ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

আঞ্চলিক ফ্যাসিবাদ এবং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে আমাদের গণতন্ত্র

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সামাজিক-অর্থনৈতিক গতিধারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ব-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে, তার সবই আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনধারায় সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করছে। গত কয়েক বছরে কোভিড-১৯ অতিমারি থেকে শুরু করে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবক্ষয় এবং সরকারের মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিয়ে পশ্চিমা সমাজের প্রতিক্রিয়া আমাদের সরকার এবং সর্বসাধারণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সরাসরি প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির বিশ্বায়নের পথ ধরে আমাদের এই গ্রহ একটি গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্ব পল্লীতে পরিনত হয়েছে। এখানে কেউ আর স্বয়ংসম্পুর্ণ বা পরিপূর্ণ স্বাধীন নয়। জাতিসংঘ ও এর আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার সভ্য হিসিবে প্রতিটি জাতি নানা প্রটোকল ও কনভেনশনে সই করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সীমারেখার প্রশ্নে অনেকটা আপস করে চলেছে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই এখন বৈদেশিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা নির্ভর। গার্মেন্ট রফতানি এবং বিদেশে কর্মরত প্রায় দুইকোটি কর্মীর অর্জিত রেমিটেন্সের উপর আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রত্যাশা, নজরদারি, খবরদারি ও নানাবিধ নির্দেশনার সাথে এ অঞ্চলের বিশ্ব রাজনীতির গভীর কলাকৌশল নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থায় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রভাব বলয়ের বিপরীতে একটি মুক্তবাজার অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিজেদের সহযোগীতামূলক অংশীদারিত্বের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাবিশ্ব। বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসানে উত্তরাধিকার সুত্রে আমরা পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বলয়ের অংশীদার হয়ে উঠেছিলাম। পৌনে এক শতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমরা সেই প্রভাব বলয় থেকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি।

বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা দিয়েই আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসের শুরু নয়। এ ক্ষেত্রে চিরায়ত বাঙ্গালী সংস্কৃতির কথা বাদ দিলেও বাঙালী মুসলমানের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসের ব্যাপ্তিও হাজার বছরের। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে শুরু হওয়া ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ পর্যায়ক্রমে মার্কিন সিভিল ওয়ার এবং বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে একটি রক্তাক্ত বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তির পর সাবেক উপনিবেশিত দেশগুলোর বেশকিছু রাজনীতি-অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতার নতুন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে পৌরাণিক স্ফিংস পাখির মত পুনরুত্থানের ইতিহাসও সৃষ্টি করেছে বেশ কয়েকটি জাতি। ধর্মীয় ও জাতিগত সংস্কৃতির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মত ছোটবড় দেশ নিজেদেরকে এশিয়া তথা বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রগণ্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এসব দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রসরমানতার নেপথ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানের প্রত্যাশাকে জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে ফলপ্রসূ করে তুলতে দেশের কৃষক-শ্রমিকের জীবনমানের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিরলস ও আপসহীন ভূমিকা। মুসলমান সুলতান ও মুঘল বাদশারা যে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের ভিত্তি রচনা করেছিলেন ঐতিহাসিকভাবে তা তৎকালীণ বিশ্বব্যবস্থায় অগ্রগণ্য বিবেচিত হয়েছে। প্রায় ২০০ বছর ধরে নানাভাবে সম্পদ লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে বৃটিশরা এ দেশের যতটা ক্ষতি করেছিল, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ডিজইনফর্মেশনের মধ্য দিয়ে তাদের ডিভাইড অ্যান্ড রোল পলিসি মুঘল ভারতের ঐক্য ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ততটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেই বিষবৃক্ষের পরগাছা এখনো উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের অগ্রগতির পথে বড় ধরণের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের একদেশদর্শী ভূমিকা তার প্রতিবেশিদের জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষত, সেক্যুলার, বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক ভারত যখন হিন্দুত্ববাদের আধিপত্যবাদী নীতির দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও নৃগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে। দিল্লী, গুজরাট, হরিয়ানায় রক্তক্ষয়ী অগ্নিগর্ভ দাঙ্গা এবং কাশ্মির-পাঞ্জাব থেকে আসাম-পশ্চিমবঙ্গ এবং মণিপুরের রাজনৈতিক সংঘাতকে সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। প্রতিবেশী বড় দেশের এসব রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক ঘটনা ও রাষ্ট্রীয় নীতির আঁচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেও লাগছে। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী নীতি এবং মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করার ধারাবাহিক ঘটনাক্রম এবং রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এখনে একটি পরিকল্পিত এথনিক ক্লিনজিংয়ের আলামত হয়ে দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘের তরফ থেকে ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড ওয়াচের পরিচালক, গ্রেগরি স্টেন্টনের তরফ থেকে ভারতে একটি পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক মুসলিম গণহত্যার বিষয়ে একাধিকবার বিশেষ সতর্কতা জারি করা হলেও অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের সাথে কৌশলগত সম্পর্কের নিগড়ে আবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখন একটি হাইব্রিড রিজিমে পরিনত হয়েছে। সেখানকার মানবাধিকার ও সাম্প্রদায়িক নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরণের সংকট দেখা দিলেও শুধুমাত্র চীন-রাশিয়াকে মোকাবেলায় আঞ্চলিক পার্টনার হিসেবে পশ্চিমারা এ নিয়ে ভারতকে ততটা ঘাটায়না। এ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের একটি অংশের জোরালো কণ্ঠস্বরকে কখনো রুদ্ধ করা যায়নি। কাশ্মির কখনোই ভারতের অংশ ছিল না, এটা ভারতের হাইকোর্টের রায়েও স্বীকৃত হয়েছে। কাশ্মিরের আজাদি এবং ভারতীয় ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে লেখিকা অরুন্ধতী রায় এবং কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ শওকত হোসেনের ২০১৩ সালে দেয়া বক্তব্য নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা রুষ্ঠ হয়ে এফআইআর করেছিল। সেই এফআইআরের সুত্র ধরে ‘হেইট স্পীচ’র অভিযোগে এখন তদন্ত করে অরুন্ধতী রায়কে ফাঁসিয়ে দেয়ার আয়োজন চলছে। যেকোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করলেও কোনো একটি রাজনৈতিক দলের একক আধিপত্য যখন কর্তৃত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী চরিত্র গ্রহণ করে তখন বিচার বিভাগের আলাদা ও স্বাধীন অবস্থান ক্রমে লুপ্ত হতে শুরু করে। অরুন্ধন্তী রায়ের লেখা ‘আজাদি’ নামের প্রবন্ধটি ফরাসি অনুবাদে ‘আজাদি: ফ্রিডম, ফ্যাসিজম, ফিকশন’ শিরোনামে প্রকাশিত হওয়ার পর এ বছর ইউরোপের অন্যতম মূল্যবান সাহিত্য পুরস্কার ৪৫তম ‘প্রি অয়রোপিন দ্য লেসাই’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কারের জুরিবোর্ড মন্তব্য করেছেন, প্রবন্ধকে হাতিয়ার করে আজকের বিশ্ব রাজনীতিকে সবচেয়ে বড় সমস্যার বিরুদ্ধে অরুন্ধতী রায় লড়ছেন এবং ফ্যাসিজমের নানামাত্রিক স্বরূপ উদঘাটন করেছেন। ইসরাইলের জায়নবাদী ফ্যাসিবাদ ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে দাবিয়ে রাখতে যেভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে নিরাপত্তাহীন, উত্তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত করেছে, ঠিক একই কায়দায়, আরো বৃহত্তর পরিসরে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় মুসলমান ও কাশ্মিরিদের অধিকার ও স্বাধীনতার দাবিকে দাবিয়ে রাখতে চরম নিবর্তন ও সামরিক দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের সব কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছে। আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঁদে সওয়ার হয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে অরুন্ধতী রায়ের মত সাহসী কণ্ঠস্বরগুলোকে চারদেয়ালে আবদ্ধ করতে পারলে ভারতে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর পশ্চিমা বিশ্ব শুনতে পাবে না, এমনটা হয়তো এখন আর সম্ভব নয়। গত মার্চ মাসে টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ইন্ডিয়া টার্নড আ ম্যানহান্ট ইনটু মাস রিপ্রেশন। দি মিডিয়া ইজ ফেইলিং টু টেল দ্য রাইট স্টোরি’। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আটলান্টিক ফেলো-অ্যাকাডেমিসিয়ান, নেলসন মেন্ডেলা ফাউন্ডেশনের ফেলো ও অ্যাক্টিভিস্ট সিমরান জিৎ সিংয়ের লেখা প্রতিবেদনে পাঞ্জাবের শিখদের উপর ভারত সরকারের নিবর্তনমূলক নানা তৎপরতার ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। ভারত সরকারের এমন নির্বতনমূলক ভূমিকা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়া শিখদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতাকে প্রকারান্তরে উস্কে দিয়েছে। ভারতীয় ডায়াসপোরায় শিখদের অবস্থানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সম্প্রতি কানাডায় খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদিপ সিং নিজ্জার হত্যাকা-ের সাথে ভারতের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রতি সরাসরি আঙুল তুলেছে কানাডা সরকার। এ নিয়ে কানাডা-আমেরিকার সাথে এক প্রকার ঠান্ডা লড়াইয়ে অবর্তীণ হয়েছে ভারতের বিজেপি সরকার।

ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো একধরণের স্ট্র্যাটেজিক ভূমিকায় থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল তথা সাধারণ মানুষের অনাস্থা খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কার পর সম্প্রতি মালদ্বীপের নির্বাচনে ভারতপন্থীদের ভরাডুবি ও চীনপন্থীদের ক্ষমতাসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে তার একটা প্রতিফলন দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত বাংলাদেশই হচ্ছে একমাত্র ব্যতিক্রম। ভিন্নভাবে বলা যায়, পশ্চিমাদের ওয়ার অন টেরর এবং ইসলামোফোবিক এজেন্ডাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের নিয়ন্ত্রণ কৌশল বাংলাদেশে একটি বশংবদ রিজিম প্রতিষ্ঠায় বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছিল। ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য গুটিয়ে নেয়ার পর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ওয়ার অন টেররিজমের পুরনো এজেন্ডা বাতিল করার পর জো-বাইডেন প্রশাসন আবারো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে পুরনো সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব ঝালিয়ে নিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মানদ-কে সামনে নিয়ে এসেছে। এসব মানদ-ে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার পশ্চিমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশেষত মার্কিনীরা আর ভারতের এই রিজিমের হাতে প্রতিবেশীদের উপর পশ্চিমা স্বার্থ কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণের পরোক্ষ দায়িত্ব দিতে রাজি নয়। ভারতের অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি, জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। একটি বিশেষ দলের প্রতি ভারত সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মত মৌলিক বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি কার্যত দেশকে একটা ফ্যাসিবাদী অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশের শতকরা অন্তত ৯০ ভাগ মানুষ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। তারা সকল রাজনৈতিক পক্ষের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত করতে চায়। সংবিধানের যেসব পরিবর্তন মানুষের মানবাধিকার ও ভোটাধিকার লঙ্ঘন করে কোনো ক্ষমতাসীন দলকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সুযোগ দেয়, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার এবং বিশেষ কিছু সেক্টরে বল্গাহীন দুর্নীতির ইম্যুউনিটি দেয়, সংবিধান থেকে সব অপআইন, নিবর্তনমূলক আইনগুলোকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র মেরামতের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চিত করা ছাড়া এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধের কোনো বিকল্প নেই।
বিশ্ব যখন এক গভীর ক্রান্তিকাল ও যুগসন্ধিক্ষণের ভেতর দিয়ে একটি অবশ্যম্ভাবি পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন আমরা পুরো জাতি এক ধরণের ডিলেমা বা উভয় সংকটের দুর্বিসহ সময় পার করছি। পশ্চিমাবিশ্ব ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলী ফ্যাসিবাদী গণহত্যায় রসদ ও ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে, তখন আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রত্যাশা ও দাবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রূপরেখা বাস্তবায়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরবচ্ছিন্নভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের সচেতন, আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকের কাছে এটা কাক্সিক্ষত নয়। আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর (ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদল) ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতালিপ্সা এর জন্য দায়ী। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মানদ-ে আমাদের শাসকশ্রেণী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বাণিজ্যব্যবস্থার সম্মুখসারির কুশীলবরা জবাবদিহিতার বাইরে নন। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য গঠিত দেশের এলিটফোর্সসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন ক্ষমতাসীনদের গদি রক্ষায় মানুষের সাংবিধানিক আইনগত অধিকারকে পদদলিত করে গুম-খুন ও বিরোধীমত দমনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন এসব বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্য, দুর্বৃত্তায়িত আমলা, ব্যবসায়ী, বিচারক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের উপর বিদেশি শক্তির নিষেধাজ্ঞা কিংবা নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ সাধারণ মানুষ এবং ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট প্রধান শক্তিগুলোর সমর্থন পাচ্ছে। দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরকারি বাহিনী দিয়ে নির্মূল করার ফ্যাসিবাদী প্রকল্পে এবার বাঁধ সেধেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তৃতীয় বিশ্ব কিংবা গ্লোবাল সাউথে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমাদের আগ্রহ ও ভূমিকা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও এবার বাংলাদেশে তাদের ভূমিকায় দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ যথেষ্ট আশাবাদী। তবে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নোত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সাফল্য শুধুমাত্র দেশের জনগণের ব্যাপক ও স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল