ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ক্রমবর্ধমান তালাক প্রতিকারের উপায়

Daily Inqilab প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

০৩ জুলাই ২০২৩, ০৮:২৫ পিএম | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএস (Bangladesh Bureau of Statistics)-এর ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ (the situation of vital statistics) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা ১৭ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশের বেশী বেড়েছে। ‘দৈনিক প্রথম আলো’ ১৩ জুন ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি তালাক’। এর মধ্যে গড়ে ৭০ শতাংশ আবেদন এসেছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষের অভিভাবকদের মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতার বিধান রয়েছে। কিন্তু সমঝোতা হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম।

ঢাকা বা ঢাকার বাইরে যত তালাকের ঘটনা ঘটছে, তার কারণ প্রায় সব একই। যেমন স্বামী ও স্ত্রীর পরিবারে সমতা না থাকা, দ্বীনদারীর চাইতে সম্পদকে অগ্রাধিকার দেওয়া, নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া, তাদের স্বাধীন ও উচ্চাভিলাষী হওয়া, যৌতুকের জন্য স্বামীর নির্যাতন, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, পরনারীর সঙ্গে স্বামীর স¤পর্ক, স্ত্রীর পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি।

আধুনিক বিশ্বে নারী অধিকার আন্দোলন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, সমানাধিকার আন্দোলন প্রভৃতি যত যোরদার হচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার। ক্যারিয়ার সচেতন শিক্ষিতা ও স্বাবলম্বী নারীরা এখন বিয়ের চাইতে নিজেদের কর্মজীবনের সফলতার প্রতি বেশী সচেতন। আর এই অতি সচেতনতা তার এমন আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে যে, দা¤পত্য স¤পর্ক, সন্তানের স্বার্থ, সামাজিক বন্ধনের মত অপরিহার্য ও বাস্তব বিষয়গুলো তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে উঠছে। ফলে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, বিবাহ বিচ্ছেদের ৭০/৭৫ ভাগ আবেদনই এসেছে নারীদের পক্ষ থেকে। এতে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আর সন্তান থাকা অবস্থায় যদি তালাকের ঘটনা ঘটে, তবে পিতা-মাতার স্নেহ বঞ্চিত ওই সন্তানটি প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠে। ফলে পরবর্তীতে তার বা তাদের অপরাধী হয়ে ওঠার আশংকা থেকে যায়।

ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহ প্রেরিত স্বভাবধর্ম। এখানে বিবাহকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষ হ’তে ‘দৃঢ় অঙ্গীকার’ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে (নিসা ২১), বৈধ অভিভাবক ও দুইজন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীর মাধ্যমে যা সম্পন্ন হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের বংশধারা রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন (নিসা ১)। তিনি বলেন, ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হ’ল, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হ’তেই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের স্ত্রীদের, যাতে তোমরা তাদের নিকট স্বস্তি লাভ করতে পার। আর তিনি তোমাদের উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা ও দয়া। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনসমূহ রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (রূম ২১)।

এই পবিত্র বন্ধনের বিপরীত হ’ল ‘তালাক’ বা বিবাহ বিচ্ছেদ। বাধ্যগত কারণে ইসলাম এটাকে জায়েয রেখেছে। কিন্তু নিরুৎসাহিত করেছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে তার স্ত্রীর নিকটে শ্রেষ্ঠ’ (তিরমিযী হা/৩৮৯৫; মিশকাত হা/৩২৫২)। তিনি বলেন, ‘যদি আমি কাউকে নির্দেশ দিতাম আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সিজদা করার জন্য, তাহ’লে আমি স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য’ (ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; মিশকাত হা/৩২৫৫)। তিনি আরও বলেন, ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমজানের সিয়াম পালন করে, তার লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করুক! (ছহীহুত তারগীব ১৯৩১; মিশকাত হা/৩২৫৪)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে নারী কষ্ট ব্যতীত তার স্বামীর নিকট তালাক চায়, তার পক্ষে জান্নাতের সুগন্ধিও নিষিদ্ধ’ (আবুদাউদ হা/২২২৬ প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩২৭৯)। তিনি বলেন, ‘যে স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে এমন অবস্থায় যে, তার স্বামী তার উপরে সন্তুষ্ট ছিল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (তিরমিযী হা/১১৬১; মিশকাত হা/৩২৫৬)। তিনি আরও বলেন, ‘মনে রেখ! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব স¤পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।... স্বামী তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার দায়িত্ব স¤পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহের ও সন্তানদের দায়িত্বশীল। সে সেবিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে’ (বুঃমুঃ মিশকাত হা/৩৬৮৫)।

অতএব স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেককে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সর্বদা বেগানা নারী-পুরুষ থেকে নিজেদের দৃষ্টিকে অবনত রাখতে হবে। নিজেদের হৃদয়কে অন্যের চিন্তা থেকে দূরে রাখতে হবে। সেখানে কেবল নিজের স্বামী-সন্তান ও সংসারের চিন্তা থাকবে। সর্বদা আল্লাহ্র আনুগত্যে নিজেকে ধরে রাখতে এবং শয়তানের আনুগত্য হ’তে দূরে থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হবে যে, নশ্বর জীবনের এই সাময়িক হাসি-কান্নায় ধৈর্য ধারণের বিনিময়ে পরকালের অবিনশ্বর জীবনে আল্লাহ সর্বোত্তম সঙ্গী দান করবেন এবং দান করবেন এমন সুখ-সম্ভার, যা চোখ কখনো দেখেনি; কান কখনো শুনেনি; হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৫৬১২)।

আদর্শবান মুসলিম পরিবারে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অতীব নগণ্য। সুতরাং বিবাহ বিচ্ছেদ রোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সর্বদা ঈমানী চেতনা জাগ্রত রাখা। বিবাহ পূর্ব ও বিবাহ পরবর্তী সকল সময়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসনসমূহ সাধ্যমতো পালন করা। পরস্পরে ক্ষমা ও সমঝোতার নীতিকে সবার উপরে স্থান দেওয়া। প্রকাশ্য ও গোপন সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা। জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের আকাক্সক্ষা স্বামী-স্ত্রীকে সর্বদা মিলিত থাকতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে দূরে রাখবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: আমীর, আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, সাবেক শিক্ষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।