ঢাকা   বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০ আশ্বিন ১৪৩১

নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ

Daily Inqilab ইনকিলাব

২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম

দেশে আর একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৭ জানুয়ারি, এমনটিই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ‘পূর্ব নির্ধারিত ফলাফলে’র এহেন নির্বাচনের আয়োজন চলছে পুরোদমে। ‘নিজেরা করি’ ধরনের নির্বাচনের আদৌ দরকার আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, এ নির্বাচন না হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক, না হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক আলোচনা সভায় বিশিষ্ট বক্তারা বলেছেন, আর একটি একতরফা নির্বাচন দেশের অর্থনীতিকে আরো ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করবে। বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করে এমন নির্বাচন করার প্রয়োজন আছে কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। বক্তারা বিভিন্ন প্রসঙ্গে বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচন, অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি নিয়ে তারা কথা বলেছেন। এর মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ সম্পর্কে তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘প্রচারণা রয়েছে, বাংলাদেশে পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ করছে। বাস্তবে এখানে পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে, আবার অপশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে। এখন বলা হচ্ছে, পশ্চিমারা এখানে হস্তক্ষেপ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারত কি এখানে হস্তক্ষেপ করেনি? তারাও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে।’ তৌহিদ হোসেনকে ধন্যবাদ, তিনি ভারতের হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন। জানা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভারতের নাম মুখে নেয় না। এ কথা কারো অবিদিত নেই, নির্বাচনে ভারতের সরাসরি ও প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ ঘটে ২০১৪ সালে। ওই নির্বাচনে প্রায় সব বিরোধীদল অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল। এমতাবস্থায়, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে ছুটে আসেন এবং জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে ভূমিকা রাখেন। এর চেয়ে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের নজির আর কীভাবে হতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব বিরোধী দল অংশ নিলেও দিনের ভোট আগের রাতেই হয়ে যায়। দিনের নামকাওয়াস্তের ভোটেও ব্যাপকবাবে কেন্দ্র দখল, সিল মারা ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। দুটি নির্বাচনই দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয়। স্মরণ করা দরকার যে, ভারতই একমাত্র দেশ যে, ওই দুটি নির্বাচনকেই গ্রহণযোগ্য বলে ‘সনদ’ প্রদান করে।

২০১৪ সালের নির্বাচন ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন যাতে গণতান্ত্রিক বিধিসম্মত এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়, সেটা যেমন দেশের মানুষের চাওয়া, তেমনি বন্ধু, উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষ করে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও একান্ত প্রত্যাশা। ২০২২ সাল থেকেই তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ লাগাতার তাকিদ দিয়ে যাচ্ছে। এটাকেই বলা হচ্ছে নির্বাচনে বা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ। সরকারি দলের তরফ থেকে যেমন একে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, অনুরূপভাবে সরকারি দলের সমর্থক হিসেবে পরিচিত নাগরিকদের একটি গোষ্ঠিও বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে এটা জানান দেয়ার চেষ্টা করেছে। প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্রের কথা বলা, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা, মানবাধিকারের কথা বলা কিংবা রাজনৈতিক নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধের কথা কি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ? যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ বরাবর বলছে, তারা কোনো দলের পক্ষ হয়ে নয়, অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও মানবাধিকারের পক্ষেই কথা বলছে। কিন্তু তাদের এই বক্তব্য সরকারি মহলে কিংবা তার মিত্র বলে পরিচিত দেশগুলো মানতে চাইছে না। ভারত, রাশিয়া ও চীন সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছে। সিজিএস’র অনুষ্ঠানে নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবির রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এই পাতানো ডামি প্রার্থীর নির্বাচনে ভারত, রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিচ্ছে।’ উল্লেখ্য, এই তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের তরফে বলা হয়েছে, এ ধরনের হস্তক্ষেপ চীন সমর্থন করে না। রাশিয়া তো স্পষ্ট করেই বলেছে, বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবির আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারভ তার এক্স একাউন্টে এক বার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকারবিরোধী মহাসমাবেশের আয়োজনে বিরোধীদলের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছেন। এর জবাবে পিটার হাস বলেছেন, দুই পরাশক্তির মধ্যে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্য অভিযোগ নতুন সংযোজন।

আগের দুই নির্বাচনে ভারতের অবস্থান আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশটি তার অবস্থানের কথা উহ্য রাখলেও পর্যবেক্ষক মহলের মূল্যায়ন, এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ভারত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষেই যে আছে বা থাকবে, সে ব্যাপারে তারা শতভাগ নিশ্চিত। ভারতের সঙ্গে এ সরকারের সম্পর্ক কেমন, তা এদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের বিভিন্ন সময়ে দেয়া বয়ানেই প্রকাশ পেয়েছে। ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জবানীতেও এ সম্পর্কের গুণগান যথেষ্টের অতিরিক্তই গাওয়া হয়েছে। দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে এগিয়ে চলেছে বলে দাবি দু’ পক্ষেরই। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থানের বাইরে যাবে ভারতের অবস্থান, তা হতেই পারে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দাবির বিপক্ষেই ভারত আছে, তাতেও কোনো সংশয় নেই। কদিন আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটা দেশের জনগণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ঠিক করবে। বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশে নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে মূল্যায়নের অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। পঙ্কজ সরণের এ বক্তব্য প্রমাণ করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে ভারত সরে আসেনি। বাংলাদেশ সরকার যেভাবে নির্বাচন করছে, তাতে দৃঢ় সমর্থন রয়েছে ভারতের।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কক্সবাজারে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল- জামায়াত নেতৃবৃন্দ

কক্সবাজারে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল- জামায়াত নেতৃবৃন্দ

হাবের বিতর্কিত কমিটিকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করতে হবে বৈষম্য বিরোধী হজ এজেন্সীর মালিকবৃন্দ

হাবের বিতর্কিত কমিটিকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করতে হবে বৈষম্য বিরোধী হজ এজেন্সীর মালিকবৃন্দ

অপপ্রচারের প্রতিবাদ জামপুর বিএনপি নেতার

অপপ্রচারের প্রতিবাদ জামপুর বিএনপি নেতার

একদিনের ব্যবধানে বাড়ল সোনার দাম

একদিনের ব্যবধানে বাড়ল সোনার দাম

জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩২ জনের জামিনের আদেশ বাতিল

জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩২ জনের জামিনের আদেশ বাতিল

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষক ছিলেন দুদকের আবু বকর সিদ্দিক

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষক ছিলেন দুদকের আবু বকর সিদ্দিক

চিরিরবন্দরে সম্প্রীতির ফুটবল ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

চিরিরবন্দরে সম্প্রীতির ফুটবল ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

সোনালী অতীত ক্লাবের পদ ছাড়লেন গাফফার

সোনালী অতীত ক্লাবের পদ ছাড়লেন গাফফার

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে -বিজিএমইএ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে -বিজিএমইএ

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা তানজিম হত্যায় জড়িত ৬ জন আটক

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা তানজিম হত্যায় জড়িত ৬ জন আটক

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুই শ’কোটি টাকা আত্মসাত

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুই শ’কোটি টাকা আত্মসাত

জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল আর নেই

জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল আর নেই

শ্রীপুরে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যুবদল-কৃষকদলের সংঘর্ষ

শ্রীপুরে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে যুবদল-কৃষকদলের সংঘর্ষ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে-বিজিএমইএ

পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে-বিজিএমইএ

চকরিয়ায় সেনা সদস্য তানজিম হত্যায় জড়িত ডাকাতদের স্বীকারোক্তি

চকরিয়ায় সেনা সদস্য তানজিম হত্যায় জড়িত ডাকাতদের স্বীকারোক্তি

বিআরটিএ-র সকল অভিযোগ দ্রুত সমাধান করা হবে ঃ গৌতম চন্দ্র পাল

বিআরটিএ-র সকল অভিযোগ দ্রুত সমাধান করা হবে ঃ গৌতম চন্দ্র পাল

বন্দিদশা থেকে মুক্তি চান শরীর গঠন বিদরা!

বন্দিদশা থেকে মুক্তি চান শরীর গঠন বিদরা!

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন