মনে রাখতে হবে, কৃতঘ্নাতা মানুষের স্বভাবের অংশ
০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪১ এএম
‘রিসার্চ’ হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোনো বিষয়ের ওপর অনুসন্ধান বা গবেষণা। বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা একাডেমিক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একই বিষয়ে গবেষণা করে একেকজন একেক রকম ফলাফল ব্যক্ত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই রিসার্চের নির্যাস বা ফলাফল বিপরীতধর্মী হয়। আবার অনেক রিচার্সের ফলাফল ‘বাণী চিরন্তনী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু গ্রাম-বাংলার জনপদ থেকে উঠে আসা কিছু কথা (বাক্য) সমাজে বাণী চিরন্তনীর মতোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে এ ধরনের কথা সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এ রকমই একটি শ্লোক, ‘আপন থেকে পর ভালো, পরের চেয়ে জঙ্গল ভালো।’
কুরআনে আল্লাহ বহুবার বলেছেন, তিনিই আল্লাহ যিনি সমস্ত ক্ষমতার মালিক। আবার বলেছেন, জগৎসমূহের স্রষ্টা তিনি এবং একমাত্র তার ওপরই নির্ভর করার নির্দেশনাও দিয়েছেন। কারণ, তিনিই একমাত্র সংরক্ষণকারী বা নিরাপত্তাদাতা। তারপরও মানুষ নিজেকে শক্তিশালী ও নিরাপদ করার জন্য আপন বলয় সৃষ্টি করে তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যাদেরকে ‘আপন’ মনে করে দুধকলা দিয়ে লালন করে তারাই স্বার্থে একটু আঘাত লাগলে বা অন্যত্র একটু ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে বিপক্ষ পার্টির কাছে চলে যায় এবং এটিই বর্তমানে সমাজে জোরালো অনুশীলন চলছে, এটি আগেও ছিল। তবে আগে মানুষের চোখে লাজলজ্জার যে পর্দা ছিল বর্তমানে সে পর্দা উঠে গেছে।
মানুষ বড়ই স্বার্থপর, এ কথাটি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে বলে থাকে, মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না। অথচ, মানুষ সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আশরাফুল মাখলুকাত। পৃথিবীতে মানুষ যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার আপন লোক দিয়েই হয়েছে বেশি।
উপমহাদেশে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে চারজন রাষ্ট্রনায়ক খুন হয়েছেন, যথা- ১. শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী; ২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ৩. শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও ৪. বেজনীর ভুট্টো। এ চারজনই খুন হয়েছেন তাদের আপনজনদের ষড়যন্ত্রে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ খুন হয়েছেন এবং দেশের স্বাধীনতা ব্রিটিশের কাছে বিক্রি হয়েছে সিরাজউদ্দৌলাহর আত্মীয় ও প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে। এ ধরনের শত শত ঘটনা বর্ণনা করা যাবে, যারা তার আপন লোকের হাতে খুন হয়েছেন, রাজত্ব হারিয়েছেন, স্বাধীনতা হারিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন, হারিয়েছেন সর্বস্ব।
ইদানিং এটা বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, পুত্র-কন্যা একটি পরিবারের অংশ হওয়া সত্ত্বেও একজন আরেকজনকে খুন করছে। স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, মা-বাবা পুত্রকে, পুত্র-কন্যারা মা-বাবাকে খুন করছে। সব কিছু বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, মানব সমাজের একটি বড় অংশ জংলি জানোয়ারের চেয়ে বেশি হিং¯্র হয়ে পড়েছে। হিংস্র প্রাণীরা হত্যা করে ক্ষুধা নিবারণের জন্য। মানুষ মানুষকে হত্যা করে শুধু স্বার্থের জন্য। স্বার্থ বহু মানুষের বিষণœতা রোগের মতো একটি রোগ, যা সমাজকে ক্যান্সারের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে।
আরেকটি প্রবাদ রয়েছে, ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’। শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘রক্ষকই ভক্ষক’। আমানতের খেয়ানত না করার জন্য কুরআনে বারবার বলা হয়েছে। খেয়ানতকারীকে আল্লাহপাক ক্ষমা করবেন না। বিদায় হজের ভাষণে হজরত মুহাম্মদ সা. অনুরূপ নির্দেশনাই দিয়েছেন। ‘আমানত’ কয়েক প্রকার হতে পারে। কোনো গোপন কথা, স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ, পরিবার-পরিজন, এমনকি ক্ষেত্রমতে নিজ স্ত্রী-সন্তানকে আমানত রাখা হয়ে থাকে। বিশ্বাস করে যার কাছে আমানত রাখা হয়, সে ব্যক্তিই খেয়ানত করে। আমানত সম্পর্কে পরম করুণাময় আল্লাহপাক বলেন, ‘আর যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, যারা সাক্ষ্য দানে অটল ও নিজেদের সালাতে যতœবান, তারাই সম্মানিত হবে জান্নাতে’ (সূরা মা’আরিজ, আয়াত : ৩২-৩৫)। আল্লাহপাক জোর দিয়ে এ নির্দেশনার পুনরাবৃত্তি করেছেন (সূরা মমিনুন, আয়াত : ৮-১১)।
প্রজ্ঞাবান লোকমান হেকিম বলেছেন, ‘মানুষ মানুষের সাথে প্রতারণা করে, গাছ কিন্তু তা করে না।’ লোকমান হেকিমের কথার মর্মমতে বোঝা যায়, ‘প্রতারণা’ করা মানুষের একটি সহজাত ধর্ম। ধর্মীয় নির্দেশনা ছাড়াও প্রতারণাকে বন্ধ করার জন্য বইপুস্তকে বিভিন্ন নীতিবাক্য প্রচার করা ছাড়াও কঠিন কঠিন আইন করেও প্রতারণা বন্ধ করা যায়নি। আইনে যেমন কঠোরতা থাকে তেমনি থাকে প্রতারকদের দুষ্ট বুদ্ধির চাল। সাধারণ মানুষ নিয়মিত প্রতারণার শিকার হচ্ছে, যার মধ্যে বেশির ভাগ প্রতারিত হচ্ছে আপনজন দ্বারা। কারণ, যাকে বিশ্বাস করা হয় তার পক্ষে প্রতারণা করা যত সহজ, বাইরের লোকের পক্ষে তা এত সহজ হয় না। ফলে সহজভাবে আপনজনকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রও পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই নষ্ট হয়েছে। আপনজন যখন প্রতারণা করে, তখন যিনি প্রতারিত হন, তিনি অনেক ব্যথিত হলেও প্রতারক মনে করে এটিই তার সফলতা। আরো মনে করে, প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরে বিশ্বাস স্থাপনের কৌশল তার বিফলে যায়নি।
কৃতজ্ঞতাবোধ একজন মানুষের সহজাত গুণাবলির একটি অংশ হওয়া অপরিহার্য। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ বেশির ভাগ মানুষের থাকে না; বরং যার কাছ থেকে উপকার পায় তার বদনাম করে ও সুযোগ পেলে ক্ষতি করে। এ মর্মে কুরআনে আল্লাহ অকৃতজ্ঞদের সাবধান করেছেন। তিনি বলেন, মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ বলেন: ‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের অবশ্যই অধিক দেবো, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর’ (সূরা ইবরাহিম : ৭-৮)। আল্লাহ আরো বলেন: ‘সুতরাং তোমরা আমাকেই স্মরণ করো আর আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আমার কাছে তোমরা কৃতজ্ঞ হও, আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না’ (সূরা বাকারা-১৫২)। এবং ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো ও বিশ্বাস করো তবে আল্লাহ তোমাদের শাস্তি প্রদান করে কী করবেন? আল্লাহ অত্যন্ত জ্ঞানী, গুণগ্রাহী (সূরা নিসা-১৪৭)।
একজন মানুষের সময় যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন তার আশপাশে আঠা ও জোঁকের মতো লেগে থাকা মানুষগুলো দূরে সরে যাওয়াসহ প্রতিপক্ষের কাছে আপনার দুর্বলতা প্রকাশে আনন্দ পায়। এতে কোনো ব্যক্তিত্ববান ও আত্মমর্যাদাশীল মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কথা নয়। কারণ নিজের ওপর বিশ্বাসই চলার পথে সবচেয়ে বড় শক্তি। অন্যের ওপর আপনি যত নির্ভরশীল হবেন সে আপনাকে তত বেশি পেয়ে বসবে। তখন আপনার দুর্বলতা খোঁজাই হবে সে ব্যক্তির কাজ, যাকে আপনি এতদিন বিশ্বাস করে আসছেন। শুধু তাই নয়, আপনার দুঃসময়ে সে ব্যক্তি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে।
ব্যতিক্রম কিছু থাকে, তারাই হলো প্রকৃত বন্ধু। এ ধরনের বন্ধু কারা তা বিপদে না পড়া পর্যন্ত বোঝা যায় না। মনে রাখবেন, আপনার খারাপ সময়ে সবার দরজা বন্ধ হলেও আল্লাহর দরজা বন্ধ হয় না। খারাপ সময়ে আপনাকে ছেড়ে যে চলে যায় তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে মূর্খতা। মূর্খের সাথে আপনি মূর্খ হবেন তা-ও প্রত্যাশা করা সমুচিত নয়। যিনি আত্মবিশ্বাসী তিনি অবশ্যই এ নীতি, বিশ্বাস করবেন। আপনি যদি নাস্তিক না হয়ে একত্ববাদ সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তবে আপনাকে অবশ্যই আপনার সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভর করতে হবে। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, আপনার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক ও অভিভাবক একমাত্র আপনার সৃষ্টিকর্তা।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে আবুল কালাম বলেছেন, আবহাওয়ার মতো যারা নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে তাদের ওপর নির্ভর করা বা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ সুবিধাবাদী ও যে তাকে ‘ছায়া’ দিয়ে রাখে তারই দুঃসময়ে অবস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র ‘ছায়া’ খোঁজে। এটিই এক শ্রেণির মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। চানক্য বলেছেন, ‘আপনি যদি আপনার দুর্বলতার কথা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করেন, তখন সে আপনার দুর্বলতাকে ব্যবহার করবে।’ ফলে নিজের প্রতি নিজে আত্মবিশ্বাসী হোন এবং সব সমস্যা সমাধানে নিজেকেই প্রস্তুত রাখুন। মনে রাখবেন, আপনার সৃষ্টিকর্তাই আপনার একমাত্র ত্রাণকর্তা।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা
আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প
হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি
রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'
‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’
যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ