ঢাকা   শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে বৈষম্য বাড়ছেই

Daily Inqilab রিন্টু আনোয়ার

১১ মে ২০২৩, ০৮:১৩ পিএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম

দেশের আয়-উন্নতির পাশাপাশি বৈষম্য বৃদ্ধি এবারের পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জরিপেও। এ ধারা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস পরিচালিত গত এক যুগের তিনটি খানা জরিপেই। সেই বিবেচনায় এটি নতুন ঘটনা নয়। এর কারণ বা রহস্য ভেদ করা কঠিন না হলেও নানা কারণে বিষয়টিতে ঢুকতে চান না অনেকে। এছাড়া অর্থনীতির সোজা বিষয়গুলোকে কঠিনভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে ঘোরের মাঝে ফেলার একটি বাতিক আমাদের সমাজে রয়েছে।

অর্থনীতির সব বিষয় বুঝতে সংজ্ঞা জানা জরুরি নয়। কিছু বিষয় আছে, যার যার জায়গা থেকেও বোঝা যায়। আয়-ব্যয়. উন্নয়ন-অবনতির বৈষম্যের মূল কারণ যে রাষ্ট্রীয় সম্পদে সবার সমান ভোগের অধিকার না থাকা, তা এর শিকাররা ভালো মতোই বোঝে। সুফলভোগীরা তো জানেই। কিন্তু, স্বীকার পর্বে যাবে কেন তারা? এবারের প্রতিবেদনও বলছে, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় কম। ব্যয়ও কম। শহরে আয় বেশি, ব্যয়ও বেশি। খানা জরিপ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২২ সালে দেশে খানাপ্রতি মাসিক গড় আয় পাওয়া গেছে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। ছয় বছর আগে এটি ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে মানুষের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আবার খরচও বেড়েছে প্রায় একই হারে। ২০২২ সালে খানাপ্রতি মাসিক ব্যয় পাওয়া গেছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। ছয় বছর আগে তা ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।

সম্পদের ওপর হক বা অধিকারের জায়গাটি ক্রমেই একতরফা হয়ে যাচ্ছে। বিলে, নদীতে মাছ ধরা, বনে কাঠ কাটার মতো নি¤œমানের কাজেও এখন নিম্মস্তরের মানুষের অধিকার নেই। তাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বালু মহাল, পানি মহাল, মাছ মহাল থেকে বিতাড়িত হয়ে গেছে আরো আগেই। অতিরিক্ত ক্ষমতাবানরা অতিরিক্ত পুঁজি ও সম্পদেরও মালিক। তারা দ্রুত উঠে যাচ্ছে। পেছনে তাকানোর কোনো দরকার পড়ে না তাদের। কার মাথার পেছনে কতো আয়, তা দেখার দরকারই বা কী? তাদের এ চর্চা ও মানসিকতা বাদবাকিদের কেবল অসহায়ই করছে। যে আয় মানুষের মাথার পেছনে থাকে, জনগণ যে আয় দেখতে পায় না, তাকে মাথাপিছু আয় মনে করা ছাড়া অসহায়দের এখন করার কিছু থাকছে না। সরকারি পর্যায় থেকে মাথাপিছু আয়ের যে অংক ও যুক্তি দেখানো হয়, তাতে সায় দেয়ার বহু লোক আছে। মন্ত্রী পর্যায় থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, মানুষের কেনাকাটা অনেক বেড়েছে। গ্রামে গেলেই দেখা যায়, মানুষ কেনাকাটা করছে। তার মানে মানুষের আয় বেড়েছে। কার ঠেকা লেগেছে এমন যুক্তির খুঁত ধরে বিড়ম্বনায় পড়ার? মানুষের প্রকৃত আয় কতটা বেড়েছে, সেই প্রশ্ন সামনে আনাও বিপজ্জনক।

বিষয়টি আসলে গড়ের অংকের। মাথাপিছু আয় বাড়লেই সব মানুষের আয় সমানভাবে বাড়বে, বিষয়টি তেমন নয়। কারো আয় অনেক বাড়লেও মাথাপিছু আয় বাড়তে পারে। আর সেক্ষেত্রে মানুষ এই তথ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে নাও পেতে পারে। গড় আয় সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় নির্দেশ করে না কখনোই। আয় বৈষম্য বেশি হলে সাধারণ মানুষের আয় কমলেও মাথাপিছু তা বেশি হয়ে যায়। অংকের ফেরটা না বোঝায় মানুষ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সংবাদ দেখে একে রসিকতা মনে করে কষ্ট পায়। কিছু মানুষের আয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি মানে অন্য অনেকের আয়ে অস্বাভাবিক কমতি। একদিকে এত এত ধনীর গল্প, আরেকদিকে দারিদ্র্যের হারের এমন বৃদ্ধি একটি কঠিন সত্যের সামনে মানুষ।

এত ধনী বাড়লে কর বাড়ছে না কেন? একটি মহলের কাছে বাংলাদেশ এখন টাকা বানানোর মেশিন। তারা অর্থ-সম্পদ আহরণ করে এখানে। পাচার করে বিদেশে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ দেশে ট্যাক্স দেয়ার প্রশ্ন আসে না। তাদেরই একটা অংশ আবার দেশের ভূমি, জলাভূমি, শহর, বন্দর, ব্যবসা বাণিজ্য আর ক্ষমতা কব্জা করে একটা চকচকে জীবন উপভোগ করছে। আর বাকিরা কেউ মধ্যবিত্ত বা নি¤œ মধ্যবিত্ত, কেউ নি¤œবিত্ত এবং বড় অংশ দারিদ্র্যসীমারও নিচে। করোনার সময় যখন এক ধাক্কায় বহু মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে, ঠিক একই সময়ে এমন অবস্থায় একটা শ্রেণি তাদের সম্পদ ও অর্থ আরও বাড়িয়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নতুন করে অর্থনীতি সঙ্গীন অবস্থায় পড়াও ধনীদের সম্পদ বাড়ানোর মওকা এনে দিয়েছে।

আয়-উন্নতিসহ শর্টকাটে অর্থবান বা নিঃস্ব; কোনোটারই এমন আচানক দৃষ্টান্ত বিশ্বের আর কোথাও নেই। নিয়মশৃঙ্খলা থাকলে অর্থবান হতে সময় লাগে। নিঃস্ব হতেও লাগে। বাংলাদেশই পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যেখানে যে কোনো অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ানো যায়। সেটা খাদ্যপণ্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেলের দাম, পরিবহনের ভাড়া এমনকি হজযাত্রীর খরচও। রোজা, ঈদ, পূজা, পার্বণ, যুদ্ধ, মহামারী, বন্যা, খরা এখানে টাকা কামাইর মৌসুম। এক শ্রেণির এভাবে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আরেকটি শ্রেণি ডুবছে। এদের ওপর পা দিয়েই তো অন্য শ্রেণির লাফ দেয়া। একদিকে দেখা গেছে, ইফতারের টেবিলে বাহারি নানা পদ, আরেকদিকে মুরগির পা, গিলা, কলিজা, চামড়া কিনে বাড়ি ফেরার খবর। নি¤œবিত্ত ক্রেতারা আস্ত মুরগি কিনতে পারছে না বলে বিক্রেতারা পিস হিসেবে বিক্রি করছে। বলা হচ্ছে, বাজারে মুরগির দাম নির্ধারিত হয় অদৃশ্য উৎস থেকে আসা এসএমএসের মাধ্যমে। বড় কয়েকজন উৎপাদক মিলে যে দাম স্থির করে, অন্যরাও সে দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

ক্ষমতাসীন মহলের স্বীকার-অস্বীকার এখানে বিষয় নয়। সরকারের দায়িত্ব ছিল বাজারকে অসাধু তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সামথ্যের মধ্যে রাখা। সরকার তা না করে সুবিধা করে দিচ্ছে গুটিকয়েক বৃহৎ ব্যবসায়ীর। একদিকে তেলের দাম, পরিবহন খরচ বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে এ উৎপাদন খরচের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুর দায় চাপানো হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার-সংকটের ওপর। ভাবখানা এই যে, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, এটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের হাতেও নেই।

সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো কী বলল বা অর্থনীতির বিশারদরা কী তত্ত্ব দিলেন, তা দিয়ে মানুষের মন ভরবে না। এসব দেখার সময়ও নেই তাদের। তারা যে আসলে মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চায়, এমনও নয়। মূল্যস্ফীতির অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি ও টাকার মান কমে তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে গেছে তা নিজেই বোঝে। আরেকজনকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। ব্যয়ভারে জীবন সংকুচিত হয়ে যাওয়া কে না বোঝে? একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে এখন এক লাইনের একটা ঘোষণা দিলেই হয়। সরকার এমন শক্তি হাতে নিয়েছে আইনের মাধ্যমে। সারের দামও আবার বেড়েছে। কৃষকের চিড়েচ্যাপ্টা হতে আর কী লাগে? জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতকে বলা হয় অর্থনীতির লাইফ লাইন, যা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের মতো। সব ধরনের পণ্য, সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া বৈশ্বিক বা মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাই করা যায় না। যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে বা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও পড়ে। আকস্মিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ছে, বাড়তেই থাকবে।

সাধারণ মানুষ নামে চিহ্নিত কষ্টে-শিষ্টে দিন কাটানো মানুষও অর্থনীতি একদম বোঝে না তা ভাবা ঠিক নয়। অন্তত নিজের অংশটা অবশ্যই বোঝে। জানে কী হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে, ডলারের রিজার্ভ কত, খেলাপি ঋণ কত, কে বা কারা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেয় না। আশপাশে আরো কে কোথায় কী করে সেইসব খবরও টুকটাক রাখে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শেখ রাসেলকে হারালো আবাহনী

শেখ রাসেলকে হারালো আবাহনী

নারী প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ শুরু শনিবার

নারী প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ শুরু শনিবার

চীনে ছয় পদক জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উশু

চীনে ছয় পদক জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উশু

এসটিপি ছাড়া নতুন বিল্ডিং করার অনুমোদন কেউ পাবে না: গণপূর্তমন্ত্রী

এসটিপি ছাড়া নতুন বিল্ডিং করার অনুমোদন কেউ পাবে না: গণপূর্তমন্ত্রী

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে -বিক্ষোভ সমাবেশে খেলাফত মজলিস

ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে -বিক্ষোভ সমাবেশে খেলাফত মজলিস

বকেয়া বেতন চাওয়ার কারনে গৃহকর্মীকে নির্যাতন

বকেয়া বেতন চাওয়ার কারনে গৃহকর্মীকে নির্যাতন

মায়ের দূর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

মায়ের দূর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অসাধু কর কর্মকর্তারা : সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে

উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অসাধু কর কর্মকর্তারা : সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে

দু’সহোদর হাফেজ শ্রমিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে -মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ

দু’সহোদর হাফেজ শ্রমিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে -মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর

মির্জাপুরে রাজশাহী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ১০ যাত্রী আহত

মির্জাপুরে রাজশাহী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন ১০ যাত্রী আহত

ফরিদগঞ্জে বিয়ে না দেওয়ায় মাকে গলা কেটে হত্যা

ফরিদগঞ্জে বিয়ে না দেওয়ায় মাকে গলা কেটে হত্যা

মোদির গোলামির জিঞ্জিরে দেশকে আবদ্ধ করেছে সরকার -মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম

মোদির গোলামির জিঞ্জিরে দেশকে আবদ্ধ করেছে সরকার -মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম

গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ

গাজায় ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে লাগতে পারে ১৪ বছর : জাতিসংঘ

তীব্র তাপদহে বৈরী আবহাওয়া, ভোরে কুয়াশা, মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোওয়া অনুষ্ঠিত

তীব্র তাপদহে বৈরী আবহাওয়া, ভোরে কুয়াশা, মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোওয়া অনুষ্ঠিত

ফতুল্লায় ৫ যুবক আটক, ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’র অভিযোগ

ফতুল্লায় ৫ যুবক আটক, ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’র অভিযোগ

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকের মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকের মৃত্যু

মন্দিরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তভিত্তিক বিচারের দাবি

মন্দিরে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তভিত্তিক বিচারের দাবি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান

ইরানের কৃষি-খাদ্য রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ

ইরানের কৃষি-খাদ্য রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ