ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি বদলে দেয়ার অধিনায়ক শহীদ কাসেম সুলাইমানি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম

হাজার বছর ধরে আমাদের বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত। একাদশ শতকের ক্রুসেড থেকে আজকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি। ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিভক্তির এই ভেদরেখা বারবার পরিবর্তিত হলেও পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতি এখনো জেরুজালেমের উপর জায়নবাদি দখলদারিত্বের উপর নিবদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে ¯œায়ুযুদ্ধ এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সাথে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব নব্বইয়ের দশকে এসে ইসলামোফোবিক এজেন্ডায় রূপান্তরিত হয়। নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী বিমান হামলার দায়ভার সরাসরি আলকায়দার উপর চাপিয়ে মুসলিম বিশ্বের সাথে আক্ষরিক অর্থে একটি নতুন ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও ন্যাটোর যুদ্ধবাজ জেনারেলরা। মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বব্যবস্থার উপর ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের আয়রণ কার্টেন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানে আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবই মূলত পশ্চিমাদের নতুন বিশ্বব্যবস্থার ধারণায় নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়। অন্যদিকে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী আগেই তাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে চলার রোডম্যাপ তৈরী করেছিল। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, চলমান পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় যে দুষ্টচক্র সক্রিয় ভূমিকা রাখছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল ও তার সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা। ১৯৮৯ সালে ইরান বিপ্লবের অবব্যহিত পরেই ইমাম খামেনি জায়নবাদীদের করাল গ্রাস থেকে আল কুদস তথা জেরুজালেমের মুক্তির প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফোরের ঘোষণার ৩০ বছর পর ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা সমরাস্ত্রে সজ্জিত জায়নবাদী হাঘানা মিলিশিয়ারা অস্ত্রের মুখে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের আবাসভূমি দখল করার সাথে সাথে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসের নিয়ন্ত্রণও নিজেদের করায়ত্ব করে নেয়। এর ৩০ বছর পর ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতারাই প্রথম জায়নবাদীদের হাত থেকে জেরুজালেমের মুক্তির প্রত্যয়কে আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইমাম খামেনিই প্রথম রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস ঘোষণা করে সারাবিশ্বে জনমত গঠনে উদ্যোগী হন। আইআরজিসির অন্যতম এলিট ফোর্স আল কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানির হাত ধরে জেরুজালেমের মুক্তির নতুন সম্ভাবনার বীজ মহীরূহ আকারে ক্রমশ; পত্রপল্লবে বিস্তার লাভ করতে থাকে। আল কুদস ব্রিগেডের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানির ইসলামিক চেতনা, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি সমরবিদ্যার গতানুগতিক পরিসীমা ডিঙ্গিয়ে নতুন এক মাইল ফলকে উন্নীত হয়। জায়নবাদী শত্রু তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের কাছে বহু বছর ধরে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম জেনারেল কাসেম সুলাইমানি। সেই ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর থেকেই কাসেম সুলাইমানি মোসাদের হিটলিস্টের অন্যতম টার্গেট ছিলেন। ইসলামোফোবিক এজেন্ডায় পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধের তুর্যবাদক হিসেবেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। মার্কিন ও যায়নবাদীদের রক্তচক্ষু তাঁকে এক মুহূর্তের জন্য বিচলিত করতে পারেনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা অনেক আগেই জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে ‘জীবন্ত শহীদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিপ্লবোত্তর ইরানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন।

গত দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের মানচিত্র বদলের এজেন্ডা কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন বাস্তবতায় উন্নীত হয়। এর কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীল রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে ইরানের উত্থান ও মুসলিম উম্মাহকে ঘিরে দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধোত্তর পশ্চিমা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্র্যজ্যবাদের নতুন বিশ্বব্যবস্থার অশুভ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার মূল কারিগর জেনারেল কাসেম সুলাইমানি। পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বশংবদ আঞ্চলিক শক্তির সম্মিলিত প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অবিশ্বাস্য বিজয়, ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর পরাজয়, সিরিয়া- ইয়েমেনে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক প্রক্সি বাহিনীর পরাজয়, বিপুল শক্তি ও পরিকল্পনা নিয়ে দায়েশ বা আইএস-এর ভয়ঙ্কর অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধের ফাঁদ ব্যর্থ করে দেয়ার মূল কৃতিত্বও জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকেই দিতে হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বকে অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন করে তোলা ছাড়া পশ্চিমারা জায়নবাদী ইসরাইলের নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি খুঁজে পায়না। ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি বাগদাদ বিমানবন্দরে আততায়ী ড্রোন হামলায় আল কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সুলাইমানি ও ইরাকের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের কমান্ডার আবু মাহদি আল মোহানদিসকে হত্যার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ বাহিনীগুলোর পুরো দৃশ্যপট আমূল বদলে যেতে শুরু করে। ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তে মার্কিন সেনাঘাটিগুলোর অস্তিত্ব বিলীয়মান হয়ে পড়ে। মুসলিম উম্মাহ এবং জেরুজালেমের মুক্তির অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ সেনানায়ক কাসেম সুলাইমানি শহীদ হওয়ার পর তার সুযোগ্য হাতে গড়া মুজাহিদিন বাহিনীগুলোর মধ্যে শহীদি তামান্না মূর্ত হয়ে ওঠে। কাসেম সুলাইমানির শহীদ হওয়ার চারবছর পূর্ণ হওয়ার আগে গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রক রাজনৈতিক সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা আল কাস্সাম ব্রিগেডের ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ জায়নবাদী ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা সহযোগীদের সব দম্ভচূর্ণ করে দিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির বার্তাকে নতুন সম্ভাবনার দিগন্তে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। শত বছরের যুদ্ধের ইতিহাসে সবেচেয়ে ভারসাম্যহীন বোমা হামলায় বাইশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি শিশু নারী ও নিরস্ত্র যুবকদের হত্যা করেও আল কাসাম ব্রিগেডের যোদ্ধাদের এতটুকু দমাতে পারেনি নৃশংস ইসরাইলী বাহিনী। তারা ক্রমশ একটি করুণ পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয়ে চলেছে। ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হেজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, সিরিয়া ও ইরাকের মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর নির্ভীক যোদ্ধাদের আক্রমন প্রতিহত করার কোনো উপায়ই এখন ইসরাইল ও তার পশ্চিমা যুদ্ধবাজ পৃষ্ঠপোষকদের হাতে নেই। পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিম বিদ্বেষী একচক্ষু নীতির আওতায় আশি বছর ধরে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর যে নিপীড়ন-নিবর্তনের স্টীমরোলার চালানো হচ্ছিল, দিনকে দিন তার ব্যাপ্তি ও নৃশংসতা বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে গাজা উপত্যকায় হামাসের জনসমর্থন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গত দেড় যুগ ধরে গাজার উপর জল, স্থল ও আকাশপথে সর্বাত্মক অবরোধ কায়েম করে কার্যত গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগারে পরিনত করেছে ইসরাইল। ৭ই অক্টোবর শুরু হওয়া অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড সেই সব আগ্রাসন-নিপীড়নের প্রত্যাঘাত মাত্র। জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করে আল কুদস মুক্তির জিহাদকে দুর্বল করা যায়নি, বরং তা আরো তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। গাজায় দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন ও আরব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্ত প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাত শুরুর ৭৮ দিনের মাথায় সিরিয়ায় ইসরাইলী বিমান হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড কমান্ডের আল কুদস ফোর্সের সিনিয়র সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইয়েদ রাযি মুসাভি শহীদ হন।

মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে জায়নবাদী ষড়যন্ত্র ও পশ্চিমা যুদ্ধবাদী পরিকল্পনায় গতানুগতিক হার্ডপাওয়ারকে ব্যর্থ করে দিতে কাসেম সুলাইমানি ছিলেন ইরানের সুপার সফ্ট পাওয়ারের অন্যতম অনুঘটক। ইরান পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠার পাল্টা পরিকল্পনা হিসেবে প্রথমেই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশে পরিনত করার মধ্য দিয়ে ইসরাইলকে কুদস ফোর্স, হামাস, হেজবুল্লাহ ও হুথি বাহিনীর সম্মুখে অনেকটা অসহায়, নাস্তানাবুদ অবস্থার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়ার অভ্রান্ত পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেনারেল কাসেম সুলাইমানি। দুনিয়ার সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য বাহিনী হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত ইসরাইলী সামরিক বাহিনী গত দুই দশকে অন্তত তিনবার গাজা ও লেবাননে স্থল হামলা চালিয়ে পরাজিত হয়ে সবকিছু ফেলে ফিরে যাওয়ার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, ইতিপূর্বে সম্মিলিত আরব বাহিনীর পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। প্রক্সি বাহিনী দিয়ে দায়েশ নির্মূলসহ সাম্প্রতিক যুদ্ধ কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অজেয় শক্তি হয়ে ওঠার বাস্তবতার আলোকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকে জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে বিশ্বের এক নম্বর জেনারেল হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং দৃঢ় ইমানি চেতনায় ঋদ্ধ মনোবল ও নিখুঁত পরিকল্পনার কাছে ন্যাটোসহ পশ্চিমাদের শত শত বিলিয়ন ডলারের সম্মিলিত সমরসজ্জা বার বার পরাভুত হয়েছে। জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার পর তাঁর হাতে গড়া প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর চেতনায় কাসেম সুলাইমানির ত্যাগ ও চেতনার আলোক রশ্মির প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় তিনমাস ধরে গাজার শিশু ও নারীদের উপর ইতিহাসের নজিরবিহিন গণহত্যা চালিয়েও হামাসকে নির্মূল করা দূরের কথা সামরিক-বেসামরিক, রাজনৈতিক কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনি ইসরাইল। হামাসের বেঁধে দেয়া সব শর্ত মেনেই আরেকটি যুদ্ধ বিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলের আয়রন ডোম, মারকাভা ট্যাঙ্ক ও বাঙ্কারবাস্টার বোমার চেয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ইমানি চেতনা এবং শহীদি মনোভাব অনেক বেশি শক্তিশালী। কাসেম সুলাইমানি শুধু প্রতিরোধ বাহিনীর গাইড লাইনই দেননি, নিজের উন্নত চিন্তা, ইমানি জজবা এবং অকুতোভয় সংগ্রামী চেতনাকে তার নির্দেশিত প্রতিটি বাহিনীর যোদ্ধাদের মধ্যে উজ্জীবিত করতেও সক্ষম হয়েছেন। এখানেই বিশ্বের অন্য সব সামরিক কমান্ডারদের সাথে জেনারেল কাসেম সুলাইমানির বড় পার্থক্য টেনে দেয়।

জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে অনেকে সপ্তম শতকের সাহাবি মুসলিম বীর শহীদ মালিক আল আশতারের সাথে তুলনা করেছেন। দুই যামানার দুই বীর শহীদ প্রতিপক্ষ প্রবল শক্তির দ্বারা গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। সিফফিনের যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, বিজয়ের মহানায়ক মালিক আশতারকে মিশরের গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন খলিফা হজরত আলী ইবনে আবু তালিব। মিশরে পৌছার সাথে সাথেই মুয়াবিয়ার নিয়োজিত গুপ্তঘাতক মালিক আশতারের ভক্ত সেজে তাকে আপ্যায়নের ফাঁকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। চৌদ্দশ’ বছর পেরিয়ে এসে আজো মুসলিম বীর সেনানিরা শত্রুপক্ষের আততায়ীর হাতে শহীদ হচ্ছেন। শহীদের এই কাফেলা অনেক দীর্ঘ এবং ক্রমবর্ধমান। মালিক আশতার নিহত হওয়ার প্রায় ৫শ’ বছর পর সম্মিলিত ক্রুসেডারদের সাথে চলমান যুদ্ধে সবচেয়ে গৌরবজনক বিজয় এনে দিতে যে বিজয়ী বীরের কৃতিত্ব সবচেয়ে দ্যুতিময় হয়ে আছে তাঁর নাম সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। ১১৮৭ সালে হিত্তিনের যুদ্ধে খৃষ্টানদের কাছ থেকে সুলতান সালাউদ্দিনের জেরুজালেম বিজয়ের মধ্য দিয়েই মূলত ক্রুসেডে খ্রষ্টানদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় ক্রুসেডে মুসলমানদের বিজয়ের পর ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সিরিয়ার দামেস্কে অসুস্থ হয়ে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মৃত্যুবরণ করার আগে বহুবার আশাশিন গুপ্তঘাতকদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। জেরুজালেমের উপর ইহুদি ও জায়নবাদী দখলদারিত্বের অবসানে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে জেনারেল কাসেম সুলাইমানির নাম অনাদিকাল ধরে উচ্চারিত হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে পশ্চিমা নীলনকশা বাস্তবায়নের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের অপতৎপরতাগুলো ব্যর্থ হয়ে গেলেও তাদের অপপ্রয়াস এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যায়নি। আলকুদস ব্রিগেডের কর্মকান্ড ইরানের সীমান্ত থেকে হাজার মাইল দূর পর্যন্ত ইসরাইল ও মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোকে ঘিরে একটি আঞ্চলিক বৃত্তে পরিব্যাপ্ত করার মধ্য দিয়ে জেনারেল কাসেম সুলাইমানি যে প্রজ্ঞা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন, সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের তা বিরল দৃষ্টান্ত। পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যের পুরনো হিসেব পাল্টে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী ও তার সহযোগী বাহিনীগুলো। সন্ত্রাস দমনের নামে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের যুদ্ধবাণিজ্য ও সা¤্রাজ্যবাদী মহাসন্ত্রাসের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার পর দখলদার জায়নবাদী ইসরাইলের অনিবার্য পতন ঠেকাতে গাজায় নজিরবিহিন শিশু হত্যা, গণহত্যা ও বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞে সরাসরি মদত দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা। প্রতিরোধ যোদ্ধারা জেনারেল কাসেম সুলাইমানির দেখানো পথে অসম সাহসিকতায় জায়নবাদী ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব অপপ্রয়াস ও দম্ভূর্ণ করে দিয়ে এক অনিবার্য বিজয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

চলমান বিশ্ববাস্তবতায় যুদ্ধ ছাড়া শান্তির নিশ্চয়তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। আড়াই হাজার বছর আগে চীনা সমরবিদ সান জু যুদ্ধের সময় শান্তি এবং শান্তির সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন। প্রথম গাল্ফ ওয়ার থেকে পরববর্তী প্রতিটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে সান জু’র যুদ্ধনীতি ও সমরকৌশল প্রাসঙ্গিক হিসেবে আলোচিত হতে দেখা গেছে। সান জু’র আর্ট অব ওয়ার বইতে তিনি একটি সফল যুদ্ধ পরিকল্পনার যে মৌলিক নীতি কৌশলের কথা বলেছেন, তার সবগুলোই আল কুদস ফোর্স ও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে। সেখানে কমান্ডার ও সৈনিকের মোরাল বা নৈতিক অবস্থানকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানেই জায়নবাদী দখলদার শক্তি ও মুক্তিকামী ইমানদার যোদ্ধাদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। বেপরোয়া বোমা হামলায় হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে, ফসফরাস বোমায় বহুতল ভবনগুলোকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে মারকাভা ট্যাঙ্ক ও বুলডোজার নিয়ে অবরুদ্ধ গাজায় স্থল অভিযানকে হাতে তৈরী ইয়াসিন ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে মুজাহিদদের জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে, আইডিএফ সদস্যরা দখলদারিত্ব কায়েম করতে এসে প্রাণ নিয়ে পালাতে মরিয়া হয়ে পড়ছে। মৃত্যুর ফায়সালা শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে, আর দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য শহীদের পুরষ্কার সম্পর্কে কোনো ইমানদার মুসলমানের বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। পরম সত্তার প্রতি অটল বিশ্বাস ও পারলৌকিক পুরষ্কারের প্রত্যাশা ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের বীর মুজাহিদদের এক অসীম উচ্চতায় সমাসীন করেছে। পশ্চিমা সমরশক্তি ও গতানুগতিক যুদ্ধ কৌশলকে ব্যর্থ করে দিতে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বিশ্বের এক নম্বর জেনারেল ও সমরবিদ কাসেম সুলাইমানির মধ্যে যে অসামান্য দূরদৃষ্টি, উচ্চতর মনুষ্যত্ববোধ, আধ্যাত্মিক চেতনা ও নিরলস কর্মবীরের গুণাবলীর সন্নিবেশ ঘটেছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যের জায়নবাদ বিরোধী প্রতিটি মুক্তিকামী সৈনিকের মধ্যে পরশ পাথরের মত প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। আগামী দিনের ইতিহাসে মালিক আল আশতার, ক্রুসেড বিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, ল্যাটিন আমেরিকায় দ্য লিবারেটর নামে খ্যাত অষ্টাদশ শতকের স্পেনিশ উপনিবেশ বিরোধী যুদ্ধের বীর সেনাপতি সাইমন বলিভার ও বিংশ শতকের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী যোদ্ধা চে’গেভারার পাশাপাশি শহীদ কাসেম সুলাইমানির নামও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো