পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্কট দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে
১৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২২ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:০০ পিএম

আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্প আশির দশকে শুরু হলেও মূলত ২০০০ সালের পর থেকে এর বিস্তার ঘটে। বর্তমানে দেশে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারির সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি। ইতিপূর্বে এই হ্যাচারিগুলো থেকে প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদন হতো প্রায় ২৩ থেকে ২৫ লক্ষ পিস। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭ থেকে ৮ লক্ষ পিস। হ্যাচারিগুলোর মুরগির বাচ্চা কম উৎপাদনের কারণ হিসেবে জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের কারণে হ্যাচারিগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনের খরচের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রয় হয়েছে। ঝিনাইদহের ইউনিভার্স্যাল পোল্ট্রি হ্যাচারির বাচ্চা বিক্রয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রতিটি বাচ্চার উৎপাদন খরচ ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। কিন্তু ২০১৯ সালে গড় বাচ্চা বিক্রয়মূল্য ছিল প্রতি পিস মাত্র ২৭ টাকা, ২০২০ সালে ছিল মাত্র ১৪ টাকা, ২০২১ সালে ছিল মাত্র ২৯ টাকা ও ২০২২ সালে ছিল ২৭ টাকা। ২০১৭ সালে প্রতি কেজি মুরগির খাদ্যের মূল্য ছিল মাত্র ২৬ টাকা, ২০১৮ সালে ছিল ২৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ২৮ টাকা ১৫ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল ৩১ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২১ সালে ছিল ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২২ সালে হলো ৪২ টাকা ৯০ পয়সা। ২০২৩ সালের শুরু থেকেই বর্তমানে প্রতি কেজি মুরগির খাদ্যের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। একই নিয়মে মুরগী পালনে ভ্যাক্সিন, মেডিসিন, খাদ্য উপকরণ ও সরঞ্জামাদি, বিদ্যুৎ, ডিজেল, শ্রমিকের বেতন ও পরিবহনসহ সবকিছুর দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। গত ৫ বছরে হ্যাচারিগুলোর লোকসানের কারণ ছিল চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদন, পোল্ট্রি চাষে বিদেশি কো¤পানির অনুপ্রবেশ, শুধুমাত্র রান্নার মাংস হিসেবে ব্যবহার করা, বিদেশে রপ্তানি না হওয়া, সরকার কর্তৃক উৎপাদিত মুরগির নির্ধারিত মূল্য না থাকা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার-ল্যাবরেটরি না থাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে করোনার প্রভাব, মুরগির মাংসের উপকারিতা স¤পর্কে ভোক্তার ধারণা না থাকা, মুরগির খাদ্য, ঔষধ-ভ্যাক্সিন, অন্যান্য উপকরণের অধিক মূল্য বৃদ্ধি এবং পোল্ট্রি মুরগি নিয়ে নানারকম অপপ্রচার।
২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে উৎপাদিত কমার্শিয়াল ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১২৫ টাকার মধ্যে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময় ধরে ব্রয়লার মুরগির পাইকারী মূল্য ছিল ৯৫ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। গত ৫ বছরে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলো কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে বন্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে অধিকাংশ কমার্শিয়াল ফার্মগুলো দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এই দীর্ঘমেয়াদী লোকসানের কারণেই একদিকে হ্যাচারির বাচ্চা উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসছে, অন্যদিকে কমার্শিয়াল ব্রয়লার মাংস উৎপাদনকারী ফার্মগুলো মূলধন ও বাচ্চা সংকটের কারণে বর্তমানে উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
প্রোটিনের উৎস হিসেবে উন্নত বিশ্বে যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকায় বছরে একজন মানুষ গড়ে মাংস খায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। মালয়েশিয়ায় প্রতিজন গড়ে বছরে মুরগির মাংস খাচ্ছে ৪০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে প্রতিজন মুরগির মাংস খায় বছরে মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি। উন্নত দেশের মানুষ আমাদের দেশের তুলনায় মুরগির মাংস খায় ৮ থেকে ৯ গুণ বেশি, ডিম খায় ৭ থেকে ৮ গুণ বেশি। দেশে মুরগির মাংস এবং ডিমের চাহিদা এত কম থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বাচ্চা ও মুরগির দাম না বাড়ার কারণ ছিল বিদেশি কোম্পানিগুলোর দেশে অনুপ্রবেশ। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড কোং সিপি বাংলাদেশ, চায়নার নিউহোপ, ইন্দোনেশিয়ার জাফপা ভারতের সগুনা ও ভেনকিজ প্রচুর পরিমাণে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদন করছে। দেশে চাহিদা অনুযায়ী ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন না হওয়ায় কখনো উৎপাদিত বাচ্চার দাম প্রতি পিস ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা আবার কখনো ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা হচ্ছে। এতে একদিকে হ্যাচারি ও কমার্শিয়াল ফার্ম লোকসান গুনছে, অন্যদিকে কখনো কখনো অধিক হারে বাজার বেড়ে যাচ্ছে।
মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মুরগির মাংসের মাধ্যমে প্রোটিনের অভাব দূর করা সম্ভব। চাহিদা মতো মুরগির মাংস খেলে প্রোটিনের অভাব পূরণের মাধ্যমে নিউরোট্রান্সমিটার সঠিকভাবে কাজ করবে। এতে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, কাজের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
পোল্ট্রি শিল্পের স্বার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (প্রাণী সম্পদ)কে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনিয়ন্ত্রিত পোল্ট্রি শিল্পকে শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে। বিদেশি যে সমস্ত বড় বড় মুরগীর ফার্ম আমাদের দেশে জেঁকে বসেছে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হ্যাচারিগুলোকে অবশ্যই শৃংখলার মধ্যে থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা উৎপাদন করতে হবে অথবা উৎপাদনের সাথে মিল রেখে মুরগির মাংস বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। হ্যাচারীর উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য প্রতি পিস কমপক্ষে ৫০ টাকা ও উৎপাদিত মুরগির দাম কমপক্ষে ২০০ টাকা প্রতি কেজি নির্ধারণ করতে হবে। পোল্ট্রি মুরগি নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ করে দেশের মানুষের মুরগির মাংস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন খাবারের সাথে মুরগির মাংস সংযুক্ত করে দেশে এর ব্যবহার বাড়াতে হবে, পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। তাছাড়া পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিনা সুদে ব্যাংক লোন ও কৃষিভিত্তিক বিদ্যুৎ বিলের সুযোগ দিতে হবে। পোল্ট্রি মুরগি পালনে ভ্যাক্সিন, মেডিসিনসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক উপজেলায় ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দিতে হবে।
দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোল্ট্রি শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানি করলে এই শিল্প প্রসারের সাথে সাথে অনেকাংশে বেকার সমস্যা দূর করাসহ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। কাজেই এ শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, এখনই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সু-পরিকল্পিতভাবে পোল্ট্রিনীতি বাস্তবায়িত হলে এই শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব। এতে বেকার সমস্যা দূর হবার সাথে সাথে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
makader1958@gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

প্রশাসনের ঢিলেঢালা আচরণে দুষ্কৃতিকারীরা সমাজে আশকারা পাচ্ছে: রিজভী

মঁদিকে হারাল রিয়াল

৬ জেলায় মৃদু তাপপ্রবাহ, সিলেট বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে

নোয়াখালীতে বিধবার ঘরে ঢুকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ডাকাতি

আড়াইহাজারে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে টহল পুলিশের গাড়ির ধাক্কা, পুলিশ সদস্যসহ ৭ জন আহত

ইউক্রেনে শান্তি চায় না ইউরোপীয় দেশগুলো, রাশিয়ার অভিযোগ

তালতলীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ বন্ধ করে পায়রা নদী রক্ষার দাবি

কক্সবাজার পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিব

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের জন্য আইনি-লিগ্যাল নোটিশ

কিম জং উনের সঙ্গে এখনো ভালো সম্পর্ক: ট্রাম্প

গুয়ানতানামো বে খালি, অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনলো যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের সংস্কারে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘের

গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা, ন্যাটোকে যুক্ত করতে চান

ভারতের কেন এত ভয় বাংলাদেশ নিয়ে? বারবার কেন হাসিনাকেই চায় ওরা?

মহেশপুর সীমান্তে ভারতীয় নাগরিক আটক

নোয়াখালীতে বিআরডিবির অর্থ কেলেঙ্কারি: আওয়ামীলীগ নেতার ১১ বছর জেল, ৩১ লাখ টাকা জরিমানা

ন্যাটোর অস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান রুটের

৯ মিনিটেই শেষ ট্রেনের আগাম টিকিট, আধাঘণ্টায় ২০ লাখ হিট

যুক্তরাষ্ট্রে বিমানবন্দরে ১৭৮ আরোহীবাহী বিমানে ভয়াবহ আগুন

প্রিন্সিপাল মুফতি আব্দুল মতিনের প্রথম জানাজায় মুসল্লিদের ঢল