ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

জনগণের অধিকার সম্পর্কে কেন জানানো হয় না?

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

গণতন্ত্র একটি ফুলের বাগানের মতো। এ বাগানে শত ফুল ফোটে। গণতন্ত্রের ফুলগুলো হচ্ছে, মতপ্রকাশ ও বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, অবাধ রাজনৈতিক অধিকার, মানুষের ভোটের অধিকার, সুশাসন, আইনের শাসন, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সমতা, সমমর্যাদা, দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ, টেকসই উন্নয়ন, সুষম পারিবারিক ও সামাজি ব্যবস্থা, সর্বোপরি সৎ ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো। দেশের জনগণ এই ফুলের বাগান তৈরি করে তা পরিচর্যা করার দায়িত্ব কোনো সুসংগঠিত দল বা গোষ্ঠীর ওপর ন্যস্ত করে এ অশায়, সে বা তারা গণতন্ত্র নামক বাগানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সৌরভ ছড়িয়ে দেবে। আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, গণতন্ত্র নামক বাগান তৈরি করা। সে সময় দেশের মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য এবং শিক্ষার হার কম থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য তাদের আকাক্সক্ষা ছিল তীব্র। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সামন্ততান্ত্রিক শাসন এবং জমিদারদের নিষ্পেষণ বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ তাদের জন্য এই নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দেয়। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে এবং শহীদ হয়ে দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার অন্যতম যে লক্ষ্য ‘গণতন্ত্র’, পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও তার ভিত্তি মজবুত হয়নি, মজবুত করার কার্যকর উদ্যোগও কোনো সরকার নেয়নি। সামরিক শাসনামল বাদ দিলে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সে সরকার তার মতো করে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছে। গণতন্ত্র তথা ‘রুলস অফ পিপল’ বা জনগণের সম্মতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণার উদ্ভাবক ছিলেন গ্রিসের দার্শনিক ও আইনপ্রণেতা ক্লিসথেনিস। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৮ সালে গ্রিসের এথেন্সে যখন স্বৈরশাসকরা শাসন করত এবং জনগণের মতামত বা তারা কি চায়, তা বিবেচনায় নিত না, তখন তিনি সাধারণ মানুষের কথা বলা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে প্রথম ‘গণতন্ত্র’ নামক ধারণার উদ্ভব ঘটান। এ কারণে তাকে বলা হয়, ‘ফাদার অফ এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি’। মূলত গণতন্ত্রের সূচনা তিনিই করেছিলেন। তারপর শত শত বছর ধরে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুশাসকদের দ্বারা তা পরিমার্জিত হয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও আধুনিক সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দেয়া সংজ্ঞাটি। তিনি গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।’ জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুসারে, গণতন্ত্র হচ্ছে, এমন একটা পরিবেশ যেখানে মানুষের মানবাধিকারকে সম্মান প্রদর্শন এবং মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে তার ইচ্ছা বা মতপ্রকাশ করতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক ধারার হলেও তা কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে বা যারা দেশ পরিচালনা করে, তারা কতটা গণতন্ত্র মনস্ক?

 

দুই.
গণতন্ত্র এবং তার মূল চেতনা অনুধাবন করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে কোনো সরকারই জনগণকে গণতান্ত্রিক ধারণা দেয়ার কোনোরকম উদ্যোগ নেয়নি। সিংহভাগ মানুষ জানে না, গণতন্ত্রে তাদের কি কি অধিকার রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেশের সরকার গঠিত হয়, জনগণের ভোটের মাধ্যমে বা জনগণের ইচ্ছায়। তবে তাদের মাথায় থাকে না, তারা যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে, তারা গণতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো ধারন করে কিনা বা তাদের বোঝাবে কিনা। ভোটাররা ভোট দিতে পেরেই খুশি। কেন ও কি কারণে এবং কাকে ভোট দিচ্ছে এবং তিনি তাদের গণতন্ত্রিক যে অধিকার তা বোঝাতে পারবে কিনা, এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনের আগে দল বা প্রার্থী যেসব প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার প্রকাশ করে, তাতে জনগণের বা গণজনের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার প্রতিশ্রুতি বলতে কিছু থাকে না। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই দেশের শাসন ব্যবস্থার মৌলিক এ বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও, গণতন্ত্রে যে শত ফুল রয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে না। জনগণকে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বোঝাতে চায় না। তাদের মানসিকতা সেই জমিদারি বা সামন্ততান্ত্রিক সময়ের মতো, সেবকের মতো নয়। জনগণকে ধমক দিয়ে শাসন করা তাদের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়। জনগণের ভোট নিয়ে সরকার গঠন করে আকাশে উঠে যায়। নিজেদের আরাম-আয়েশের দিকেই বেশি খেয়াল দেয়। জনগণের ইচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ইচ্ছায় দেশ পরিচালনা করে। আর এর সব দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় এই বলে, জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। এ পর্যন্ত যতগুলো সরকার এসেছে, তার প্রত্যেক মন্ত্রী-এমপি বা জনপ্রতিনিধির দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা তাদের ইচ্ছামতো কথা বলেছে এবং বলছে, অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে এবং জনগণের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে ও ঘোরাচ্ছে। জনগণ কেন ও কি কারণে তাদের নির্বাচিত করেছে, তা বেমালুম হয়ে যায়। তারা মনে করে, জনগণ ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত করেছে, কাজেই এটাই গণতন্ত্র এবং তারা যা খুশি তা করতে পারবে। অথচ ভোট হচ্ছে, গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ বা বীজ, যা থেকে গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের জন্ম হয় এবং তা বিকশিত হয়ে জনগণের উপর ছায়া হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে গণতন্ত্র বলতে এবং জনগণের অধিকার বলতে ভোটের ঐ একদিনকে বোঝানো হয়ে থাকে। এর ভেতরের যে উপাদানগুলো রয়েছে, যা শুরুতেই উল্লেখ করেছি, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে দেখা যায় না। আমাদের দেশে যারা ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসেন, তাদের কতজন গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সম্পর্কে সচেতন এবং জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে জানাতে আগ্রহী, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয়। তারা সচেতনভাবেই জনগণকে গণতন্ত্রে তাদের অধিকার সম্পর্কে বোঝাতে চান না এ কারণে যে, জনগণ যদি গণতন্ত্র বুঝে যায়, তাহলে জনগণের ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বা জমিদারি ও খবরদারি করার সুযোগ থাকবে না। তাদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাদের মানসিকতা এমন, ভোটে নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর পর আবার জনগণের কাছে গিয়ে কাঁকুতি-মিনতি করে ভোট চাইবে এবং পাস করবে। যুগের পর যুগ ধরে আমরা যাদের জনপ্রতিনিধি বলি, তারা এ কাজটিই করে এসেছে এবং আসছে। গণতন্ত্রের কথা বলে, জনগণকে গণতন্ত্রের উপাদান থেকে বঞ্চিত করে তাদের শাসন করেছে ও করছে। গত এক দশকে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি কি, তা সাধারণ জনগণ যতটা না বুঝতে পারছে, তার চেয়ে বেশি বুঝতে পারছে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত (যদিও বিরোধীদলগুলো বলছে অনির্বাচিত) সরকারের বিরূপ আচরণ, জনপ্রতিনিধিদের দাপট এবং সরকারের লোকজনের এলাকাভিত্তিক প্রতাপ।
তিন.
বর্তমান সরকার প্রায় একদশক আগে এমন একটি ধারণার জন্ম দেয় যে, গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি প্রয়োজন উন্নয়ন। আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এ ধরণা দিয়ে সে বোঝাতে চায়, উন্নয়ন হলেই দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকবে। সরকারের এই মানসিকতার কারণে দেশে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল, তা আড়ালে চলে যায়। উন্নয়নের ঝান্ডা উড়িয়ে বিরোধী রাজনীতিকে কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। গণমাধ্যম যাতে সমালোচনা করতে না পারে, এজন্য নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে বশংবদ গণমাধ্যম তৈরি করে। মানুষের কথা বলার অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে চরমভাবে সংকুচিত করা হয়। যারাই মুখ খুলতে গেছে বা সরকারের সমালোচনা করেছে, তাদের গ্রেফতার থেকে শুরু করে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। একদশকের মধ্যে মাঠের বৃহৎ বিরোধীদল বিএনপি’র অভিযোগ, সরকার তাদের ছয়শ’র বেশি নেতাকর্মী গুম করেছে। অসংখ্য নেতাকর্মী খুনের শিকার হয়েছে। লাখের অধিক মামলায় শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ৪০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে এবং জেল দেয়া হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র সংকুচিত, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার অভিযোগ তুলেছে। এমনকি, সরকার যে দুটি নির্বাচন করেছে (২০১৪ ও ২০১৮) তা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে মত দিয়েছে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রথম যে ধাপ নির্বাচন, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে, দেশে গণতন্ত্রের কি হাল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সরকার এসব আমলে না নিয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেছে এবং ধরছে। বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। সরকারের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, গণতন্ত্র নয়, উন্নয়নই আসল। তবে দেশের সচেতন মানুষ, যারা গণতন্ত্র বোঝে, তারা এ মন্ত্রের সাথে বরাবরই দ্বিমত পোষণ করেছে এবং করছে। পশ্চিমা বিশ্বও এখন বেশ জোরেসোরে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার তাকিদ দিচ্ছে। তারা এখন এতটাই কঠোর অবস্থানে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তারা আগামী নির্বাচন তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মারাত্মক সব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। ২০২১ সালে তো যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে। এ বছরের ২৪ মে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা কার্যকর করা শুরু করেছে। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়াও যাতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, এজন্য দেশটির পার্লামেন্টে এক সদস্য প্রস্তাব করেছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা করা নিয়ে প্রস্তাব পাস করেছে। পোশাক রফতানির ওপর জিএসপি সুবিধা কমিয়ে দেয়া কিংবা নিষিদ্ধ করার মতো অবস্থানের ইংগিত দিয়েছে। জাতিসংঘও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাকিদ দিয়েছে। পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোর এই অবস্থান থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কি হাল হকিকত। এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকার যে গণতন্ত্র সংকুচিত করে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে, তা গণতান্ত্রিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল, কর্ণফুলি টানেলের মতো দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে এসব উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি লাভে যে খুব বেশি কাজে দিচ্ছে না, তা বর্তমান অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা দরিদ্র হয়ে গেছে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন তলানির দিকে যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা, বিগত এক দশকে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হয়ে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, গণতন্ত্রকে প্রাধান্য না দেয়া বা গণতন্ত্রহীনতা। এর ফলে সরকারের উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না। বৈশ্বিক বা অভ্যন্তরীণ মন্দা দেখা দেয়ায় তা অনেকটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। বলা বাহুল্য, মেগা প্রকল্পগুলো দৃষ্টিনন্দন হলেও, অভাব-অনটনে পড়া বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের কাছে সেগুলো ‘পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি’ রূপে ধরা দিচ্ছে। এসব প্রকল্প তাদের দৃষ্টিক্ষুধা মেটালেও পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারছে না। যদি গণতন্ত্রকে সামনে রেখে উন্নয়নের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হতো, তাহলে অর্থনীতির এই দুর্দশায় পড়তে হতো না। কারণ, গণতন্ত্র সরকার ও তার প্রতিনিধিদেরকে সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। জবাবদিহিতা থাকলে দুর্নীতি কম হয়, অনাচার, দুর্বৃত্তায়ণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে থাকে। উন্নয়ন টেকসই হয়। দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্র যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে কি দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে? পায়নি। দেশকে ইথোপিয়া, নাইজার, উগান্ডা, বেলারুশের মতো দেশের কাতারে নামিয়ে আনা হয়েছে।

চার.
দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, তা নিয়ে এখন সচেতন ও নাগরিক শ্রেণী স্পষ্ট করেই কথা বলছে। তাদের কথা থেকে এখন এটা স্পষ্ট যে, দেশে এখন গণতন্ত্র নামক ফুলের বাগানটিকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। গত শনিবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘বে অফ বেঙ্গল কনভারসেশন’ এর প্রথম দিনে ‘স্কেপটিসিজম অ্যন্ড কন্সপায়ারেসি: দ্য ডেঞ্জারস অফ মিসইনফরমেশন অ্যান্ড ডিজইনফরমেশন’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার স¤পাদক নূরুল কবীর বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে বা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ, এটা বলা ডিজইনফরমেশন। গণতান্ত্রিক সরকার উন্নয়ন করছে বলা হচ্ছে, কিন্তু এটা ডিজইনফরমেশন। কারণ, সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে, মানুষের ভোটের মাধ্যমে এ সরকার নির্বাচিত হয়নি। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হয়নি। তিনি ইরাকের উদাহরণ টেনে বলেন, ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে বলে দেশটিকে আক্রমণ করা এবং এর ফলে বহু মানুষ হতাহত হওয়া সাম্প্রতিক সময়ে ডিজইনফরমেশন-এর নিকৃষ্টতম উদাহরণগুলোর একটি। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে বৈধতা রয়েছে, এমন কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে সর্বজনীন মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ে। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বিকাশে নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে যখন জনগণ পিছু হটে, সে সময় নাগরিক সমাজকে দমিয়ে রাখা হয়। এখন নাগরিক সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় এসেছে। তাদের তৃণমূলে গিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছানো, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব এবং সংহতি গড়ে তোলার সময় এসেছে। তাদের এ কথা থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, দেশে গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই। সরকার যে গণতন্ত্রের কথা বলে, তা ‘ডিজইনফরমেশন’ বা অসত্য তথ্য।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।