ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ফেলানী হত্যার বিচার কবে হবে?

Daily Inqilab এম. কে. দোলন বিশ্বাস

০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম

৭ জানুয়ারি, কিশোরী ফেলানী খাতুন হত্যা দিবস। ২০১১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারায় ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুন। জানা যায়, সেদিন ছিল শুক্রবার, ভোর সোয়া ৬টার দিকে ভারত থেকে বাড়ি ফেরার পথে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে মই বেয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানী খাতুনের। এসময় বিএসএফের ছোঁড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আধা ঘণ্টা ধরে ছটফট করে মৃত্যু হয় ফেলানীর। সকাল পৌনে ৭টা থেকে নিথর দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে, দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলন্ত ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশের ছবি দেশ-বিদেশের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। বিএসএফ লাশ নামিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে গেলে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। এরপর মৃত্যুর ৩০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারি শনিবার পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ।

বাংলাদেশে আরও এক দফা ময়না তদন্ত শেষে ৭৩ ঘণ্টা পর ফেলানীর লাশ দাফন করা হয়। এ হত্যাকা-ে বিএসএফ সদস্য অমীয় ঘোষকে প্রধান অভিযুক্ত করে কুচবিহারের দিনহাটা পুলিশ স্টেশনে একটি হত্যা মামলা হয়। অমীয় ঘোষের বিরুদ্ধে ভারতীয় দ-বিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুন এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

ফেলানীর বাবা নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম নুরু ওই ঘটনার ১০ বছর আগে থেকে ভারতের দিল্লিতে কাজ করতেন। বাবা নূরুর সঙ্গে সেখানেই থাকত ফেলানী। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় ফেলানীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথে সীমান্ত পার হওয়ার সময় ওই নির্মম ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন কুড়িগ্রামে গিয়ে বিএসএফ কর্তৃক আটককৃত ফেলানীর মা ও ভাই-বোনদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি নিশ্চছিদ্র নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তায় সারাদিন লুকোচুরি খেলা শেষে বিকেলে তাদের দেশে ফেরত দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

ফেলানী হত্যার পর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যাপক সমালোচনা করে। খোদ ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও সোচ্চার হতে দেখা যায়। অবশেষে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহার জেলা সদরের সোনারী এলাকায় অবস্থিত ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরে স্থাপিত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু করে ভারত সরকার। ১৯ আগস্ট আদালতে সাক্ষী দেন প্রত্যক্ষদর্শী ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও মামা আব্দুল হানিফ। ওই হত্যাকা-ের পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চাপের মুখে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হলেও একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিযুক্ত বিএসএফের হাবিলদার অমীয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। এতে পাঁচজন বিচারক বিচার প্রক্রিয়া চালান আর কোর্ট পরিচালনা করেন বিএসএফের গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি কমিউনিকেশনস সিপি ত্রিবেদী।

ন্যায়বিচার না পেয়ে ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে ভারত সরকারের নিকট পুনর্বিচারের আবেদন করেন ফেলানীর বাবা। অমীয় ঘোষকে রায়ে নির্দোষ ঘোষণা করায় সংক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার নেতারা।

রায়ের পরের দিন ৭ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে ফেলানী হত্যার রায়কে বিচারের প্রথম ধাপ হিসেবে আখ্যা দেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন। হাইকমিশনের পক্ষে বিবৃতি প্রদানকারী মুখপাত্র জানান, বিএসএফ আদালতে যে বিচার হয়েছে সেটা ছিল বিচার প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ। আইনের যথাযথ প্রক্রিয়ায় এখানে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ন্যায়বিচারে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দেয়া হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন মুখপাত্র। (তথ্য সূত্র : সংবাদ, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩)।

ন্যায় বিচারের আশায় কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে রায়ের ৬ দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় ফেলানী হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে আবেদন পাঠান ফেলানীর বাবা। এরপর ফেলানীর মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে ভারতের সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেন নুর ইসলাম ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। এছাড়া ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালতে একটি ফৌজদারি রিট পিটিশন দাখিল করা হয় ফেলানীর পরিবারের পক্ষে। ওই আাদালতের বিচারপতি এইচ এল দাত্তু ও বিচারপতি মদন লোকুরের বে পিটিশনটি গ্রহণ করে ভারত সরকার ও বিএসএফের কাছে জবাব চায়। আন্তর্জাতিক কিছু আইনের উল্লেখ করে ওই রিট আবেদনে বলা হয়, বিএসএফ অন্যায়ভাবে ফেলানীকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। বিএসএফের যে সদস্যের গুলিতে মারা গিয়েছিল ফেলানী, সেই অমীয় ঘোষের বিরুদ্ধে তদন্তের কথাও উল্লেখ করা হয়। ওই সময় ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্তা মিজ ভাট জানান, ‘কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তাকে সতর্ক করতে হবে। একটা প্রোটোকল মেনে চলতে হবে। আর ফেলানী তো একজন নিরস্ত্র কিশোরী, গুলি করার কোনো কারণই থাকতে পারে না। সেকারণেই ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি চালনাসহ বেশ কিছু অন্যায় কাজের জন্য বিএসএফকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (তথ্য সূত্র : নয়াদিগন্ত, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩)।

ফেলানী হত্যাকা-ের বিচার প্রত্যাশিত না হওয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ববাসীও ওই রায় মেনে নেয়নি। শুরু হয় কূটনৈতিক ও বৈদেশিক তৎপরতা। ফলে দেশি-বিদেশি চাপে ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম রিভিউ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। অবশেষে ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার বিএসএফের উচ্চ আদালতে হত্যাকা-টির পুনর্বিচারের ঘোষণা দেন। প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে বিজিবি-বিএসএফের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ফেলানী হত্যার পুনর্বিচারে রাজি হয় বিএসএফ। (তথ্য সূত্র : নয়াদিগন্ত, ৭ জানুয়ারি ২০১৪)।

দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে পাঁচ দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফের প্রধান দেবেন্দ্র কুমার পাঠক ফেলানীর হত্যার ঘটনায় দ্রুত সুবিচার নিশ্চিত করা হবে বলে বিজিবিকে আশ্বস্ত করে জানায়, ‘ফেলানী হত্যা মামলায় ভারতের দিকের সাক্ষীদের আবার নতুন করে জেরা শুরু হয়েছে। এখন বাংলাদেশের দিকের সাক্ষীদেরও আবার শুনানিতে ডাকার প্রস্তুতি চলছে। অভিযুক্ত বিএসএফ জওয়ানকে বেকসুর খালাস দিয়ে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ আদালত যে রায় দিয়েছিল, বিএসএফের তৎকালীন প্রধান ওই রায়ের সঙ্গে একমত হতে না পেরে পুনর্বিচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।’ এরপর প্রায় বছর ঘুরতে চললেও সেই পুনর্বিচারের বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। তবে এবারের সম্মেলনে এ প্রসঙ্গটি ওঠার পর বিএসএফ প্রধান মামলাটি দ্রুত ন্যায্য নিষ্পত্তির আশ্বাস দেন। এ বিষয়ে বিজিবির তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, ‘ওই আশ্বাসে আপাতত সন্তুষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত কী সুবিচার পাওয়া যায়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকবে বাংলাদেশ।’ (তথ্য সূত্র : কালেরকণ্ঠ, ২৫ আগস্ট ২০১৪)। এখনো বাংলাদেশের অপেক্ষার রজনী শেষ হয়নি। ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার এখনো হয়নি। আদৌ হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।

লেখক: দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

দুইবার এগিয়ে গিয়েও জেতা হলো না মায়ামির

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো