রাজনৈতিক উপাদান বিবর্জিত আমলাতান্ত্রিক বাজেট
০৭ জুন ২০২৩, ০৯:১৪ পিএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, নির্বাচনী বছরেও নির্বাচনী বাজেট হয়নি। যে বাজেট হয়েছে তা রাজনৈতিক উপাদান বিবর্জিত আমলাতান্ত্রিক বাজেট। বুধবার (৭ জুন) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন এ এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সিপিডি আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২০২৪: অসুবিধাগ্রস্ত মানুষগুলো কি পেল?’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সিপিডি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাজেটের আগে গাম্ভীর্য ছিল, বাজেট এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর অংশ হয়ে গেছে। বাজেটের ভেতর দিয়ে গত ১৫ বছরে সরকারের যে অর্জনগুলো ছিল, শত শত পৃষ্ঠার ভেতর দিয়ে তা মনে দাগ কাটেনি। কারণ ওটাকে আত্মস্থ করে না বলতে পারা। কোন জায়গাতে আমরা বিবর্তনগুলো করেছি, সেটা আর কোথায় ধরা যাবে না।’
এবারের বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের সম্পৃক্ততা ছিল না বলেও মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। রাজস্ব আহরণের মরিয়া চেষ্টার ফলে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে, এগুলোকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। এটা যে নির্বাচনী বাজেট না তা লক্ষ্যণীয়। পদক্ষেপগুলো একটি রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায় কতখানি গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এই বাজেট আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এবার রাজস্ব আদায়ের মরিয়া চেষ্টা দেখা গেছে। সরকারের হাতে খরচ করার মতো টাকাও নেই, ডলারও নেই। সেহেতু খরচ করার টাকা সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। কারণ আইএমএফ বলেছে, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। সেটারও একটি বিষয় রয়েছে। আইএমএফ’র প্রথম সমীক্ষা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় সমীক্ষা বছরের শেষের নাগাদ হবে। দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এতো মরিয়া চেষ্টার পরও আধা শতাংশ বর্ধিত করের লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু বাজেটে প্রাক্কলন করা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেগুলো নেওয়া হয়েছে তার অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে ২ হাজার টাকা সারচার্জসহ অন্যান্যগুলো নি¤œ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষকে প্রভাবিত করবে নেতিবাচকভাবে।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেটি নির্ধারণ করতে হচ্ছে তা বর্তমানের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। এটি সকলেই জানে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। রাজস্ব আদায়ের মরিয়া চেষ্টা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আইএমএফ’র শর্ত পূরণের জন্য। কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক ধোলাই হয়নি। রাজনৈতিক ধোলাই যদি হতো, তাহলে সংসদ সদস্য ও স্থায়ী কমিটিগুলোর কাছে নিয়ে যেতেন— এগুলোর অনেকগুলোতেই ওনারা রাজি হতেন না। তার প্রকাশ কিন্তু এখন সংসদ আলোচনায় ক্রমান্বয়ে বের হবে। বিদ্যুতের আলোচনা, আমদানি নিয়ন্ত্রণের আলোচনা— এগুলো সবই আগামীতে আসবে।’
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বহু আগে একজন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, প্রত্যেক বাজেটই তো নির্বাচনি বাজেট। আমি গত ৫ বছর ধরেই তো নির্বাচনি বাজেট দিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি রাজনৈতিক উত্তর হতে পারে। নির্বাচনি বাজেটের ভেতর কি থাকে? খরচযোগ্য তদারকিহীন টাকা (লুজ মানি) থাকে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন যায়গায় লুকায়িত অর্থ রয়েছে, যা সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেওয়া বরাদ্দের চেয়ে বেশি। আপনি যদি জনতুষ্টি চান তাহলে তো সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেবেন। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড যেটি দেড় বছর ধরে শুনছি, এখনো জানিনা কয়টি কার্ড দিয়েছে, কোন ফ্যামিলি পেল? তাহলে এটি রাজনীতিহীনভাবে নির্বাচনি বাজেট।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতি যদি থাকত তাহলে জনপ্রতিনিধিরা বলত ওখানে টাকা দাও, ওখানে খাদ্য সাহায্য দাও। বলত, শহরের ভেতরে ওএমএসের পরিমাণ আরও বাড়াও, ট্রাকের সংখ্যা বাড়াও, জেলা পর্যায়ে ওএমএস নিয়ে যাও। এই রিটার্ন সনদ পেতে ২ হাজার টাকা- এটা কেউ দেয়? কত টাকা এটা থেকে আদায় হবে? কেউ বলছে এক হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে। কার্যত এটি থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে। এই ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার জন্য এই সামাজিক সমালোচনা কেউ সহ্য করে। এটি কোন রাজনৈতিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে? এই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা ও নাগরিকরা কতটুকু যুক্ত ছিল? আগে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হত, সর্বশেষ মুহিত সাহেব (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের ডেকে একটি বৈঠক করতেন। এবার সেটাও হয়েছে কি না আমরা জানিনা। এই যে পদক্ষেপগুলো নিয়ে তো রাজনৈতিক দলের ভেতরে আলোচনাই হলো না।’
জলবায়ু ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, অন্য সব মন্ত্রণালয়ের মতো জ্বালানি ও জলবায়ু নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক থেকে যায়। আমরা বাজেট বিশ্লেষণের সময় বলেছি, বাজেট এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছে, যখন আমরা আইএমএফের ঋণের আওতায় রয়েছি। সেই শর্ত অনুযায়ী, ১১টি খাতে সংস্কার করতে হবে। এর মধ্যে জলবায়ু খাতে সংস্কারের একটি শর্তও রয়েছে। কিন্তু, বাজেটে আমরা সেটির প্রতিফলন দেখতে পাইনি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের যে সম্পদ আছে, সেটি বণ্টনে নায্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে, এনবিআর কত টাকা আয় কত করতে পারল, তা নিয়ে কথা বলি। একইভাবে কত টাকা সাশ্রয় করা যায়, তাও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। আমাদের ১ হাজার ২৫০টির মতো প্রকল্প আছে, যার মধ্যে ৮৭৮টি ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করতে হবে। এর অধিকাংশই আগের প্রকল্প। এই যে ক্যারিওভার প্রকল্প, এগুলোর কারণেই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। কেবল বাজেট প্রণয়ন নয়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অনেক বৈসাদৃশ্য রয়ে গেছে। এগুলো এখন প্রতীয়মান হচ্ছে।
ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম হেড সমীর রঞ্জন নাথ বলেন, শিক্ষার বাজেট বলতে আমরা যেটা বুঝি, তার মধ্যে এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যোগ করে একটি বড় অঙ্ক দেখানো হয়েছে। এর আগে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাজেট যখন শিক্ষার ক্ষেত্রে জুড়ে দেওয়া হয়, তা কিন্তু একটা বড় অঙ্কে দাঁড়িয়েছিল। ২২-২৩ অর্থবছরে ১০০ টাকার মধ্যে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমিয়ে বলা হচ্ছে, যা পরে দেখা যাবে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে ড. দিবালোক সিংহ স্বাস্থ্য, সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল হক সামাজিক সুরক্ষা খাত নিয়ে আলোচনা করেন। আর ব্যক্তি খাতে বাজেটের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি ড. আসিফ ইব্রাহিম।
বিভাগ : অর্থনীতি
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
নওগাঁয় ৬০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি
যেসব জেলায় বইতে পারে শৈত্যপ্রবাহ
বেনাপোল বন্দর দিয়ে ট্রেনে করে ৪৬৮ মেট্রিক টন আলু আমদানি
ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ৭ ধাপ এগোল বাংলাদেশ
ক্যাম্পাসে গুপ্ত হামলায় ঘটনায় চবি ছাত্রদলের প্রতিবাদলিপি
ভারতীয়দের উসকানিতে ফ্যাসিস্টরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়: শহিদুল ইসলাম
বোয়ালখালীতে টেম্পো-ইজিবাইকের সংঘর্ষে একজন নিহত
১৬ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন উত্তরের জনপদের মানুষ: সারজিস
মাগুরা জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন আহবায়ক আলী আহম্মদ সদস্য সচিব মনোয়ার হোসেন খান
গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে
ভূয়া নিউরন কোচিংকে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা
গোপালগঞ্জে ১৭ বছর পর বিএনপির কার্যালয় উদ্বোধন
হাসিনার পতনের পর যা চেয়েছি, তা এখনো পাইনি- আব্দুল্লাহ আল-আমীন
ভারতীয় দাবাড়ুর বিশ্বজয়ের ম্যাচে কারচুপির অভিযোগ
ঝিনাইদহে নকল নবীসদের খুলনা বিভাগীয় সমাবেশ দাবী বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার অঙ্গীকার
পাকিস্তান টেস্ট দলেরও দায়িত্বে আকিব
কবি হেলাল হাফিজ আর নেই
সিরাতুন্নবী (সা.) মানবজাতির জন্য একটি বিশ্বজনীন বার্তা : ধর্ম উপদেষ্টা
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে- খুলনায় ড. বদিউল আলম
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস জাতির ইতিহাসে এক মর্মস্পর্শী ও শোকাবহ দিন