বিশ্বে তেল ও গ্যাসনির্ভর জ্বালানি সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বিশ্ব অনেক আগেই এর বিকল্প হিসেবে নবায়ণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও এদিকে ধাবিত হচ্ছে। এ তুলনায় আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আমরা এখনও তেল ও গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছি। এ খাতের শতকরা ৯৫ ভাগ তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তেল পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গ্যাস দেশজ সম্পদ হলেও, উৎপাদন চাহিদানুরূপ নয়। গ্যাসের অভাবে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতি সমাল দিতে গ্যাস আমদানি পর্যন্ত করতে হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা নবায়ণযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা বলেছেন, আমাদের যেসব নবায়ণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের মাধ্যম রয়েছে, সেগুলো জরুরিভিত্তিতে কাজে লাগানো প্রয়োজন। বর্জ্য, বায়ু, সৌরশক্তি ইত্যাদি মাধ্যম থেকে শক্তি উৎপাদনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে যেমন চাপ কমবে, তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি খাতে বিশ্বব্যাপী ১০.৭ বিলিয়ন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

দেশে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি খাতটি খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। সৌরবিদ্যুতের কিছু প্রকল্প দেখা গেলেও, বর্জ্য ও বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন দেখা যায় না। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাসের যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে আগামী বিশ বছর চলা যাবে। তারপর সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করবে। মজুদকৃত গ্যাসের শতকরা ৮২ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, মাত্র ৩ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় নবায়ণযোগ্য শক্তি থেকে। অথচ দেশে নবায়ণযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বায়োগ্যাস, জিওথার্মাল, হাইড্রো, টাইডাল এবং বায়ু। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও সহজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় বর্জ্য ও সূর্যের আলো থেকে। ইতোমধ্যে আমিন বাজারে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্প চালু হলে, জ্বালানি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে। প্রতিদিন রাজধানীতে যে পরিমাণ বর্জ্য (প্রায় ৬ লাখ টন) উৎপাদিত হয়, তা এ প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে। সৌরবিদ্যুৎ কিছুটা হলেও এগিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৯৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এ খাত থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। অন্যদিকে, হাইড্রো বা পানিবিদ্যুৎ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট উৎপাদিত হয়। বায়োগ্যাস ও বায়োম্যাস থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। এ চিত্র থেকে বোঝা যায়, নবায়ণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এসব উৎস ব্যবহার করা হলে দেশে জ্বালানি সংকট অনেকটা লাঘব হবে। এসব খাত পরিবেশবান্ধব হওয়ায় জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনেও সহায়তা করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি খাত গতিশীল হলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে প্রায় ১৪ হাজার কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। উল্লেখযোগ্য হারে নবায়ণ হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে চারগুণ। এ খাতে কর্মসংস্থানের জন্য চাকরিপ্রত্যাশিতদের প্রস্তুত করতে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়াতে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন ও ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় নবায়ণযোগ্য জ্বালানি বা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া এখন সময়ের দাবী। যতই দিন যাবে ততই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট তীব্র হয়ে উঠবে। জীবাশ্ব জ্বালানি হ্রাস পাওয়ায় এখনই তার আলামত দেখা যাচ্ছে। চাহিদা মিটাতে সারাবিশ্ব যেখানে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদন করছে, সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ নেই। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা ক্রমশ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছি। এতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দেয়, তেমনি জ্বালানি খাতে অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সরবরাহ ও সংকটের কবলে আমরাও পড়েছি। এ বাস্তবতার আলোকে আমাদের জ্বালানি সংকট মেটাতে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা জোরদার করার বিকল্প নেই। কীভাবে বিভিন্ন নবায়নযোগ্য উৎস থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।