ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

এটাই কি সোনার বাংলা?

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম

সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটি পোষ্টার ছিল- ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’। সেখানে পাকিস্তানের দুই অংশে পণ্যমূল্য এবং উন্নয়ন বাজেটের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। এসব প্রচারণা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে যথেষ্ট ইতিবাচক ফল দিয়েছিল। নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের টালবাহানা এবং ২৫মার্চ রাতে সামরিক বাহিনীর ক্র্যাক-ডাউনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে আমরা এখন কী দেখছি! গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, আয়বৈষম্যসহ সব ক্ষেত্রেই আজ আমাদের রাষ্ট্র সীমাহীন দুর্বিপাকে নিমজ্জিত। রাষ্ট্রীয় সম্পদের বল্গাহীন লুন্ঠন, আয়বৈষম্য এবং অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট দেশের সাধারণ মানুষ এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অসহায়ত্ব বোধ করছে।

সম্প্রতি ঘোষিত খানা জরিপে নানা রকম অসঙ্গতি ও দেশের মানুষের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বৈষম্যের তথ্যগুলো নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিছু অসঙ্গতি দূর করে গত বুধবার ‘খানা জরিপ- ২০২২’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস)। এই প্রতিবেদনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয়-ব্যয়ের যে চিত্র দেখা যায়, তা রীতিমত উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ লুণ্ঠনের কারণে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা একটি শ্রেণী রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে, অন্যদিকে অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে নাকাল- নাভীশ্বাস অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। জীবনমানের উন্নয়ন অনেক দূরের কথা, খাদ্য ও বাসস্থানের খরচসহ সংসারের মৌলিক খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে। খানা জরিপের তথ্য অনুসারে, প্রতি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩৯৮০ টাকা। বিবিএসের হিসাবে দেশের ৩৭ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন ব্যয় এবং ঋণের অর্থে সংসার চালাতে গিয়ে মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পুরণ করতে পারছে না। গড়ে দেশের ২১ শতাংশের বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। একশ্রেণীর লুটেরা রাজনীতিক ও আমলার সম্পদ লুন্ঠনের প্রতিযোগীতায় নব্য শ্রেণীর ধনীরা আরো ধনী এবং গরীব আরো গরীব ও নি:স্ব হয়ে পড়ছে। ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বাস্তবতায় তথাকথিত উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির দাবি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অর্থপাচার ও ব্যাংক লুটেরাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পরিস্থিতি ক্রমে জটিল করে তুলেছে।

গত ১৫ বছর ধরে দেশের মানুষ সরকারি প্রচারযন্ত্রে উন্নয়নের গল্প শুনছে। অবকাঠামো খাতে হাজার হাজার কোটি ডলারের উন্নয়ন ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কিংবা জীবনযাত্রাকে সহজ করতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বোঝা জনগণের কাঁেধই পড়ছে। একদিকে জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের ভার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, অন্যদিকে অনিয়িন্ত্রিত সম্পদ পাচারের কারণে ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পড়ে সাধারণ মানুষও ঋণগ্রস্ত ও দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন বোঝায় না। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, জীবিকার নিরাপত্তা, মৌলিক চাহিদা পুরণের নিশ্চয়তা এবং সুশাসন ছাড়া এসব উন্নয়নের কোনো মূল্য নেই। দেশের সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অতি ক্ষুদ্র অতি ধনিক শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসেবে সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠি নি¤œ আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ। আয়বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার এমন বাস্তবতায় উন্নয়নের সূচকগুলো জনগণের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন মূল্যস্ফীতি রোধ করার পাশাপাশি নিরাপত্তা, সুশাসন এবং সমাজ ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া এ থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। দেশে আরেকটি একতরফা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ক্ষমতাসীন দল সুশাসনের অঙ্গীকারসমৃদ্ধ নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকার তথাকথিত উন্নয়নের রাজনীতির কথা বললে পরিস্থিতি এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ক্রমাবনতিশীল। চরম বৈষম্যপীড়িত অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের এখন একটাই প্রশ্ন: এটাই কি সোনার বাংলা?


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো