ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

কেন এত রোগব্যাধি

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:০৬ এএম

আগে সংবাদপত্রেও মৃত্যু সংবাদ লিখতে গিয়ে অনেকের ক্ষেত্রে বলা হতো, তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। এসব ক্ষেত্রে মৃতদের অধিকাংশের বয়স উল্লেখ থাকতো ৭০ বছরের ওপর। এখন এমন সংবাদ দেখা যায় না। অধিকাংশের মৃত্যু সংবাদে বলা হয়, তিনি দীর্ঘদিন যাবত ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি রোগে ভুগছিলেন। আর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর খবরতো এখন সাধারণ সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজে আগে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দেখা যেত, যাঁরা বেশ শারীরিক সুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকতেন। এখন ৫০ বছর পেরুলেই অনেকে ডায়াবেটিস নয়তো ক্যান্সার, নয়তো লিভার, নয়তো কিডনি ইত্যাদির মতো জটিল রোগে ভুগছেন। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের যন্ত্রণাতো আছেই।
অনেকের মনে হতে পারে যে, আগেও এসব রোগে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তবে তা নির্ণীত হতো না বলে জানা যেত না। এটিও সত্য, তবে তা পুরোপুরি নয়। ডাক্তার চিহ্নিত করতে পারেননি এমন রোগ হলে সাধারণ মানুষ মনে করতো ভূত-জিনের আছর বা তাবিজ টোনা বান মারার কারণে মৃত্যু হচ্ছে। এসব বিশ্বাস করতে গিয়ে কত লোক অপচিকিৎসায় মারা গেছে, তার হিসাব নেই। এখনো অনেকে এমন তাবিজ টোনায় বিশ্বাস করে। অনেকে ‘বাবা’দের কাছে যায় আধ্যাত্মিক শক্তির জোরে ভালো হওয়ার আশায়। গ্রামে এখনো মানসিক রোগীদের জিনে ধরেছে বলে অপচিকিৎসা দেওয়া হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন রোগ নির্ণয় সহজ হয়েছে বটে তবে একথা স্বীকার করতে হবে যে, রোগ-বালাই পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি হচ্ছে। এখন শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না মরণঘাতী রোগ-বালাই থেকে। কিডনিরোগ, লিভার ক্যানসারের মতো রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। চিকিৎসকরা বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন। মাত্র ২০ বছর আগেও দেশে এত ক্লিনিক হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ছিল না। এখন শত শত ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার হয়েছে। যাঁদের এসব স্থানে এখন যেতে হচ্ছে তারা জানে এখানে প্রতিদিন কী পরিমাণ রোগীর ভিড় হয়ে থাকে। আগেও শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়ায় ডাক্তারখানা ছিল। প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ও এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকরা সেখানে বসতেন। সন্ধ্যার দিকে তাদের চেম্বারে সামান্য ভিড় দেখা যেত। এসব চিকিৎসক অনেক সময় রোগীর বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা দিতেন। তাঁদের ফিস ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। চোখ দেখে, নাড়ি টিপে, বুকে-পিঠে স্থেটিস্কোপ বসিয়ে তাঁরা রোগ নির্ণয় করতেন। ছোটখাটো অপারেশন তাঁরা নিজেরাই চেম্বারে সেরে নিতেন। এমন চিকিৎসকদের অনেককে দেখেছি, রোগীদের পারিবারিক খোঁজ-খবরও নিতেন। অনেক সময় স্যাম্পল হিসাবে পাওয়া ওষুধ রোগীদের দিয়ে দিতেন। আমি ডাক্তারের ফিস বাকি রাখতেও দেখেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। পাড়ায় পাড়ায় আর আলাদা ডাক্তারখানা নেই। চিকিৎসকরা সবাই ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও চমৎকারভাবে সজ্জিত এইসব প্রতিষ্ঠানে চাকচিক্যের সাথে সাথে চিকিৎসককে দেখানোর ঝক্কি-ঝামেলা বেড়েছে। চিকিৎসকের ফিসও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন সামান্য সর্দি-জ্বর নিয়েও ওইসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আগে সিরিয়াল নিতে হয় এবং অনেকক্ষণ দুর্বিষহ অপেক্ষার পর চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে প্রচুর টেস্ট করার স্লিপ হাতে ধরিয়ে দেয়া। প্রয়োজন নেই এমন অনেক টেস্টও করান কিছু কিছু চিকিৎসক। তারা নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে থেকে ২০-২৫% কমিশন নিয়ে থাকেন এমন অভিযোগও রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে কোনও এক গ্রামে একটি মুদির দোকানের সামনে অপেক্ষা করছিলাম। মধ্যবয়েসি এক লোক এসে দোকানিকে বললেন, দুটো জ্বরের, দুটো গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট আর আধা কেজি মশুর ডাল দেন। এই বলে তিনি দোকানির সামনে একটি ১০০ টাকার নোট রাখলেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুধু গ্রামে নয় শহরেও অনেক মুদি বা পান-সিগারেটের দোকানেও অনেক ধরনের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে আজকাল।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ ওষুধের দোকান আছে এবং এরা যে পদ্ধতিতে ওষুধ বিক্রি করে তা বিশ্বের কোনো উন্নত সভ্য দেশে সম্ভব নয়। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায়ও এভাবে বিক্রি করার নিয়ম নেই। কিছুদিন আগে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা গিয়েছিলাম, সেখানে ওষুধের দোকান দেখিনি। এত এত ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চোখে পড়েনি। বাংলাদেশে কোথাও তিনটি দোকান থাকলে তার মধ্যে প্রথমেই থাকবে একটি চায়ের দোকান। তারপর একটি ওষুধের দোকান তৃতীয়টি অধুনা মোবাইলে টাকা জমা ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হবে।
পশ্চিমারা বলে, তাদের প্রকৃত জীবন শুরু হয় ৫০ থেকে আর আমাদের দেশের মানুষ ৫০ বছর পেরুলেই বেহেস্ত-দোযখের চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে দেহে একাধিক রোগের অস্তিত্ব রেখে। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ ছাড়া বাংলাদেশের মতো এমন রোগাক্রান্ত আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। আগের তুলনায় এখন চিকিৎসার সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও তাতে সংকুলান হচ্ছে না রোগীর। আবার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থাও রাখছে না অধিকাংশ রোগী। ফলে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। চিকিৎসা খাতে বছরে কত হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও নেই হয়ত কেউ দিতেও পারবেন না। অনেকে অভিযোগ করেন চিকিৎসার নামেও দেশ থেকে বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে অর্থ। শুধু শারীরিক রোগের ক্ষেত্রেই নয়, মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীর সংখ্যাও দেশে উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিল, দেশের ৬০ শতাংশ লোক মানসিকভাবে অসুস্থ। এইসব বিষয়ে উদাসীনতার কারণে মানুষ তা বুঝতে পারছে না। এই ধরনের একটি অসুস্থ জাতির ভবিষ্যৎটা কী? আমরা কি কিছু ভাবছি তা নিয়ে? সরকার আছে তার নানা উন্নয়ন কাজের চিত্র তুলে ধরার কাজে। বিরোধীদল আছে আগামী নির্বাচনে কি করলে জেতা যাবে তার ধান্ধায়। দেশের কিছু রাজনীতিক আছেন লুটপাট করতে না পারার আফসোসে। ইসলামী চিন্তাবিদরা আছে ধর্মানুভূতিতে কোনো ধরনের আঘাত লাগে কিনা সে দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতে, উগ্রবাদীরা আছেন মানুষ মেরে জিহাদ করতে। ছাত্র ও যুবনেতারা আছেন দামি মোবাইলে সেলফি তুলতে। পুলিশ আছে সব ধরনের অনৈতিক কাজে কীভাবে সহায়তা করা যায় তা খতিয়ে দেখতে। এনজিও কর্মকর্তা, সমাজকর্মীরা আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে গলায় টাই লাগিয়ে সেমিনারে বক্তব্য উপস্থাপনে। 
   অন্যদিকে একটি জাতি ধীরে ধীরে ক্ষয়ের দিকে, নিঃশেষের দিকে, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে কারো খেয়াল নেই। দেশের মানুষ এত অসুস্থ হচ্ছে কেন? এর কারণ ও প্রতিকারে কেউ এগিয়ে আসছে না। সরকারের একটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আছে। তারাও কোনোদিন এমন প্রশ্ন তোলেনি। যে চিকিৎসকরা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগে মাসে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন তারাও কোনো দিন একটু মানবতার খাতিরেও কোনো ফোরামে কিংবা কোনো আলোচনায় প্রশ্ন তুললেন না, এত এত মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে কেন? 
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বহিঃশক্তি শকুনের মত শিল্প কলকারখানায় থাবা দেয়ার চেষ্টা করছে : শিমুল বিশ্বাস

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা

বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বরদাশত করা হবে না: আইন উপদেষ্টা