বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়া হোক
১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন। তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। ৭৮ বছর বয়সি খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যা, লিভারসিরোসিস ছাড়াও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, দাঁত ও চোখের সমস্যা, মেরুদ-, ঘাড়, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও নানা জটিলতায় আক্রান্ত। শারীরিক এইসব নানা সমস্যার কারণে গত ৯ আগস্ট চিকিৎসকদের পরামর্শে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেই থেকে দুই মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় ঘটিত মেডিকেল বোর্ড এভারকেয়ার হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেশে আর সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের হাতে আর কোনো চিকিৎসা নেই। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সমন্বয়কারী প্রফেসর ডা. এফএম সিদ্দিকী বলেন, আমরা মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেছি বেগম খালেদা জিয়া সিরোসিস অব লিভার রোগে আক্রান্ত। এর পাশাপাশি তাঁর হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অনান্য রোগ আছে। ফলে সিরোসিস অফ লিভার রোগটা এখন মৃতুঝুঁকি হয়ে যেতে পারে বলে আমরা উদ্বিগ্ন। এ সময় তিনি আরো বলেন, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। যদি টিপস করানো হয় বিদেশের কোনো মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টারে এবং পরবর্তীতে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করানো হয়, তাহলে সম্ভবত আমাদের হাতে এখনও অপশন আছে। হয়তো উনার উন্নতি ঘটাতে পারব। উন্নত চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা।
মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শ ক্রমে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়ার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট আবেদন নিবেদন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার অনুমতি পাননি, সরকার অনুমতি দেয়নি। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে দেশের সুশীল সমাজও উদ্বিগ্ন। গত ১২ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, ব্রতীর প্রধান শারমিন মুরশিদ, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলমসহ দেশের ২৩ বিশিষ্ট নাগরিক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য অনতিবিলম্বে বিদেশে পাঠাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদেশে কোন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও রাজনৈতিক দলের নেতাকে বিদেশে চিকিৎসায় পাঠানোর নজীর রয়েছে। গণমাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরাও খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর পেছনে কোন আইনগত বাধা নেই বলে জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন প্রত্যাখান করে প্রদান করা আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতে প্রতিফলিত হয়নি। আইনজীবীদের মতেও তাঁকে বিদেশে পাঠানো সম্ভব, তাই এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পুনর্বিবেচনা করা এবং চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে অনতিবিলম্বে বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে অনীহ হলে, তা শুধু খালেদা জিয়ার জীবনই বিপন্ন করবে না, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। গঠিত হয় ফখরুদ্দীন ও মঈন উ আহমেদের সরকার। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রায় ২ বছর এই সরকার দায়িত্ব পালন করে। এই জরুরি সরকারের সময় প্রথমে মাইনাস টু ফরমুলা নিয়ে এগিয়ে যায়। ওই সময় দুই নেত্রীকে কারাবরণ করতে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ৩ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ হন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর আইনি লড়াই এর মধ্য দিয়ে সবকটি মামলায় জামিন নিয়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানান। জরুরি সরকারের সময় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নামে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ টি। এর মধ্যে ৩৫টি মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। বাকি দুটো মামলায় তিনি সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা ভোগ করছেন। মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটি দুর্নীতি মামলা, চারটি মানহানির মামলা ও একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা রয়েছে। বাকি মামলাগুলো হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যান। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে ৬ মাসের জন্য দুই শর্তে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। প্রথমত তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, দ্বিতীয়ত তিনি চিকিৎসা নেবেন নিজের বাসায় থেকে। সর্বশেষ গত ১০ই সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার দ- স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানো হয়। এ নিয়ে অষ্টমবারের মত বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পর থেকে খালেদা জিয়াকে বারবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে হয়েছে। খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখনই অগণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তখনই খালেদা জিয়াকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঝান্ডা হাতে লড়াইয়ে রাজপথে নেমেছেন। প্রতিবারই জেল জুলুম নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু কখনোই কোনো অপশক্তির কাছে তিনি আপোষ করেননি। ফলে সর্ব মহলে তিনি ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত। ২০২২ সালে কানাডীয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) গণতন্ত্রের প্রতি অসামান্য অবদানের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘মাদার ডেমোক্রেসি’ সম্মাননায় ভূষিত করে। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে এতটাই অসুস্থ যে তাকে একবার আইসিইউতে একবার সিসিইউতে নেওয়া হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে হাসপাতালের কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করতে হচ্ছে। তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। টানা প্রায় আড়াই মাস যাবত হাসপাতালে চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না।
খালেদা জিয়াকে সরকার নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে প্রথমে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়। পরবর্তীতে কয়েক দফায় মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। কিন্তু শর্ত প্রদান করেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না। এই শর্তটা প্রত্যাহার করে নিলেই খালেদা জিয়ার বিদেশে যেতে আইনগত কোন সমস্যা থাকে না। খালেদা জিয়া বর্তমানে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসার মত একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার থেকে খালেদা জিয়াকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শুধু এই অজুহাতে খালেদা জিয়া দ-প্রাপ্ত। খালেদা জিয়া যদি জীবন রক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাই না করতে পারে তবে সরকারের নির্বাহী আদেশ এই মুক্তির কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা আছে। তখন প্রশ্ন জাগে বেগম খালেদা জিয়া কি আসলেই মুক্ত?
দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন বর্ষীয়ান নেত্রী, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে যেতে পারবেন না, এটা কোনোভাবেই কাম্য না। সরকারের পক্ষ থেকে যত অজুহাতই দেখাক কেন দেশের মানুষ ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে আসলে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসর বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। দেশের আইন কানুন সংবিধান মানুষের কল্যাণের জন্য, অসহায় পীড়িত মানুষের অসহায়ত্ব দেখার জন্য না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সরকারের গড়িমসি ও সময়ক্ষেপণের ফলে যদি বেগম খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে যায়, তাহলে ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতি এড়াতে সরকারের উচিত অবিলম্বে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো। সরকার এ ব্যাপারে যত দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে, ততই মঙ্গল।
লেখক : আইনজীবী।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকাসহ সারা দেশে ১৯১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
কুড়িগ্রামে বাস চাপায় মোটরসাইকেল চালক নিহত
হোয়াইট হাউজে বাইডেনের সঙ্গে বুধবার দেখা করবেন ট্রাম্প
দেখা না দিলে বন্ধু, কথা কইয়ো না : হাসনাত আব্দুল্লাহ
তারেক রহমানের পিপিই বিতরণ, বহিস্কৃত শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব সম্পাদক ফিরে পেলেন সদস্যপদ
বাতিল হচ্ছে শেখ পরিবারের নামের সব পুরস্কার
বাতিল হচ্ছে শেখ পরিবারের নামের সব পুরস্কার
ব্রিটিশ রাজা চার্লস ও পুত্র উইলিয়াম সমালোচনার মুখে পড়েছেন!
কোন বয়সে কতটা ঘুমোনো উচিত? আপনাদের বয়স অনুযায়ী মিলিয়ে নিন তালিকা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার লিভ টু আপিল শুনানি শুরু
আ. লীগ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা
শহীদ নূর হোসেনের প্রতি পরিবারের শ্রদ্ধা
গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় প্রাইভেটকারের তিন যাত্রী নিহত
বাতিল হচ্ছে হাওরের উড়ালসড়ক-মেট্রোরেলসহ বহু ‘ইচ্ছাপূরণ’ প্রকল্প
রাশিয়ার সঙ্গে উ.কোরিয়ার প্রতিরক্ষা চুক্তি আইন হিসেবে স্বাক্ষর পুতিনের
ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সম্মানজনক বেতন কাঠামো হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের হাইকমিশনারের বৈঠক
সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আজ নামছেন বাকি ৩০০ জন শিক্ষার্থী
সাবেক দুই শীর্ষকর্তার জায়গা হচ্ছে না ট্রাম্পের সম্ভাব্য দ্বিতীয় প্রশাসনে
ডিএনএ পরিক্ষায় প্রমাণিত,হাসপাতালের ভুলে হয়েছিল শিশু অদলবদল