জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিজয় অবশ্যম্ভাবী
১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
![](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2023November/1-20231114212801.jpg)
গত ১৭ বছর ধরে আমরা জাতির ক্রান্তিকালের কথা বলছি। সেই এক-এগারো সরকারের সময়ও কেউ কেউ টানেলের অপরপাশে আলোর বিচ্ছুরণ প্রত্যাশা করেছিলেন। সেই আলো আর কখনো দেখা যায়নি। একটি অসাংবিধানিক ও সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তি দুটি নির্বাচনের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠ বলে প্রতিয়মান হলেও পরবর্তীতে জানা গেল, সে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার সমঝোতার মধ্য দিয়ে। ইনকামবেন্ট শাসকদল বিএনপি-জামায়াতের সম্ভাব্য প্রায় সব প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা-হয়রানি, অনেকের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ এবং পরিকল্পিত মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে ব্যালটে গড়ানো নির্বাচনী ফলাফল স্বচ্ছতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। ইসলামোফোবিয়ার এজেন্ডাকে সামনে রেখে ওয়ার অন টেররিজমের মহাতৎপরতার নতুন বাস্তবতায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলগত মিত্র হিসেবে ভারতের যোগসাজশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে ভারতের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। মার্কিনীরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মত বিষয়গুলোর নিরিখে নিজেদের কৌশলগত মিত্রদের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণের মানদণ্ড বজায় রাখার কথা বললেও কখনো কখনো বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থের খাতিরে আপস কিংবা দ্বৈতনীতি অবলম্বনেরও ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ শাসকদের ইতিহাসের দিকে তাকালে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন এবং নব্বই দশকের মধ্যভাগে গণদাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্রা দুইমাসের মধ্যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর সংসদের বিলুপ্তি এবং খালেদা জিয়ার সরকারের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পালাবদলের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিএনপির একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাসের মাথায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে একুশ বছর পর ক্ষমতাসীন হয়। একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দেশে কিছু রাজনৈতিক গডফাদারের উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন ছাড়া কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে না পারায় ২০০১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে দেশের জনগণ ক্ষমতা পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিলে বিএনপি আবারো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল জনগণের ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। কিন্তু ইসলামোফোবিয়া, ওয়ার অন টেররিজম এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় নবম জাতীয় নির্বাচনের ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণের উপর ছেড়ে দিতে দেয়ার পরিবর্তে ভারতীয় স্বার্থ ও পরিকল্পনার উপর ছেড়ে দিয়েছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী কুশীলবরা। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া হিলারি ক্লিন্টনের টেলিফোন সংলাপে সেই তথ্য বেরিয়ে এসেছিল।
বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ আবারো ভূরাজনৈতিক কুশীলবদের দাবার গুটিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ থেকে শুরু করে ২০০৭ সালের এক-এগারো সরকার এবং নবম-একাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক ভাগ্য দূরবর্তী কুশীলবদের তৎপরতার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়েছে। তবে পরাশক্তিগুলোর বিভাজিত ও বিপরীতমুখী ভূমিকার মধ্যেও ক্রান্তিকালে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রবল আকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই জাতীয় রাজনীতির ফলাফল নির্ধারিত হতে দেখা যায়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থনকে মূল্য দিতে গিয়ে বৃটিশরা অখণ্ড বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে মতলবি ভ’মিকা পালন করেছিল। তিরিশের দশকে এসে কিছুটা লিবারেল গণতান্ত্রিক ভূমিকা নিয়ে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস হওয়ার পর বাংলার শাসনক্ষমতা হিন্দুদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় তাদের কাছে ধর্মেরভিত্তিতে বাংলা ভাগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রক্তক্ষয়ী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার মধ্য দিয়ে সে অনিবার্য বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি চীন-আমেরিকার অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এ দেশের শতকরা ৯০ভাগ মানুষের সমর্থন আত্মত্যাগ ফলাফল নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছিল। লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম, তার আকাক্সক্ষার মূল প্রেরণা ছিল একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে সে সময়ের দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা-বীরসেনানিরা হিসাব মেলাতে পারছেন না। আজকের বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে অগ্রগণ্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখন আক্ষেপ করে বলছেন, আমরা এজন্য দেশ স্বাধীন করিনি! স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের হাত থেকে দুর্নীতিবাজ, চোর ও চাটারদল দেশের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমি ভিক্ষা করে বিদেশ থেকে সাহায্য আমি, চাটারদল সব লুটে খেয়ে ফেলে। বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্যপদ পাওয়ার পর ১৯৭৪ সালের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেয়া ভাষণে এ দেশের মানুষের দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সাথে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মত বিষয়গুলোকে পরিহার করে জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের প্রত্যয়ে এ দেশের মানুষ একনদী রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা তার দল এবং সরকারের জন্য ভয়াবহ পরিনাম ডেকে আনে। গত দেড় দশকে উন্নয়নের রাজনীতির নামে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ণ, লুটপাট, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ও জনগণের সম্পদ পাচারের মচ্ছবে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল জনবিচ্ছিন্ন রেজিমে পরিনত হয়েছে।
জাতি এখন সত্যিকার অর্থেই একটি অতি গুরুত্ববহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিগত তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যখন শুধুৃমাত্র রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে, তখন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি চরম জনবিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে যেকোনো নির্বাচন বর্জনে প্রায় সব বিরোধীদলের সম্মিলিত ঘোষণা, দেশি-বিদেশি সব পক্ষের আহ্বান ও দাবি উপেক্ষা করে সরকারের তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করলে দেশ সংঘাতময় হয়ে ওঠার প্রবল আশঙ্কা বিদ্যমান। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে শাসক এবং জনগণ, শ্রমিক ও মালিক পক্ষের স্বার্থদ্বন্দ ও তার ভাগ্য নির্ধারণী পরিনতি সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের দার্শনিক, ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের বিখ্যাত উক্তিগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও মূর্ত হয়ে উঠেছে তিনি বলেছেন, সমাজতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য্য। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সিভিল ওয়ারের বাস্তবতা সম্পুর্ণভাবে বিবেচনা করি। নিপীড়িত শ্রেণীর দ্বারা নিপীড়ক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, দাস-মালিকদের বিরুদ্ধে দাসদের যুদ্ধ, ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে ভূমিহীনদের যুদ্ধ এবং বুর্জোয়া মালিকদের বিরুদ্ধে মজুরি শ্রমিকদের যুদ্ধ প্রগতিশীল ও অপরিহার্য।’ আরেকটি উক্তিতে লেনিন বলেছেন, ‘দেয়ার আর ডিকেইডস হয়ার নাথিং হ্যাপেন, অ্যান্ড দেয়ার আর উইকস হয়ার ডিকেইডস হ্যাপেন’। এর মর্মার্থ হচ্ছে, কখনো কখনো কয়েক দশকেও কিছু ঘটেনা, আবার কখনো কয়েক সপ্তাহে কয়েক দশককে ধারণ করে বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে সম্ভাবিত করে তোলে। তিনি বলেছেন, পুঁজিবাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়। আর ফ্যাসিবাদের মূল প্রবণতা হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধংদেহি অবস্থা সৃষ্টি করা। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপে জার্মানী ও ইতালিতে হিটলার-মুসোলিনিরা যে নিজ দেশে এবং অঞ্চলে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত একটি মহাযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় জায়নবাদী ইসরাইল এবং হিন্দুত্ববাদী ভারতের নাগরিক ও প্রতিবেশিরা একই ধরণের বাস্তবতার মুখোমুখি। আজকের বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ এখন যে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন, তার নেপথ্যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের দায় সবচেয়ে বেশি। দেশের সাধারণ মানুষ এবং প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তি এখন শুধুমাত্র ভোটের অধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতাসীনদের সাথে একটি গৃহযুদ্ধের বাস্তবতার কাছাকাছি অবস্থান করছে। বিএনপিসহ বিরোধিদলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। লাখ লাখ নেতাকর্মী, সমর্থকদের পরিবারের এক কোটির বেশি মানুষ রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার-নিপীড়নের ভয়ে এবং কৌশলগত কারণে আত্মগোপণে যাওয়ার কথা গণমাধ্যমে উঠে আসছে। দেশি-বিদেশি চাপ ও দাবিকে অগ্রাহ্য করে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণাসহ আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রলম্বিত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মত কিংবা ১৯৯০ সালের চেয়েও একটি প্রবল মোমেন্টাম সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। লেনিন বলেছেন, সম্ভাব্য সে গণবিস্ফোরণের (বিপ্লবের) সময় ও অগ্রগতির ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। এটি তার নিজস্ব কম-বেশি রহস্যময় আইন দ্বারা পরিচালিত হয়।
পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাজনীতির অ্যাকাডেমিক উৎস হিসেবে পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে জন্মগ্রহণকারি নিকোলা মেকিয়াভেলিকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। মেকিয়াভেলির সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘রাজনীতিতে নৈতিকতার কোনো স্থান’ নেই। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতার অনৈতিক প্রভাবের মূলসূত্র এখানেই নিহিত। অথচ মেকিয়াভেলির জন্মের শত বছর আগে চতুর্দশ শতকে (১৩২৩খৃ:) তিউনিসিয়ায় জন্মগ্রহণকারী দার্শনিক-ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক ইবনে খালদুন রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ইতিহাসের ধারাক্রম সম্পর্কে অনেক বেশি স্বচ্ছ, উদারনৈতিক, আধ্যাত্মিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমাহ গ্রন্থটিকে একই সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির আকর গ্রন্থ হিসেবে সারাবিশ্বের অ্যাকাডেমিসিয়ানদের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ বছর ইবনে খালদুনের ৭০০তম জন্মবর্ষ। মুকাদ্দিমায় সম্মিলিত জনস্বার্থ অর্থে যে ‘আসাবিয়া’ তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সামাজিক-গণতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনে ঐক্য ও শক্তির নিয়ামক হিসিবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানে অনৈতিকতার কোনো স্থান নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে ইবনে খালদুনের দুটি বিখ্যাত উক্তির বাংলা ভাবার্থ হচ্ছে, ‘সরকার হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যে কিনা সমাজে অবিচার দূর করার সাথে সাথে সে নিজেই অবিচার করা থেকে বিরত থাকার প্রতি সর্তক থাকতে হয়।’ আরেকটি বক্তব্যে ইবনে খালদুন বলেছেন, ‘ইতিহাসে এমন অনেক নজির আছে, যেখানে একেকটি জাতি বাহ্যিকভাবে পরাজিত হয়ে দুর্ভোগের সম্মুখীন হলেও তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়নি, কিন্তু যখনই কোনো জাতি মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরাজিত হয়েছে, তখনই সে জাতির বিলুপ্তি ঘটেছে।’ আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে তেমন কোনো বিদ্বেষ বা গুরুতর রাজনৈতিক বা জাতিগত স্বার্থদ্বন্দ্ব নেই। সাম্প্রতিক অতীতেও (নব্বই দশক) বর্তমান শাসকশ্রেণীর সব পক্ষকে (সরকার ও বিরোধীদল) গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রশ্নে আন্দোলন-সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যেন আমাদের সম্মিলিত শক্তিকে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়ের গ্লানির মধ্যে নিক্ষেপ করতে না পারে। সব রাজনৈতিক পক্ষকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। চীন-ভারত, রাশিয়া-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ যেন আমাদের জনগণের গণতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষাকে দমিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা দলের ক্ষমতার আকাক্সক্ষায় রাষ্ট্রশক্তির অপরিনামদর্শী অপপ্রয়োগের মাধ্যমে যদি আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ও গণতান্ত্রিক আত্মমর্যাদাবোধের চেতনা ও অধিকার হরণের পথ বেছে নিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চায়, তা আদৌ সম্ভব হবে না। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ এবং বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করছে। সব রাজনৈতিক পক্ষের নেতৃত্বে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। জাতীয় ঐতিহ্য ও সম্মিলিত স্বার্থের নিরীখে জনগণের অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে কোনো জাতির সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীরা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি জাতিকে বশংবদ করে রাখার হীন প্রয়াসে লিপ্ত হতে পারে। দেশি-বিদেশি যে শক্তি জনগণের সম্মিলিত আকাক্সক্ষার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেই তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
![প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধন কেন সিন নদীতে গোলাপ ছুড়লেন আলজেরিয়ান অ্যাথলেটরা?](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727130249.jpg)
প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধন কেন সিন নদীতে গোলাপ ছুড়লেন আলজেরিয়ান অ্যাথলেটরা?
![লৌহজংয়ে অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত্যা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727125942.jpg)
লৌহজংয়ে অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত্যা
![নিখোঁজ মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ মিললো পুকুরে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727125651.jpg)
নিখোঁজ মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ মিললো পুকুরে
![‘চরম তাপ মহামারি’ বিশ্বকে ভোগাচ্ছে: জাতিসংঘ মহাসচিব](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727125207.jpg)
‘চরম তাপ মহামারি’ বিশ্বকে ভোগাচ্ছে: জাতিসংঘ মহাসচিব
![গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727123139.jpg)
গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত
![সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727121847.jpg)
সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী
![নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727120041.jpg)
নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের
![মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727115358.jpg)
মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়
![পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727114944.jpg)
পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন
![বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727114537.jpg)
বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন
![আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727114225.jpg)
আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?
![বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/00-enter-desk-20240727114103.jpg)
বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির
![রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727113908.jpg)
রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি
![আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/00-enter-desk-20240727113341.jpg)
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’
![আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727112937.jpg)
আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা
![মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727112612.jpg)
মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা
![আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727113437.jpg)
আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
![নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/00-enter-desk-20240727111948.jpg)
নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট
![ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727111214.jpg)
ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ
![চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240727110739.jpg)
চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা