকরা জানান।
ভারত একতরফাভাবে পানি আটকে রেখে নিজেরা চাষাবাদ করলেও শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করছে বলে সীমান্তবর্তী কৃষকদের অভিযোগ। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে সব পাইপের মুখ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করে। তারা ৫৪টি নদীর প্রত্যেকটিতে একই কাজ করে আসছে। ভারত সীমান্তবর্তী ফুলছড়ি খাল, ছাগলনাইয়া খাল ও যশপুর খালসহ বিভিন্ন ছড়ার উজানে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রাখায় শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদীগুলোতে দেয়া স্লুুইস গেটগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় ফেনী নদী, মুহুরী ও কহুয়া নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো আবাদ হয়নি পানির অভাবে।
এদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য পাম্প বসিয়ে ফেনী নদীর পানি নিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের দ্বিতীয় মুহুরী সেচ প্রকল্প। ফেনী নদীর পানির ওপর চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। তীরবর্তী কয়েক লাখ লোক ফেনী নদীর পানির ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। চাষাবাদ ছাড়াও কয়েক হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ফেনী নদী। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কয়েক হাজার মৎস্য খামার।
ফেনী নদীর পানি ভারতের সাথে চুক্তি করায় সমগ্র অঞ্চলে দেখা দেবে মরুকরণ। ধ্বংস হবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশ-পরিবেশ। ফেনী নদী মুহুরী নদীর শতকরা ৮০ ভাগ পানি সরবরাহ করে থাকে। অপরদিকে কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি নেই। ভারতের উজান থেকে পানি আসা বন্ধ দীর্ঘদিন। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে ফেনীর মুহুরী ও সিলোনিয়া নদী। ফলে বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাড়ছে ব্যয়। সংকটে পড়েছেন মৎস্যজীবীরাও। কৃষি অফিসের তথ্য মতে, ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় চলতি বছর ৩ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে আর ফুলগাজীতে ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু নদীর পানি সংকটে অন্তত ১ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হয়েছে। আরও আবাদকৃত জমি পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃষ্টি না হওয়ায় ও ভারতের উজান থেকে পানি না আসায় মুহুরী নদীর ফুলগাজী উপজেলার দেড়পাড়া গ্রাম থেকে পরশুরাম পর্যন্ত পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর কিছু অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অপরদিকে সিলোনিয়া নদীর ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া সেতু অংশের পূর্ব-পশ্চিম পাশে দেড় কিলোমিটার এলাকা ছাড়া বাকি অংশে পানি নেই। পানির অভাবে মাঠে ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। কোথায় কোথাও গরমে ধান ক্ষেত পুড়ে গেছে। নদীর দুপাশে নিলক্ষী, গোসাইপুর, করইয়া, শ্রীবউরা, নোয়াপুর, কামাল্লা, রাজেশপুর, মনতলা, গাবতলা, মান্দারপুর ও পৈথারা গ্রামের হাজারও কৃষক বোরো ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় এবং খনন না হওয়ায় নদীর পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিচে নামছে। স্থানীয়রা জানান, পলি মাটি, বালি ও ময়লা পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীগুলো মরা খালের মতো হয়ে গেছে। এরপরও বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে আশপাশের এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের কৃষক রবিউল হক টিটু বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর এ জায়গায় আমরা জমি আবাদ করছি। পাঁচ বছর আগেও সিলোনিয়া নদীর পানি দিয়ে আমরা সেচ পানি দিতাম। এবার মাঠের কৃষি জমির ধান শুকিয়ে গেছে। এ মৌসুমে দুই একর জমিতে বোরো ধান চাষ করছি। ফসল পাবো কি-না দুশ্চিন্তায় আছি। কৃষক আবু মিয়া বলেন, নদী মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। বর্তমানে মাটিতে গর্ত করে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে ক্ষেতে দিতে হচ্ছে। মাটির নিচ থেকেও ঠিকমতো পানি ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে ডিজেলের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উত্তর কোলাপাড়া গ্রামের কৃষক কবিরুল ইসলাম বলেন, মুহুরী নদীর উজানের অংশে ভারত সীমান্তে পানি আটকে রাখায় বাংলাদেশের অংশে পানি প্রবাহ কমে গেছে। পানি প্রবাহ না থাকায় নদী একেবারেই শুকিয়ে গেছে। সেচ পাম্প চালুর কিছু সময়ের মধ্যে পানি সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরশুরাম পৌর এলাকার কোলাপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল খায়ের বলেন, মুহুরী নদীর উজানের অংশে ভারত সীমান্তে পানি আটকে দিচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ অংশে বাজারের পোলট্রি খামারের ময়লা আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নদী শুকিয়ে গেছে। পরশুরাম উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বাগমারা এলাকার সেচ পাম্প মালিক মো. মোস্তফা শামীম বলেন, গ্রামের বেশিরভাগ জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরাও সংকটে পড়ছেন। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা জমির হোসেন বলেন, বাড়ির পাশেই সিলোনিয়া নদী। কয়েক বছর আগেও এ নদী থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এখন আর নদীতে পানি নেই। ফলে মাছও পাওয়া যায় না। আমি এখন মাছ ধরা বাদ দিয়ে অটো চালাই। এভাবে আমার মতো অনেকেই পেশাবদল করেছেন। ফুলগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। আবার নদীতে নাব্যতাও কম, খনন জরুরি। মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টু বলেন, কৃষকদের পানি সংকটের বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। পানি সংকটে বোরোর ফলন ব্যাহত হচ্ছে। ফেনীস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আখতার হোসেন বলেন, মুহুরী নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি। পানি সংকটে এবারের বোরোর ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল বলেন, জেলা প্রশাসন ও কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
জকিগঞ্জে জামায়াতের সেক্রেটারিকে নিয়ে জমিয়ত নেতার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ান
মেলবোর্নে স্মিথ-কামিন্সের অনন্য কীর্তি
মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক
নেত্রকোনায় এ আর খান পাঠান স্মৃতি উন্মুক্ত ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার শুভ উদ্বোধন
এবার তিন অঙ্কে মুর্শিদা
আগুনে পুড়েছে সবচেয়ে বিতর্কিত ফাইলগুলো: রিজভী
সখিপুরে বনবিভাগের বিরুদ্ধে বিএনপি’র বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল
হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নে লিফলেট বিতরণ
বিসিএফের কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনায় ফ্রান্স প্রবাসীদের প্রাণবন্ত মিলনমেলা
পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থগিত পরিচালক সমিতির নির্বাচন
সিলেটে আজহারীর তাফসির মাহফিল আলিয়া মাঠের পরিবর্তে এমসি কলেজ মাঠে
সচিবালয়ে আগুন টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা: মাওলানা মামুনুল হক
শেখ হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই
আত্মসমর্পণ করবেন না: মিয়ানমার সেনাদেরকে জান্তা প্রধান
উইলিয়ামসের পর তিন অঙ্কে আরভিন ও বেনেট, জিম্বাবুয়ের রেকর্ড
বেনাপোলে শহীদ আব্দুল্লাহর বাড়িতে জামায়াতের আমির, করলেন কবর জিয়ারত
ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার! কাজাখস্তানে বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যে কী কারণ
গণ অভ্যুত্থানের ফসল শ্রমিকদের ঘরে উঠেনি - সাইফুল হক
বারাকা পাওয়ার লিমিটেড ১৭ তম বার্ষিক সাধারণ সভা