ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এলো মাহে রমজান

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

২৩ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:১৮ এএম

বিশ্ব মুসলিমের দুয়ারে আবারও এসেছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান। আমরা সবাই জানি, রমজান মাস হলো মুসলিম পুণ্যাত্মার কাছে স্রষ্টার অসীম রহমত ও বরকতের মাস। আত্মার পরিশুদ্ধির মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস। ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কাছে এ মাস হলো সিয়াম সাধনার মাস। পরম করুণাময় মহান আল্লাহ্ তায়ালা যতগুলো শরিয়ত নাজিল করেছেন, তার প্রতিটিতেই ছিল সিয়াম সাধনা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ও ফরজ। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসুরীদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার বা মোত্তাকি হতে পার।’ মহান আল্লাহপাকের অসীম নিয়ামত ও অনাবিল আনন্দের হলো ‘সওম’। ফারসি ভাষায় সওম হলো রোজা। ‘সিয়াম’ হলো বহুবাচক। উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাও সিয়ামকে রোজা নামে অভিহিত করা হয়। সওম অর্থ হলো কোনও কিছু থেকে বিরত থাকা বা কোনও কিছুকে পরিত্যাগ করা। শরিয়তের ভাষায় বজ্রকঠোর শর্ত হলো, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, যৌনকর্ম এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নিষিদ্ধ যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা। রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, মাহে রমজান এলে এর প্রথম রাত থেকে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। জাহান্নামের সব কটি দুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় পবিত্র জান্নাতের সব কটি দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং একজন ফেরেস্তা ঘোষণা করতে থাকেন, ‘হে কল্যাণকামী অনুসন্ধানী! তুমি অনুসন্ধান কর ও এগিয়ে চল। আর অকল্যাণকামী পাপাত্মাদের বলতে থাকেন, তুমি থাম।’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

রমজান মাস বার বার আসে। আসে স্রষ্টার সীমাহীন অনুগ্রহ নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর চিন্তা চেতনায় জাগিয়ে তোলে নতুন শিহরণ। কিন্তু হায়! এতসব উদাত্ত নিয়ামত ও অনুগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমরা পার্থিব ভোগ বিলাসে বিভোর, মানুষ পারে না পবিত্র মাসটিকে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে। ভুলে যায় এর অফুরন্ত নিয়ামতের কথা। রোজা সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমান ও এখলাছের সঙ্গে যারা রোজা রাখে, মহান আল্লাহ তাঁদের অতীতের যাবতীয় গুণাহ মাফ করে দেন।’ তিনি আরও বলেছেন, রোজাদারদের জান্নাতের ‘রাইয়ান নামক শ্রেষ্ঠ দরওয়াজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের জন্য ডাকা হবে।’ হাদিসে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহপাক বলেন, ‘আদম সন্তানদের সব আচরণ তার নিজের জন্য, কিন্তু ‘সিয়াম’ বা ‘রোজা’ শুধু আমার জন্য। আমি এর জন্য রোজাদারদের বিশেষ পুরষ্কারে ভূষিত করবো।’ রোজা, বিশ্বাসীদের কাছে ঢাল স্বরূপ। পবিত্র কুরআনে রোজার তিনটি মৌলিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এক. তাকওয়া অর্জন। দুই. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা। তিন. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার। রমজানে মুসলিম দুনিয়া জুড়ে যে পুণ্যময় বাতাবরণ তৈরি হয় তা এক কথায় নজিরবিহীন। সৃষ্টি হয় চারিদিকে এক পুণ্যময় পবিত্র পরিবেশ। মুসলিম চেতনায় জাগিয়ে তুলেছে এক অনুভূতি। প্রতিটি ধর্মপ্রাণ রোজাদারের হৃদয়-মনে জাগিয়ে তোলে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা।

রমজান হলো মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম পবিত্র মাস। এ মাস সকল মুসলমানকে নিয়ে আসে এক বিশেষ প্রশিক্ষণের আওতায়। এক নাগাড়ে ক্রমাগত ত্রিশটি দিন, সাতশ’ বিশ ঘণ্টার কঠিন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করা হয়। শেষ রাতে জেগে ‘সেহরি’ খাওয়া, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকা, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা, তারপর রাতের একটি বিশেষ অংশ ‘তারাবিহ’ নামাজে অতিবাহিত করা। এভাবে দীর্ঘ ত্রিশটি দিন ধর্মপ্রাণ রোজাদারদের প্রশিক্ষণ চলে। এ প্রশিক্ষণ আর কিছু নয়, এ হলো ¯্রষ্টার প্রতি আশরাফুল মাখলুকাত মানব সন্তানদের পরম আনুগত্য, সংযম, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আন্তরিকতার অনুশীলন। রমজান যেমন রোজার মধ্য দিয়ে আত্মার উৎকর্ষ বাড়ায়, ঠিক তেমনি রমজানের ‘তারাবিহ’ নামাজ বাড়িয়ে তুলে সামাজিক চেতনাবোধ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে রয়েছে সমগ্র মানবম-লীর জন্য অনুশাসন ও তার বিস্তৃত বিশ্লেষণ। এতে আছে সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। আর এ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে ক্বদরের রাতে। পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে মহিমাময় রাতে। কে জানে এ মহিমান্বিত রাত কী? মহিমামন্ডিত রাত হলো হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। এ রাতে জিব্রাইল (আ.) ও ফেরেস্তারা তাঁদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে ধরায় অবতরণ করেন। এ রাত পরিপূর্ণ শান্তির রাত। ঊষার আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত এর শান্তিধারা ও নিরাপত্তা অব্যাহত থাকে।’
মহাপুণ্যময় এ রাতটি কোন রাত? হেকমতের কারণে মহান আল্লাহ তাআলা সেটি তার বান্দাদের জানিয়ে দেননি। তবে রাতটি হলো রমজানের শেষ দশদিনে। অনেকের মতে, ২৭ তারিখ রাত। কারও কারও মতে শেষ দশদিনের যেকোন বেজোড় রাত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদর’ রমজানের শেষ দশদিনে অনুসন্ধান কর। তাই আমাদেরকে ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ এ রাতগুলো মহিমাময় রাত মনে করে এবাদত করা উচিত। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, আমি সৃষ্টিলোককে নিজস্ব একটি পরিকল্পনায়, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করেছি। এ পরিকল্পনা এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সারা বছরের দিনসমূহের মধ্যে একটি দিনকে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী দিন হিসাবে গ্রহণ করেছি। দিনটি হলো মহিমামন্ডিত ‘লাইলাতুল কদর’। কদর শব্দের দু’টি অর্থ। একটি হলো, ভাগ্য বা পরিমাণ নির্ধারণ, অন্যটি হলো, মহিমাময়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হাজার রাতের চাইতে শ্রেষ্ঠ এ পবিত্র রাতÑ লাইলাতুল কদরের রাত পেয়েও যে ব্যক্তি তাকে কাজে লাগাতে, পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারল না, বঞ্চিত হলো সে দুনিয়ার যাবতীয় কল্যাণকামী কাজ থেকে। তার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই।’ (ইবনে মাজাহ)।

রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করা সুন্নত। ইতেকাফ শব্দটি আরবি ‘আকফুন’ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ নির্জন স্থানে আত্মনিবেদিত হয়ে একান্ত চিত্তে বসে পরম করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার উপাসনা, নাম জিকির করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় মসজিদে পূর্ণ সময় অবস্থান করে ‘ইতেকাফ’ করতে হয়। মহিলারা নিজ নিজ ঘরে থেকেই ‘ইতেকাফ’ করতে পারেন। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মার পবিত্রতা অর্জন, আধ্যাতিক উৎকর্ষ এবং সর্বোপরি স্রষ্টার চরম নৈকট্য লাভের এক মহান সুযোগ হলো এ ‘ইতেকাফ’। রমজানের শেষ দশদিনে ‘ইতেকাফ’ করলে চরম পরম কাক্সিক্ষত হাজার রাতের চাইতে লাইলাতুল কদরের সন্ধানলাভও সম্ভব হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিস্ময়কর রেকর্ড
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতি ঐক্যবদ্ধ
সংস্কার ও জাতির স্বপ্ন
জাতীয় ঐক্য দৃঢ় ও সুসংহত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে  চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন