ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা এবং গাজায় নতুন নাকবা বুমেরাং হবে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০১ এএম

পুরনো উপনিবেশবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে প্রথম মহাযুদ্ধ,উসমানীয় খেলাফতের পতন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থার আওতায় ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র নিয়ে যে নীলনকশা অঙ্কন করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়নের রূপরেখা থেকে সরে যায়নি পশ্চিমা জায়নবাদী কুশীলবরা। প্রযুক্তি, পুঁজি আর সমরাস্ত্রের বলে প্রায় শূন্য থেকে একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তাকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার প্রকল্প বাস্তবে সফল হয়নি। জাতিসংঘের প্রথম প্রস্তাব রেজুলেশন ১৮১ অনুসারে, ফিলিস্তিনকে দুইভাগ করে ইহুদিদের পাশাপাশি ফিলিস্তিনীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিংবা সেক্যুলার, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে সমঅধিকারের ভিত্তিকে একটি একক রাষ্ট্রের ইউটোপীয় সমাধান কোনোটাই বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বসম্প্রদায় তথা পশ্চিমাদের এটি ব্যর্থতা নয়, অনিচ্ছা ও গোপণ অভিসন্ধি। ১৯৪৮ সালে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নির্মম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের (নাকবা) মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তার পেছনে যেমন ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের মূল এজেন্ডা সক্রিয় ছিল; একইভাবে ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালসহ পরবর্তি প্রতিটি যুদ্ধেই ইসরাইলের অসম পেশিশক্তির ভারসাম্যহীন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনী ও আরবদের উপর আগ্রাসন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং ভূমি দখলের অপতৎপরতার সাথে পশ্চিমাদের নির্লজ্জ মদত স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রথম ৪৫ বছর পারমানবিক শক্তিধর সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সাথে ঠান্ডা লড়াইয়ের উত্তেজনায় কাটলেও ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের নতুন টার্গেট হয়ে ওঠে ইসলাম এবং মধ্যপ্রাচ্য। ¯œায়ুযুদ্ধের সময়ে গড়ে ওঠা পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স(এমআইসি)’র হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ ফুলেফেঁপে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমানবিক সমরাস্ত্র এবং সম্ভাব্য সামরিক প্রভাব বলয়ের জুজু দেখিয়ে। মার্কিন জনগণের ট্যাক্সের টাকার একটি বড় অংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে মূলত জায়নবাদী ইহুদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অঢেল সম্পদের মালিক বনে যায়। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, মূল ধারার মিডিয়া, থিঙ্কট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ জায়নবাদী ইহুদিদের হাতে। রাষ্ট্রহীন ইহুদিরা শত শত বছর ধরে ইউরোপ-আমেরিকায় মহাজনি সুদ ও ব্যাংকিং ব্যবসা করে পশ্চিমা সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণীতে পরিনত হয়েছিল। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর টার্গেট তথা হলোকস্টের ভিকটিম ইহুদিদের প্রতি পশ্চিমাদের সিম্প্যাথি কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার পরও বেশিরভাগ মার্কিন ইহুদি ফিলিস্তিনে বসতি গড়েনি। মার্কিন ইহুদিরা কার্যত দ্বৈত নাগরিক। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বসবাস করলেও ইসরাইলের জায়নবাদী এজেন্ডার সমর্থনে মার্কিন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক শক্তিকে কাজে লাগানো তাদের অন্যতম এজেন্ডা। যদিও সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা বরাবরই জায়নবাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা অস্ত্রের বলে, অন্যায়ভাবে আরবদের জমি দখল করে ইহুদি রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান এখনো অটুট রয়েছে। গাজায় চলমান ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সাধারণ মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছে। সেখানে জায়নবাদবিরোধী ইভানজেলিক ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষকেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নামতে দেখা যাচ্ছে।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জায়নবাদী ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত ও প্রভাবিত থিঙ্কট্যাঙ্ক ও মিডিয়াগুলো একটি ইসলামোফোবিক এজেন্ডা গ্রহণ করেছিল। সোভিয়েতের পতনের পর নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে সে আলোচনা ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। চিন্তক বুদ্ধিজীবী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন ‘দি ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন্স’ বই লিখে পশ্চিমা বিশ্বের আগামী কনফ্লিক্টস বা যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক মতাদর্শিক রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন। নিউইয়র্কের বিশ্বাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগনে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসি বিমান হামলার ঘটনার সাথে আল কায়েদা, ওসামা বিন লাদেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে ওয়ার অন টেররের নামে পুরো ইসলামি বিশ্বের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বকে অস্থির-অস্থিতিশীল করে তোলার মধ্য দিয়ে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলের পুরনো সা¤্রাজ্যবাদী ও জায়নবাদী তৎপরতাকেই নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে দেখা গেছে। স্যামুয়েল হান্টিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা যেসব তাত্ত্বিক অ্যাকাডেমিক ও ঐতিহাসিক আলোচনা উপস্থাপন করেছেন, তাতে দ্বিমত করার কিছুই নেই। তবে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার সাথে সাথেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধকে ‘ক্রুসেড’ বলে ঘোষণা দিয়ে থলের বেড়াল বের করে দিয়েছিলেন। টুইন-টাওয়ারে হামলার সেই ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। তবে পরবর্তী যুদ্ধাভিযান ও তার বেনিশিয়ারি হিসেবে জায়নবাদী ইসরাইলের ভূমিকাসহ কিছু কো-ইনসিডেন্ট থেকে ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। টুইনটাওয়ারে কর্মরত প্রায় ৫ হাজার ইহুদির প্রায় কেউই সেদিন (এগার সেপ্টেম্বর ২০০১) কর্মস্থলে যায়নি। ঘটনার কিছুদিন আগে কিছু ইহুদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সেখান থেকে অফিস স্থানান্তর করা এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের যুক্তরাষ্ট্র সফর আকস্মিকভাবে বাতিল করা কিংবা হামলার ঘটনার সময় কতিপয় ইহুদির তাৎক্ষণিক ভিডিও ধারণ ইত্যাদি ঘটনাগুলোকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়া ওয়ার অন টেররিজমের প্রথম টার্গেট আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্বের আগ্রাসন বলবৎ রাখতে বিশ বছর ধরে প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলারের বাজেটের টাকা মূলত পশ্চিমা ওয়ার কন্ট্রাক্টর ও এমআইসির অর্থনৈতিক ভা-ারকে শক্তিশালী করেছে। সাদ্দাম হোসেনের কাছে ‘ওয়েপন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ এর বিপুল ভা-ার থাকার তথ্য দিয়েছিল জায়নবাদি থিঙ্কট্যাঙ্ক ও গণমাধ্যমগুলো। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া মার্কিনীরা যেভাবে তালেবান ও আল কায়েদার পাশে বিপুল আর্থিক ও সামরিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই এত তাড়াতাড়ি সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে তালেবানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। সে সময়ের এক ছবিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান হোয়াইট হাউজে তালেবান নেতাদের সাথে বৈঠক করছেন। এ প্রসঙ্গে রিগ্যানের মন্তব্যটি ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, এই লোকগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের সমতুল্য। অর্থাৎ মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যেভাবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আফগান তালেবানরাও একভাবে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান জনগণকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেই তালেবানদের হটিয়ে সেখানে মার্কিন দখলদারিত্ব কায়েমের পরিকল্পনার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কোনো স্বার্থ ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের একাধিপত্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার দূরবর্তি আশঙ্কাকে সমূলে ধ্বংস করাই মূলত ওয়ার অন টেরর ও আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের নেপথ্য কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়। ওয়ার অন টেররের সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক রাষ্ট্র দখল ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আরব রাষ্ট্রগুলোকে চরমভাবে চাপের মুখে রেখে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির আওতায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়েছিল।

প্রায় সাড়ে ৭ দশক পেরিয়ে এসেও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের লাঠিয়াল হিসেবে প্রতি দশকেই মধ্যপ্রাচ্যে একেকটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। পঁচাত্তর বছরেও উদ্বাস্তু ফিলিন্তিনীরা নিজেদের ভিটেমাটি ফিরে পায়নি। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের প্রস্তাবকে ঠেকিয়ে রেখে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে ধীরে ধীরে ইসরাইলের আকার আয়তন বর্ধিত করার নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে তার প্রকারান্তরে দীর্ঘ মেয়াদে এথনিক ক্লিনজিংয়ের পথ বেছে নিয়েছে। উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বশূন্য করা , শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অর্থনৈতিক কর্মকা- ও রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারকে দাবিয়ে রাখতে মূলত ৭৫ বছর ধরেই ফিলিস্তিনকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এরপরও ফিলিস্তিনিরা যখন ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব মেনে না নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম জোরালো করার উদ্যোগ ঠেকাতে ২০০৭ সাল থেকে গাজার স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথ অবরুদ্ধ করে কার্যত গাজাকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিনত করে রেখেছে। হামাসের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সামরিক প্রতিরোধ অজেয় ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্সের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য এক অভাবনীয় বিস্ময়। ফিলিস্তিনের উপর সাড়ে সাত দশকের দখলদারিত্ব কিংবা দেড় যুগ ধরে চলা গাজার উপর নির্মম অবরোধের মধ্যেই যখন তখন বিমান হামলা, টার্গেটেড কিলিংয়ের নামে বেসামরিক মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে এক নারকীয় পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা হয়েছে। বিশেষত মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসার উপর ইসরাইলী নিয়ন্ত্রণ এবং ইহুদি অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসনের ঘটনা ক্রমে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো স্পষ্টতই উস্কানিমূলক। ২০২১ সালে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে হাজার হাজার হামাস সদস্য হত্যা ও স্থল অভিযানে হামাসের সুরঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংসের দাবি করেছিল ইসরাইলী বাহিনী। সেই থেকে হামাস বাহিনী অনেকটা অদৃশ্য-নিস্ক্রিয় থাকলেও ইসরাইলের দখলদারিত্ব, অবৈধ বসতি, আগ্রাসন, রমজান মাসে আল আকসা মসজিদে নামাজ ও এতেকাফরত মুসল্লিদের উপর ইসরাইলী পুলিশি তা-ব, বেসামরিক মানুষ হত্যা ও উস্কানিমূলক কর্মকা- বেড়ে চলেছিল। দশকের পর দশক ধরে অপমানিত, অবরুদ্ধ, বঞ্চিত ও গণহত্যার হুমকির মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনীদের সংক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন ইসরাইলের যুদ্ধবাজ জায়নবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর তিনি ইসরাইলের যে ম্যাপ তুলে ধরেছিলেন, তাতে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাকেও সার্বভৌম ইসরাইল রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখিয়েছেন।

আরবদের মুখ বন্ধ করতে ইতিমধ্যে আব্রাহাম একর্ড নামের একটি চুক্তির অধীনে কতিপয় আরব দেশকে ইসরাইলের সাথে নরমালাইজেশনের বন্দোবস্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক সময় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী তথাকথিত গ্রেটার ইসরাইলের নতুন মানচিত্র দেখিয়ে তার অশুভ অভিপ্রায়ের জানান দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও আরব প্রতিবেশিদের নীরব ভূমিকাকে ফিলিস্তিনিরা মেনে নিতে পারেনি। নেতানিয়াহুর জাতিসংঘ ভাষণের ১৫দিনের মাথায় ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের নজিরবিহীন আক্রমণ সারাবিশ্বের জন্য এক অভাবনীয় চমক সৃষ্টি করেছে। তবে ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী প্রধানমন্ত্রী হামাসের এই আক্রমণকে পুঁজি করে গাজা ও পশ্চিম তীরের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করতে তিন লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ত্রিমুখী হামলা চালিয়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে। বিদ্যুত, পানি, ওষুধ ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে গাজার বাইশ লাখ ফিলিস্তিনিকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে গাজার ভূমি দখলের প্ল্যান করছে ইসরাইল। গত দুই দশকে লেবাননের হেজুবল্লাহ ও গাজার হামাসেেক নির্মূল করতে অন্তত ১০টি সামরিক অপারেশন চালিয়েছে ইসরাইল। এবার প্রথমবারের মত হামাসের ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ শুরুর আকস্মিক অভিযানে হতবিহ্বল, নাস্তানাবুদ ইসরাইল ইতিমধ্যে একাধিকবার মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দেয়ার ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। হামাসের ঘাটি আর সুরঙ্গ ধ্বংসের নামে তিন লক্ষাধিক রিজার্ভ সেনা, আর্টিলারি, শত শত ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে ত্রিমুখী অভিযান শুরু করতে সীমান্তে অবস্থান করছে। উত্তর গাজার ১১ লাখ অধিবাসিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে গাজা ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছিল ইসরাইলী বাহিনী। বেশিরভাগ গাজাবাসি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে হামাসও হামলা মোকাবেলায় প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। লেবাননের শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিনী হেজবুল্লাহ ইতিমধ্যেই হামাসের সমর্থনে যুদ্ধে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে ইসরাইলে রকেট হামলা শুরু করেছে। সিরিয়া থেকে ইসলামিক জিহাদের মুজাহিদরাও ইসরাইলের দিকে রকেট হামলা শুরু করেছে। ইসরাইলের গাজা অভিযান ও বেসামরিক মানুষ হত্যায় মার্কিন ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নি:শর্ত সমর্থন ও সহায়তার প্রতিক্রিয়ায় হামাস ও ফিলিস্তিনের পক্ষে রণপ্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছে ইরান। তুরস্ক, সউদি আরবের মত মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী পক্ষগুলোও গাজায় অভিযানের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে সতর্ক করেছে। রাশিয়া এবং চীনের মত এশীয় পরাশক্তি ইতিমধ্যে ইসরাইলকে সতর্ক করেছে এবং ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও পক্ষপাতকে দায়ী করেছে।

নেতানিয়াহু হামাস নির্মূল ও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলের প্রত্যয় ঘোষণা করে দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের বার্তা দিয়েছেন। অন্যদিকে হামাস, হেজবুল্লাহ, ইরানসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোও ফিলিস্তিনিদের অধিকার এবং ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছে। শুরুতেই বোঝা যাচ্ছে, এবারের যুদ্ধ আগের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মত একপেশে হচ্ছে না। শত শত ইসরাইলী সেনা হামাসের হাতে আটক হয়েছে। দেড় হাজার ইসরাইলী নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার ইসরাইলী নাগরিক বিমান ও সমুদ্রপথে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। লাখ লাখ ইসরাইলী নাগরিক বাড়িঘর ছেড়ে ভূগর্ভস্থ শেল্টারে আশ্রয় নিচ্ছে। ৫০ হাজার হামাস যোদ্ধার মধ্যে মাত্র কয়েকশ’ গেরিলা কমান্ডোর কাছে ইসরাইলী বাহিনীর এমন নাস্তানাবুদ অবস্থা আগের কোনো যুদ্ধে লাখ লাখ সেনা সদস্যের সম্মিলিত আরব বাহিনীর সাথেও হয়নি। হামাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত ও বিগড়ে যাওয়া ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী হামাসকে ধ্বংস করে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দিতে গাজা থেকে যে দ্বিতীয় নাকবা (গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ) শুরু করতে যাচ্ছেন তা ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অনেকেই। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পশ্চিমা বিশ্লেষক, মিডলইস্ট আই’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং এডিটর ইনচীফ, ভেটারান সাংবাদিক-বিশ্লেষক ডেভিড হার্স্ট দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ইসরাইলের এই নাকবা ‘ব্যাকফায়ার’ করবে। মিডলইস্ট আই অনলাইনে প্রকাশিত ডেভিড হার্স্টের বিশদ বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে যে সব আশঙ্কা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন, তাঁর মতে, যদি এর তিনভাগের একভাগও ফলপ্রসু হয় তাহলে এই যুদ্ধের শেষে ইসরাইলের কোনো সীমান্ত থাকবে না। সবশেষে তিনি বলেছেন, ÔA Gaza
campaign that develops into a plan that could change the Middle East could backfire dangerously - and it should be stopped before it is too late.’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইতিমধ্যে সুর কিছুটা নরম করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পোড়খাওয়া মুজাহিদরা গত সিকি শতাব্দীতে অনেকগুলো পশ্চিমা সম্মিলিত সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলা করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। ইতিমধ্যে আঞ্চলিক বাস্তবতায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ২০০৮ সালে লেবাননে ইসরাইলের স্থল হামলায় হেজবুল্লাহর হাতে আইডিএফ-র বড় পরাজয় অত:পর ১৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ হামাসের যোদ্ধাদের হাতে ইসরাইলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তছনছ হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সে বার্তা অনেকটাই স্পষ্ট। পঁচাত্তর বছরেও আঞ্চলিক-রাজনৈতিকভাবে ইসরাইল একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। শুধুমাত্র সমারাস্ত্র দিয়ে চিরস্থায়ী দখলদারিত্ব কায়েম রাখা যায়না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি পশ্চিমা স্বীকৃতিই ইসরাইলের সাধারণ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ১৮টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মাঝখানে শুধুমাত্র অস্ত্রের বলে দখলদারিত্বের জন্য গণহত্যা সংঘটিত করে টিকে থাকার শয়তানি ফন্দি বাতিল করে ইসরাইলকে শান্তির পথে আসতেই হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস

লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের

লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের

সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক

সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক

ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!

ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!

যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল

তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল

৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা

৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা

‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে

‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে