ঢাকা   বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০ আশ্বিন ১৪৩১

হাছন রাজা এবং তার অবিস্মরণীয় গান

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম

মরমী কবি হাছন রাজার ১৬৯তম জন্মদিন ছিল গতকাল। ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর, বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে দেওয়ান পরিবারে তার জন্ম হয়। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লক্ষণশ্রীই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তিনি বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। আবার সুরের সাধকও ছিলেন। তিনি তার গানের মাধ্যমে আবহমান বাংলার কৃষ্টি-শিল্প-সংস্কৃতি ও বাংলার গৌরবকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মরমী সাধক হাছন রাজা তার জীবনে শতশত গান রচনা করেছেন। ‘একদিন তোর হইব রে মরণ রে হাছন রাজা’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে কান্দে হাছন রাজা মন মনিয়া রে’, ‘প্রেমের বান্ধন বান্ধরে দিলের জিঞ্জির দিয়া’, ‘রঙের বাড়ই রঙের বাড়ই রে’, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে’, ‘লোকে বলে ঘরবাড়ি ভালানা আমার’, ‘আগুন লাগাইয়া দিলো কুনে হাছন রাজার মনে’Ñ এরকম জনপ্রিয় অসংখ্য গানের জনক হাছন রাজা। হাছন রাজার গানে সহজ-সরল স্বাভাবিক ভাষায় মানবতার চিরন্তন বাণী যেমন উচ্চারিত হয়েছিল, তেমনি, আধ্যাত্মিক ভাব-ভাবনাও সম্প্রচারিত হয়েছে। সকল ধর্মের বিভেদ অতিক্রম করে তিনি গেয়েছেন মাটি ও মানুষের গান।

হাছন দর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে ওহফরধহ চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ ঈড়হমৎবংং এ বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, যা ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।’ এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাছন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন।
‘লোকে বলে বলেরে
ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার’
এই গান শোনেনি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বলে। এই মানবতার সাধনার একটি রূপ হল মরমী সাধনা। যে সাধনা হাছন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তার রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদার হাছন কীভাবে একজন দরদী জমিদার এবং মরমিয়া কবি হলেন, সেটা কম বিস্ময়কর নয়। হাছনের পূর্ব পুরুষের আদিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন হিন্দু। অতঃপর তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পরে সেখান থেকে সিলেটে এসে থিতু হন। তার দাদা মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হাছনের দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা মাতৃ-পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার শিকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাছন জমিদারীতে অভিষিক্ত হন। হাছন বেশ সুপুরুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবি ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তখন সিলেটে ঘরে ঘরে আরবি ও ফার্সির চর্চা ছিল। হাছন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং শৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত রাখতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাছন প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজি নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হতো। সেই গানের মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং নিজের কৃতকর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার! লোক মুখে শোনা যায়, একদিন তিনি একটি আধ্যাত্মিক স্বপ্ন দেখেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করেন। জীবনযাত্রায় আনেন অনেক পরিবর্তন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজ খবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় স্কুল, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করেন। সেই সাথে চলতে থাকে গান রচনা।
১৯০৭ সালে তার রচিত ২০৮টি নিয়ে গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাছন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ’সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনও সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্তও হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ ‘শৌখিন বাহার’র আলোচ্য বিষয় ছিল: ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও বুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন, হাছন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। ‘হাছন বাহার’ নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার কিছু হিন্দি গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। হাছন রাজার গানের মধ্যে গভীর জীবন দর্শন ও আত্মোপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে। হাছন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট, নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা হাছন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এছাড়াও সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটিও অন্যতম দর্শনীয় স্থান। পাশেই রয়েছে তাঁর কবর, যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত অনুসারী ভিড় করেন তাঁর প্রতি শদ্ধা জানাতে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কক্সবাজারে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল- জামায়াত নেতৃবৃন্দ

কক্সবাজারে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল- জামায়াত নেতৃবৃন্দ

হাবের বিতর্কিত কমিটিকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করতে হবে বৈষম্য বিরোধী হজ এজেন্সীর মালিকবৃন্দ

হাবের বিতর্কিত কমিটিকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করতে হবে বৈষম্য বিরোধী হজ এজেন্সীর মালিকবৃন্দ

অপপ্রচারের প্রতিবাদ জামপুর বিএনপি নেতার

অপপ্রচারের প্রতিবাদ জামপুর বিএনপি নেতার

একদিনের ব্যবধানে বাড়ল সোনার দাম

একদিনের ব্যবধানে বাড়ল সোনার দাম

জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩২ জনের জামিনের আদেশ বাতিল

জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩২ জনের জামিনের আদেশ বাতিল

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষক ছিলেন দুদকের আবু বকর সিদ্দিক

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষক ছিলেন দুদকের আবু বকর সিদ্দিক

চিরিরবন্দরে সম্প্রীতির ফুটবল ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

চিরিরবন্দরে সম্প্রীতির ফুটবল ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

সোনালী অতীত ক্লাবের পদ ছাড়লেন গাফফার

সোনালী অতীত ক্লাবের পদ ছাড়লেন গাফফার

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে -বিজিএমইএ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে -বিজিএমইএ

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা তানজিম হত্যায় জড়িত ৬ জন আটক

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা তানজিম হত্যায় জড়িত ৬ জন আটক

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুই শ’কোটি টাকা আত্মসাত

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুই শ’কোটি টাকা আত্মসাত

জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল আর নেই

জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল আর নেই

শ্রীপুরে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যুবদল-কৃষকদলের সংঘর্ষ

শ্রীপুরে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যুবদল-কৃষকদলের সংঘর্ষ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে-বিজিএমইএ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে-বিজিএমইএ

চকরিয়ায় সেনা সদস্য তানজিম হত্যায় জড়িত ডাকাতদের স্বীকারোক্তি

চকরিয়ায় সেনা সদস্য তানজিম হত্যায় জড়িত ডাকাতদের স্বীকারোক্তি

বিআরটিএ-র সকল অভিযোগ দ্রুত সমাধান করা হবে ঃ গৌতম চন্দ্র পাল

বিআরটিএ-র সকল অভিযোগ দ্রুত সমাধান করা হবে ঃ গৌতম চন্দ্র পাল

বন্দিদশা থেকে মুক্তি চান শরীর গঠন বিদরা!

বন্দিদশা থেকে মুক্তি চান শরীর গঠন বিদরা!

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন