অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে
২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। নানা সংকটে ক্রমেই তা সংকুচিত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে যে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছে, তা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে গাজায় ইসরাইলের হামলার জেরে লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণে জাহাজ চলাচল বিঘ্ন ঘটায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ব্যহত হচ্ছে, যা অর্থনীতিকে আরও সংকোচনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বৈশ্বিক এবং আভ্যন্তরীণ নানা সংকটে দেশে এখন অবিশ্বাস্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। একইসঙ্গে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদিতে মানুষ দিশেহারা। ব্যাংকে তারল্য সংকট, সরকারের ধার করে চলা, রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, ডলার এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের তীব্র সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও হ্রাস পাওয়ায় পুরো অর্থনীতি এখন গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও সংকটের কথা স্বীকার করে বলেছেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যহত হওয়া নিয়ে এখন দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুত সংকটের কারণে তারা স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারছে না। সারাদেশে এখন তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। উৎপাদন খাতসহ আবাসিক খাত গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবার ডলার সংকটের কারণে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার চাহিদা মতো গ্যাস আমদানি করতে পারছে না। গ্যাস আমদানি করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও চাহিদা অনুযায়ী করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশ আমদানি নির্ভর হওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলারই একমাত্র ভরসা। দীর্ঘদিন ধরেই এই ডলার সংকট চলছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বেঁধে দিলেও তা চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দাম দিয়েও অনেক সময় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে দাম বেশি হওয়ায় আমদানি-রফতানি ব্যহত হওয়াসহ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে সরকারও গ্যাস ও জ্বালানি তেল আমদানি সংকটে পড়েছে। সম্প্রতি ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানসংস্থা ইতিহাদ বাংলাদেশে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে ডলার যোগানের মূল উৎস রফতানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বিনিয়োগ। এই তিন খাত থেকেই আশঙ্কাজনকভাবে ডলার আসা কমে গেছে। দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প থেকে যে পরিমাণ ডলার আসার কথা তা হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ, পোশাক রফতানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নে দিন দিন রফতানি কমছে। দেশগুলোতে অর্ডার যেমন কমছে, তেমনি অর্ডার দিয়ে বাতিলের ঘটনাও ঘটছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক কারণসহ চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার সংকট, লোহিত সাগরের পানিপথে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করায় পোশাক পণ্যবাহী জাহাজকে বহু ঘুরপথে সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগা ও ব্যয় বৃদ্ধিকে দায়ী করছে। এতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা লাভের পরিবর্তে লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। এর সাথে দেশে তীব্র গ্যাস সংকট এ খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, বেশ কয়েক মাস ধরেই শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকট চলছে। সরবরাহ না থাকায় দিনের পর দিন বিভিন্ন কারখানা বন্ধ থাকছে। উৎপাদনে ধস নেমেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিল্পোৎপাদন গভীর সংকটে পড়বে। তিনি বলেছেন, শিল্পকারখানা বন্ধ হলে কিংবা বেতন দিতে না পারলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে। গ্যাস সংকট নিরসনে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তার এ উদ্বেগ ও আশঙ্কা অমূলক নয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা এখন দৃশ্যমান। সরকারের হাতেও টাকা নেই। ব্যাংক থেকে প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ হাজারের বেশি টাকা ধার করে সরকারকে চলতে হচ্ছে এবং দেনার হারও বাড়ছে। যেখানে সরকারকেই দুরবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষ কতটা দৈন্যদশার মধ্যে রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং আয়ের সাথে ব্যয় সংকুলান করতে না পারায় ইতোমধ্যে অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। সঞ্চয় দূরে থাক, তাদের এখন দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধসে যাচ্ছে। তারা দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে। অন্যদিকে, ডলারের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স। এ খাতেও ভাটা দেখা দিয়েছে। দেশের প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ বিদেশে থাকলেও যে হারে দেশে তাদের টাকা পাঠানোর কথা তা পাঠাচ্ছে না। বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ডলার আসার কথা থাকলেও তা খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারছে না। একেক সময় একেক নীতি নিতে হচ্ছে। ব্যাংক যে নতুন মুদ্রানীতি নিয়েছে, তা অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে না বলে ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্থিতি উত্তরণের পথ সরকারকেই বের করতে হবে। সরকারের এখন শুধু আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার দিকে বেশি মনোযোগ দিলে হবে না, পুরো মনোযোগ অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের দিকে দিতে হবে। অর্থনৈতিক এই গভীর সংকটের বহুবিধ কারণের সাথে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুক্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঐকমত্য সৃষ্টির বিকল্প নেই। সরকার সেটা কিভাবে করবে, তা তাকেই ভাবতে হবে। সালমান এফ রহমান এ সংকট মোকাবেলায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, সরকারকে সে পথে যেতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের মতো প্রতিবেশি দেশগুলো এতটা অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে নেই। বছর দুয়েক আগে যে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল, সে এক বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের কাছ থেকে নেয়া ঋণও পরিশোধ করেছে। দেশটি কিভাবে পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতি এখন সবদিক থেকে ‘বর্ডার লাইনে’ রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি এমন যেকোনো সময় তা খাদে পড়ে যেতে পারে। তার আলামত এখন দৃশ্যমান। এটা প্রতীয়মান হচ্ছে, সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেয়া সরকারের একার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণে সরকারকে অন্যান্য স্ট্যাকহোল্ডারকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করে জরুরিভিত্তিতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে