ব্রিটেনের বিশ্বাসঘাতকতাই দায়ী
২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
ইসরাইলি বর্বর আগ্রাসন ও নিষ্ঠুর হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এখন এক বিধ্বস্ত জনপদ। মাত্র ৪১ কিলোমিটার লম্বা ও ৬-৮ কিলোমিটার চওড়া ছোট্ট একটি ভূখ-, যা সাগর, ইসরাইল ও মিসর দ্বারা পরিবেষ্টিত। অবরুদ্ধ গাজাবাসীর উপর রকেট, শেল ও ফসফরাস বোমা, ছাদ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ডেন্স ইন্টারমেন্টাল এক্সপ্লোসিভ ফেলা হয়েছে। বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে মায়ের কোলের শিশুসহ কয়েক হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধুলোয় মিশে গেছে অফিস আদালত এবং বসতবাড়ি, গাজায় নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়। নিরাপরাধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁদছে। কিন্তু গাজাবাসীর বড়ই দুর্ভাগ্য যে, তাদের আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙ্গেনি বিশ্বের কর্তা ব্যক্তিদের। জাতিসংঘ একেবারেই নিশ্চুপ ও নির্বিকার। একইভাবে নির্বিকার মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেকটাই নির্বিকার, নিশ্চুপ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের পর তুরস্ক ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে সমগ্র মুসলিম জাহানকে উদ্দেশ্য করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। অটোমান তুর্কিরা মনে করেছিল, সা¤্রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জিহাদের এই আহ্বান ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। কিন্তু তাদের এ আশা ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, তুর্কি সা¤্রাজ্যভুক্ত আরবদের একটি বড় অংশ মক্কার শরিফ হুসাইনের নেতৃত্বে নিষ্ক্রিয় থাকে। আরবদের আরেক শক্তিশালী নৃপতি ইবনে সউদও জিহাদের ডাকে সাড়া দেন নাই। দক্ষিণ আরবের প্রভাবশালী শাসক ইদ্রিসি মোহাম্মদও তুর্কিদের ডাকে কর্ণপাত করেননি। তাছাড়া কুয়েতসহ শেখ শাসিত অন্যান্য আরব অঞ্চলের সঙ্গে ব্রিটেনের চুক্তি থাকায় এসব অঞ্চলের শাসকগণও তুর্কিদের ডাকে সাড়া দেননি। অন্যদিকে ১৯১৪ সালের ৩১ অক্টোবরে ব্রিটিশ যুদ্ধ-মন্ত্রী লর্ড কিচেনার শরিফ হুসাইনকে এই বলে আশ্বাস দেন যে, যদি শরিফ হুসাইন এবং তার সমর্থকগণ যুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সাহায্য করে তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাকে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারসহ হেজাজের গ্রান্ড শরিফ হিসাবে নিযুক্তির নিশ্চয়তা দেবে এবং যে কোন প্রকার বেদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এছাড়া সাধারণভাবে আরবদের মুক্তিতে সহযোগিতা এবং হুসাইন কর্তৃক একটি আরব খেলাফত ঘোষিত হলে তাকে ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি প্রদানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আরবদের যে ফেডারেশনের স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল উত্তরে মার্সিন ও আদানা হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত। পূর্বে পারস্য সীমানা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত; দক্ষিণে এডেন ব্যতীত ভারত মহাসাগর পর্যন্ত; পশ্চিমে লোহিত সাগর হতে ভূমধ্যসাগর হয়ে পুনরায় মার্সিন পর্যন্ত।
ফিলিস্তিনকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যর সীমানাভুক্ত করা হয়েছিল কি না প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই বিষয় তুমূল বিতর্ক শুরু হয়। আরবদের মতে, ব্রিটেন কর্তৃক প্রতিশ্রুত আরব রাজ্যের সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিনও ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জানায়, ফিলিস্তিনের বিষয়ে আরবদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। হুসাইন ম্যাকমোহন পত্রালাপে মূল বিষয়বস্তু ছিল প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সিমানা নির্ধারণ। সুতারাং পত্রাগুলির যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কেবল ফিলিস্তিনের বিষয় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং এর ফলে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব। মজার ব্যাপার হলো, এই পত্রালাপের কোথাও ফিলিস্তিন শব্দটির উল্লেখ নেই। এই প্রসঙ্গে হুসাইনের নিকট ম্যাকমোহনের দ্বিতীয় পত্রে উল্লেখিত দামেস্ক, হমস, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহর পশ্চিমে অবস্থিত সিরীয় ভূখ- (চড়ৎঃরড়হ ড়ভ ঝুৎরধ ষুরহম ঃড় ঃযব বিংঃ ড়ভ ঃযব ফরংঃৎরপঃং ড়ভ উধসধংপঁং. ঐড়সং, ঐধসধ ড়হব অষষবঢ়ঢ়ড়) বাক্যাংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য হলো, এই বাক্যাংশটি ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যাকমোহন যেসব অঞ্চল প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে ফিলিস্তিন ছিল। ১৯২২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, ফিলিস্তিন বিষয় আরবদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তিনি যুক্তি দেখান, বাক্যাংশে ব্যবহত ফরংঃৎরপঃং শব্দটি দিয়ে আরবী ারষধুবঃং কে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু উক্ত বাক্যাংশটি যথাযথ বিশ্লেষণ করলে তার এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। প্রথমত, আরবী শব্দ ভিলায়েত অর্থ প্রদেশ, যা কোনভাবেই ইংরেজি ফরংঃৎরপঃং এর প্রতিশব্দ নয়। বরং ফরংঃৎরপঃং কে আরবী সানজাক বা জেলার প্রতিশব্দ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। দ্বিতীয়ত, ম্যাকমোহন কর্তৃক ব্যবহৃত এই বাক্যাংশে ফরংঃৎরপঃং শব্দটি ারষধুবঃং বুঝতে যে ব্যবহৃত হয়নি তারও প্রমাণ রয়েছে। কেননা দামেস্ক, হমস, হামা নামে কোনো ভিলায়েত ছিল না। তখন সিরিয়া ভিলায়েত নামে একটি মাত্র ভিলায়েত ছিল, যা আরবীতে ‘ভিলায়েত-আস-সুরীয়’ নামে পরিচিত ছিল। দামেস্ক ছিল এই ভিলায়েতের রাজধানী। আর হমস এবং হামা ছিল ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। সুতারাং ম্যাকমোহনের ব্যবহৃত ফরংঃৎরপঃং শব্দটি একমাত্র জেলাসমূহ শব্দের সমার্থক শব্দ হিসাবে বিবেচনা করলেই বাক্যাংশটি অর্থপূর্ণ হয়। এর ফলে উল্লেখিত চারটি শহর সংলগ্ন সিরিয়ার পশ্চিম অঞ্চলকে বুঝায়, যা সাইদন থেকে আলেকজান্দ্র্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দামেস্ক শহরটিকে সিরিয়া ভিলায়াতের সমর্থক বিবেচনা করে আকাবা পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রদেশের পশ্চিমাংশকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ফলে জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিনিও প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের বাইরে বলে যুক্তি দেখান, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি ফিলিস্তিনকেও আরব রাজ্যের বাইরে রাখার ইচ্ছা থাকতো তাহলে নিশ্চয় তিনি আলেপ্পো ও বৈরুত ভিলায়েতের সঙ্গে জেরুজালেম সানজাক বা জেলার কথাও উল্লেখ করতেন।
একইসঙ্গে তারা ইউরোপের ইহুদিদের যুদ্ধ সহযোগিতা পাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয় যে, গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধে জয়ী হলে তারা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহযোগিতা করবে; অর্থাৎ একইসাথে আরবদের দেয় একরকম প্রতিশ্রুতি আর ইহুদিদের দেয় আরেক রকম প্রতিশ্রুতি। ম্যাকমোহন আরবদের প্রতিশ্রুতি দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯১৫ সাালের অক্টোবর মাসে এবং লর্ড-বেলফোর ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দেয় ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর মাসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অ্যাসিটনের অভাব দেখা দেয়। অ্যাসিটন বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করতে লাগে। জাইনিস্ট নেতা ছিলেন বিলাতের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং ১ম শ্রেণির জীবাণুবীদ ও জৈব রসায়নবীদ। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, অ্যাসিটন তৈরির গোপন এক কৌশল তিনি আবিষ্কার করেছেন। ব্রিটিশ সরকার যদি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে দেয় তবে তিনি অ্যাসিটন তৈরি করে দেবেন। আবার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে দুটি কারণে-আর্থিক সংকট ও জনক্ষয়। তখন ব্রিটেন ইহুদি নেতা রথচইল্ডকে দুটি বিষয়ে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলো। প্রথমত, আর্থিক সাহায্য, দ্বিতীয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে আনা। রথচাইল্ড রাজি হলো একটি শর্তে, তাকে যুদ্ধ শেষ হলে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সুযোগ দিতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন জয়ী হলে বেলফোর ঘোষণা করেন যে, ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে দেবে। ব্রিটেন ইহুদিদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা করেছে। অথচ, মহাযুদ্ধের সময় আরবরা তুর্কিদের বিপক্ষে ব্রিটেনের সহযোগিতা না করলে তুর্কিদের সাথে যুদ্ধে জেতা ব্রিটেনের জন্য খুবই কঠিন হতো। সুতরাং, আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন ভূখ-কে কেন্দ্র করে ইসরাইল যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তার পথ সুগম করে দেয় ব্রিটেন।
লেখক: প্রভাষক বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার
আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়
হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড ইংল্যান্ড
পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল