খেলাফতে রাশেদার মেয়াদ পূরণকারী পঞ্চম খলিফারূপে ইমাম হাসান (রা.)

Daily Inqilab খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী

০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:০৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:৩৬ পিএম

হজরত আলী (রা.) এর শাহাদাতের পর, অধিকাংশ মুসলমান হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর হাতে পঞ্চম খলিফা হিসাবে বয়াত করেন, যদিও হজরত আমির মোআবিয়া (রা.) ও তার অনুসারীরা ইমামের খেলাফতের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। ইমাম হাসান (রা.) তার পূর্বসুরি চার খলিফার নীতি, আদর্শ, অনুযায়ী খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু হজরত মোআবিয়া (রা.) ও তার অনুসরীদের বিরোধিতায় যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তার পরিণতিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশংকা ছিল এবং কোথাও কোথাও সংঘটিত হয়েছিল। এতদসংক্রান্ত ঐকিহাসিক বিশদ বিবরণে না গিয়ে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, হজরত ইমাম হাসান (রা.) মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর রক্তপাত ও বিবাদ-বিশৃঙ্খলা এড়ানো, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য ও কল্যাণের স্বার্থে হজরত মোআবিয়া (রা.) এর সাথে শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এ চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত তিনি পঞ্চম খলিফা হিসাবে ৬ মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাঁর মহান নানা হুজুর (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী বস্তব রূপ লাভ করে। আর্থাৎ খেলাফতে রাশেদার তিরিশ বছর পূর্ণতা লাভ করে। অতঃপর হজরত আমির মোআবিয়া (রা.) এর ক্ষমতা লাভের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ইসলামে রাজতন্ত্র ও রক্তপাতের ধারা।

খেলাফতে রাশেদার অপূর্ণ মোয়াদ পূরণকারী হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর জন্ম দিন ছিল ইসলামের এক মহানন্দের দিন। তিনি হিজরী সনের ১৫ রমজান মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতের পর দ্বিতীয় বর্ষে রমজান মাসের রোজা ফরজ হয়। এ মাসের প্রথমার্ধে যেসব ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, বদর যুদ্ধ ছিল তার প্রধান। এই বিজয়ের আনন্দের সাথে আরও একটি আনন্দের বিষয় ছিল রমজান মাসে হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর জন্ম। হিজরী তৃতীয় বর্ষের রমজান মাসের দ্বিতীয় দশকে ইমাম হাসান (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, হিজরতের পর মদীনায় মুসলিম পরিবারে প্রথম জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.)-এর পর কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেন তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে দ্বিতীয় হিজরীতে রোজা ফরজ হওয়ার এক বছর পর রমজান মাসে ইমাম হাসান (রা.)-এর জন্ম ছিল এক অতীব আনন্দদায়ক ঘটনা। কেননা ইমাম হাসান ছিলেন হজরত আলী (রা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.)-এর প্রথম পুত্র সন্তান এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অতি প্রিয় দৌহিত্র। রমজান মাসে ইমাম হাসানের জন্ম ছিল এক সৌভাগ্যের বিষয়। তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় মুসলমানদের মধ্যে দারুণ আনন্দের সৃষ্টি হয়। হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর কুনিয়াত বা উপনাম ছিল আবু মোহাম্মদ।

ইমাম হাসান (রা.)-এর জীবনে ব্যতিক্রমধর্মী একটি ঘটনা হচ্ছে এই যে, তাঁর জন্ম যেমন রমজান মাসে, তেমনি রমজান মাসেই তিনি খেলাফত লাভ করেন। হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের পর কুফায় চল্লিশ হাজার লোক হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর হাতে মৃত্যুর উপর বয়াত গ্রহণ করেন। আর রমজান মাসেই হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনকাল ইমাম হাসান (রা.) দীর্ঘকাল না পেলেও নানার আদর্শ শিক্ষা তিনি পরিপূর্ণভাবে পেয়েছিলেন। তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল যে, জন্মের পর তাঁর নানা সাইয়েদুল মোরসালীন স্বীয় দৌহিত্রের কানে আজান ও একামত বলেছিলেন ।

হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুই সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং ইমামের মাতা-পিতার তত্ত্বাবধানে স¤পন্ন হয়। অবশ্য ইমাম হাসান (রা.)-এর সাত বছর বয়সে তাঁর নানা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত হয়ে যায়। তথাপি এই অল্প বয়সেও তিনি কয়েকটি হাদীস সরাসরি তাঁর নানার কাছ থেকে বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৩ বলে উল্লেখিত হয়ে থাকে। সাত বছর বয়সে এতগুলো হাদীস মুখস্থ রাখা একটি অসাধারণ ব্যাপার। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম হাসান (রা.) কী অসাধারণ মেধা ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।ইমাম হাসান (রা.)-এর মহান পিতা, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) রমজান মাসের দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে আততায়ীর তরবারির আঘাতে আহত হন এবং তার শাহাদতের পর ৪০ হিজরীর ২৬ রমজানুল মোবারক মুসলমানগণ সর্বসম্মতভাবে হজরত হাসান (রা.)কে পঞ্চম খলিফা মনোনীত করেন এবং তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তিনি সাত বছর জীবিত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে তাঁকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হয়।হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর ফজিলত তথা শ্রেষ্ঠত্ব স¤পর্কে বহু হাদীস রয়েছে। বোখারী, মুসলিম ও তিরমিজীতে বর্ণিত এক হাদীস অনুযায়ী, হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, আমি নিজের চোখে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দেখেছি যে, তিনি ইমাম হাসান (রা.)কে নিজের কাঁধে বহন করে বলছিলেন, হে আল্লাহ, আমি এই শিশুকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস।

হিজরত ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতে রাশেদার যুগে প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে নিজেই পদত্যাগ করেন এবং চুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা হজরত মোআবিয়া (রা.) এর নিকট হস্তান্তর করেন। বর্ণিত আছে যে, উভয়ের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাঁরা এক সঙ্গে (মাদায়ন হতে) কুফায় প্রবেশ করেন। তখন মুসলিম উম্মার শাসন ক্ষমতা একজন খলিফার হাত হতে বদল হয়ে চলে যাওয়ার পরিণামে এ বছরের নামই হয়ে যায় ‘আমুল জামাআত’ (বা সর্ব সাধারণের দল)। ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে ইমাম হাসান (রা.) বলেছেন: ‘আমির মোআবিয়া (রা.) যদি বাস্তবেই ক্ষমতা লাভের যোগ্য হয়ে থাকেন তা হলে তিনিই আমার চেয়ে অধিক উপযুক্ত বলে আমি মনে করি, আর আমি যদি তার হকদার হয়ে থাকি, তাহলে আমার সেই অধিকার আমি তাকে সমর্পণ করছি এবং এরূপ পদক্ষেপ কেবল উম্মতের কল্যাণ ও কওমকে রক্তপাত হতে রক্ষার স্বার্থে গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ কথাও আমি জানি যে, সম্ভবত এ বিষয়টি তোমাদের জন্য ফেতনা ফাসাদের কারণ হতে পরে। কিন্তু জেনে রাখো, অতঃপর মাত্র কয়েকদিনের (ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার) কর্মতৎপরতা থেমে যাবে।’ এরপর তিনি মদীনায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। তখন কোনো কোনো লোক বলতে শুরু করে যে, কেন তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন? জবাবে তিনি বলেন: আমি তিনটি বস্তুকে পছন্দ করেছি: ১. বিবাদ বিশৃংখলার স্থলে জামাতবন্দি বা বৃহত্তর ঐক্য। ২. সহিংসতা ও রক্তপাতের বদলে মুসলিম উম্মাহর সংহতি রক্ষা করা। ৩. এবং আগুনের (জ্বালাও পোড়াওয়ের) পরিবর্তে লজ্জাসম্ভ্রম ও ইজ্জতআব্রু রক্ষা করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত হাসান (রা.)কে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আবুবকর সিদ্দীক (রা.) বর্ণনা করেন: আমি রসুল (সা.)কে মিম্বরে উপবিষ্ট দেখি এবং তার পাশে হাসান (রা.)কে ধরে রেখেছেন, একবার তিনি লোকদের দিকে তাকাচ্ছিলেন আবার হাসানের দিকে। অতঃপর তিনি বললেন: আমার এই পুুত্র (দৌহিত্র) সর্দার হবে এবং আমি আশা করি, সে মুসলমানদের দুইটি বড় দলের মধ্যে শান্তি-শৃংখলা স্থাপন করবে। (ছহীহ হাদীস) ইমাম হাসানের ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনাটা ছিল বাস্তবে হুজুর (সা.) এর এ ভবিষ্যদ্বাণীর মোজেজা স্বরূপ।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আইএমএফ’র ঋণের প্রশ্নে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুদয়
শিক্ষাব্যবস্থার ব্ল্যাকবক্স খোলার এখনই সময়
আরও
X

আরও পড়ুন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

সকালে ব্রিদিং এক্সারসাইজের উপকারিতা

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

মতলব দক্ষিণ থানার এসআই জীবন চৌধুরীর বেতন বন্ধের নির্দেশ

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

সাবেক এমপি কেরামত আলী গ্রেফতার

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে মেশিন বিস্ফোরণে ২জন শ্রমিক দগ্ধ

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটলেন নেতানিয়াহু

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

বিক্ষোভে উত্তাল মণিপুর, নেতার বাড়িতে আগুন দিলো জনতা

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ঢাকায় ৪ দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন আজ শুরু

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

ইয়েমেনে সর্বশেষ মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৪

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশকে হুমকি ইরানের, যুদ্ধের শঙ্কা

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

রাজধানীর বংশালে আগুন, নিহত ১, আহত ৭

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে আজ ধর্মঘট

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

দুর্ঘটনার কবলে জামায়াত নেতাকর্মীদের বহনকারী বাস, নিহত ৩

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঈদকে কেন্দ্র করে কৃষি নির্ভর বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

ঝড়ো বাতাসে যমুনা নদীতে আটকে ছিল ফেরি

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে লেবাননের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মার্কিন দূতের বৈঠক

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ

ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বৈশ্বিক কর্মসূচিতে সংহতি, দেশব্যাপী ধর্মঘট আজ

এনসিপি কর্মীদের ধর্ষণের হুমকি পাওয়া সেই ছাত্রদল নেত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা

এনসিপি কর্মীদের ধর্ষণের হুমকি পাওয়া সেই ছাত্রদল নেত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টা