যে কোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে
১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
আজ ১৭ অক্টোবর মঙ্গলবার। দুর্গাপূজা শেষ হবে ২৪ অক্টোবর। বাংলাদেশের হিন্দু ভাইদের এই সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিএনপি এবং তার মিত্ররা ১৯ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচিতে সাময়িক বিরতি দিয়েছে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের প্রতি বিএনপিসহ বিরোধী দলসমূহ যে সম্মান দেখালো, তার জন্য তাদের ধন্যবাদ দিতেই হবে। আমার আজকের লেখাটি হবে এই বিষয়টি নিয়েই।
অতীতে দেখা গেছে যে, হিন্দু ভাইদের এই ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে মাঝে মাঝেই অত্যন্ত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। মহল বিশেষ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট করার জন্য সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছে। এর আগে কে বা কারা হিন্দুদের বিগ্রহের পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন রেখে গিয়েছিল, সেটি নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হয়েছে। একটি চিহ্নিত মহলের মজ্জাগত স্বভাব অনুযায়ী, এই অনভিপ্রেত ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত নাম দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দায়ী বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। এরপর পুলিশই বলে যে, একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি নাকি এই অপকর্ম করেছে। তার ১৬ মাসের কারাদ- হয়। দেখা গেলো, ঐ চেনা মুখদের অপপ্রচার মোতাবেক বিএনপি-জামায়াত প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক শক্তি(?) এই অপকর্ম করেনি। যারা বহু বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি অনুসন্ধানী চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, কারা এই চক্রান্তের জন্য দায়ী। একজন উন্মাদ ব্যক্তি এই কাজ করেছে, সেটি মেনে নেওয়া যায় না। তারপরেও ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে গেছে।
এই ধরনের ঘটনা অতীতে বেশ কয়েক বার ঘটেছে। প্রত্যেক বার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য দেশের ধর্মভীরু মুসলমানদের ওপর দায় চাপানো হয়েছে। অবশ্য জনগণ সেই দায় চাপানোকে মেনে নেয়নি। সবচেয়ে অবাক লাগে এই যে, এই ধরনের যতগুলো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও অনুপুঙ্খ তদন্ত হয়নি। সব কিছুই রাজনৈতিক গুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমে শত্রু সম্পত্তি, পরে নাম বদল করে অর্পিত সম্পত্তি অনেকে দখল করেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি এবং সহায় সম্পত্তির সিংহভাগ কাদের দখলে আছে সেটির একটি তালিকা বের করলেই বোঝা যাবে যে, এসব সাময়িক সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে কারা লাভবান হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিগত ১৫ বছর ধরে একবারও এসব ঘটনার একেবারে ভেতরে কেউ প্রবেশ করেননি।
আজ এই বিষয় নিয়ে লেখার অত্যন্ত সংগত কারণ রয়েছে। দেশ এখন বলতে গেলে একটি সংকট সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজি ভাষায় এভাবে প্রকাশ করা যায়, The country is at the cross road.. বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিএনপি এবং তার মিত্ররা বর্তমানে চলমান আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ নামে অভিহিত করছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে প্রধানত দুটি কারণ ছিল। একটি হলো অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠা। অন্যকথায় সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, ঐ স্বাধীন দেশে আঞ্চলিক বা শ্রেণিগত বৈষম্য থাকবে না এবং দেশে খাঁটি নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিরোধী দলসমূহের মতে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বৃহৎ প্রতিবেশীর আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আর গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে গেছে। তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কর্তৃত্ববাদ যা ফ্যাসিবাদের নামান্তর। এই ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি Oligarchy. উইকিপিডিয়া অনুযায়ী, অলিগার্কির সংজ্ঞা হলো, ‘ক্ষমতার এমন একটি কাঠামো, যেখানে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। বংশমর্যাদা, সম্পদ, পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা অথবা ব্যবসা, ধর্মীয় এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ অধিকার থেকে এই সব লোক নির্ধারিত হয়।’
ধনীক শ্রেণির গোষ্ঠিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যে, রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছে সেটিকে বলা যাবে Kleptocracy. উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ক্লেপ্টোক্রেসির সংজ্ঞা হলো, ‘এমন একটি সরকার যার দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে জনগণের সম্পদ এবং তাদের শাসন করা জমি বাজেয়াপ্ত করে, সাধারণত বৃহত্তর জনসংখ্যার ব্যয়ে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ বা অপব্যবহার করে।’
॥দুই॥ফ্যাসিবাদ বলুন, অলিগার্কি বলুন কিংবা ক্লেপ্টোক্রেসি বলুন, সবকটির সম্মিলনে, বিরোধী দলগুলির মতে, দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্র। এই স্বৈরতন্ত্রের অবসানের জন্য প্রয়োজন জনগণের সর্ব শ্রেণীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গণঅভ্যুত্থান। এটি একটি হারকুলিয়ান টাস্ক। এই টাস্কের বিশালতা বিবেচনা করে আ স ম আব্দুর রব বলতে চান, তিনি একবার মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। এবার আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনবেন।
বিএনপি, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, এমনকি বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি বা সিপিবিসহ বাম জোটও বলছে যে, স্বৈরতন্ত্র অবসানের লড়াই এখন চূড়ান্ত ধাপের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। জনগণকে নিয়ে আরেকটি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলেই জনগণ মুক্তি পাবে। এসব ক্ষেত্রে শাসক গোষ্ঠি টিকে থাকার জন্য চক্রান্তের চোরা গলিপথে আনাগোনা করে। তারা আশঙ্কা করছেন যে, গণআন্দোলনকে ধিকৃত এবং বিপথগামী করার জন্য শাসক গোষ্ঠি শেষ অবলম্বন হিসেবে দুটি পথ গ্রহণ করতে পারে। একটি হলো, সর্বাত্মক বল প্রয়োগ করে আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখা। আর দ্বিতীয়টি হলো, সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করা। এই দ্বিতীয় আশঙ্কাই এখন বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ যাতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, এজন্য গণতন্ত্রের জন্য যারা লড়াই করছেন তাদের নি¤েœাক্ত পদক্ষেপসমূহ অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে।
(১) দুর্গাপূজার পূর্বাহ্নে, পূজা চলাকালে এবং পূজা শেষ হওয়ার পরও কয়েক দিন গণতন্ত্রকামী শক্তিকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে হবে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো দেখতে হবে, কোনো অপশক্তি যেন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বীজ বপন করতে না পারে। (২) তারপরেও যদি কোনো অপশক্তি হিন্দু ভাইদের ক্ষতি করতে চায় তাহলে সর্বাগ্রে মুসলমানদের হিন্দু ভাইদের সামনে দাঁড়িয়ে যে কোনো মূল্যে তাদের জানমাল রক্ষা করতে হবে। আমি আবার বলছি, এবার মুসলমান ভাইরাই হবেন হিন্দু ভাইদের রক্ষা করার বুলওয়ার্ক (Bullwork) সোজা কথায়, মুসলমানরা হবেন হিন্দুদের প্রতিরক্ষা বর্ম।
আমি আবার বলছি, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল একটি অবস্থার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কোনো ভুল করা চলবে না। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার একটি ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। গত ১৩ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে একটি খবর ছাপা হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, ‘কুমিল্লায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলে পুলিশের বাধা, যুবলীগ-ছাত্রলীগের ধাওয়া’। খবরে বলা হয়, কুমিল্লায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধাওয়া দিলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। গত শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লা নগরের নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ধাওয়ার সময় তিনজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের ‘সাম্প্রদায়িক গালিগালাজ’, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের ‘দুর্গাপূজাকে কটাক্ষ করে মন্তব্য’, কুড়িগ্রামের চারণ কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা এবং বিভিন্ন জায়গায় পূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে এ প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
খবরে আরো বলা হয়, স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে পূজা উদ্যাপন নিয়ে এক সভা হয়। এ সময় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের ‘মদমুক্ত পূজা’ করার আহ্বান জানিয়ে দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দপ্তর সম্পাদক মিহির রঞ্জন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বক্তব্যকে ‘সাম্প্রদায়িক উক্তি’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এই ঘটনার রেশ ধরে হিন্দু-বৌদ্ধ-ঐক্য পরিষদের স্থানীয় শাখা এই মর্মে হুমকি দিয়েছে যে, যদি আ ক ম বাহাউদ্দিনকে সংসদ সদস্য পদে আবার মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে খবর আছে।
॥তিন॥আজ আর লেখা বাড়াতে চাই না। আন্দোলনের কর্মসূচির সাময়িক বিরতি দিলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আরো বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে বিএনপি এবং বিরোধী দলসমূহের কাঁধে।
প্রিয় পাঠক, ২৬ অক্টোবরের পর সম্ভবত দেশবাসী বিশেষ করে ঢাকাবাসী একটি রাজনৈতিক ঝড়ের আলামত দেখতেও পারেন। যদি সেই ঝড় ওঠে তাহলে সেটি কতদূর শান্তিপূর্ণ থাকবে, সেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এই কারণে যে, আওয়ামী লীগও অতীতে অনেক বড় এবং কঠিন আন্দোলন করেছে। কিন্তু দিন শেষে সেই আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখা যায়নি।
Email: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এবার রাবির শেরে-বাংলা হল থেকে লাঠিসোঁটা-হকিস্টিক উদ্ধার
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস
লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের
সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক
ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!
যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা
তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল
৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা
‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে
ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার
সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার
ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার
আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়
হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড ইংল্যান্ড
পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত