মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘের শোচনীয় ব্যর্থতা
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত অধিকাংশ গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ইতিহাস অবৈধ মারণাস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান হওয়া একদল দুস্কৃতিকারী ও বিপথগামী পাশবিক দম্ভÑঅহংকারীর অস্ত্রাঘাত ও রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। কোনও একটা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নামে শুরু হওয়া এসব সংগ্রামে কেউই রেহাই পাচ্ছে না।
অবৈধ মারণাস্ত্র আজ শান্তিপ্রিয় সমাজের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক মারণাস্ত্রের মজুতকরণের খবর অঞ্চল বিশেষকে করে তুলেছে স্পর্শকাতর। কেননা, আধুনিক মারণাস্ত্রের রমরমা সংঘাতপূর্ণ একটি জনবসতি প্রধান অঞ্চলে বা একটা বহুধা বিভক্ত জাতি-জনগোষ্ঠীর এলাকায় অভিশাপ ডেকে আনতে পারে। শান্তিÑসম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ একটি সমাজকে মুহূর্তে বিধ্বস্ত করে দিতে পারে। সুতরাং অবৈধ মারণাস্ত্রকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
আধুনিক মারণাস্ত্রের যুগে এখন পর্যন্ত যতগুলো ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে, এর মূলে কিন্তু অবৈধ অস্ত্রশক্তি। উল্লেখ্য, বিশ্বের বড় সংঘর্ষসমূহ সংঘটিত হচ্ছে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়। বিশ্বের অস্ত্র রফতানিকারী এবং ধনী রাষ্ট্রগুলো গরিব দেশগুলোতে তাদের অস্ত্রের বাজার তৈরি করছে। বৈধÑঅবৈধ, দুই প্রকারের অস্ত্র বিক্রির জন্য এ রাষ্ট্রসমূহকে লক্ষ্য করে ফেলা হচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র সহজলভ্যতায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এভাবে দ্বিতীয় পক্ষের শক্তি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে। স্বাধীনতাকামী, বিচ্ছিনতাবাদী, সন্ত্রাসÑ এদের মূল চালিকাশক্তি অবৈধ মারণান্ত্র।
মারণাস্ত্রের সুপ্রয়োগ হওয়ার কোনও নজির নেই। মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগের ফলে কীভাবে ব্যাপক গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সূত্রপাত হতে পারে ও সামাজিক শান্তি বিঘিœত হতে পারে, তার বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এর ফলে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তা উল্লেখ না করাটা অনুচিত হবে। সংঘর্ষপীড়িত এলাকায় প্রায়ই আমরা মানবতার করুণ চিত্র প্রত্যক্ষ করছি। নিরীহ লোক কীভাবে আশ্রয় শিবিরে শরাণার্থীর জীবন-যাপন করে তা আমরা দেখেছি। এর প্রধান ও সাক্ষাৎ উদাহরণ ইসরাইলের নির্যাতনে কীভাবে ফিলিস্তিনিরা যুগ যুগ ধরে উদবাস্তুর মত দিন কাটাচ্ছে। রোহিঙ্গারা কীভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে। নরক সদৃশ সে জীবন। অথচ এসব হত্যাকান্ডে বা নির্যাতনে বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এসব দেশে যে অত্যাচার নির্যাতন, ঘরবাড়ি, ধর্মীয়স্থান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা হচ্ছে তাতে কি বিশ্ব বিবেক নাড়া দেবে দিবেনা- এ প্রশ্ন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সকল মানুষেরই।
মানবসৃষ্ট কারণে মানুষের এই দুর্ভোগ অত্যন্ত পীড়াদায়ক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অস্ত্র সংঘাতের লাখ লাখ লোককে আশ্রয় শিবিরে শরাণার্থীর জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, বিশ্বের ধনী ও মারণাস্ত্র রফতানিকারী দেশসমূহের তুলনায় গরিব এবং অস্ত্র আমদানিকারী দেশসমূহে অস্ত্র সংঘাতের ফলে মৃত্যু হওয়া লোকের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। মানুষের দ্বারা সংঘটিত দুর্যোগে মা ও শিশু মৃত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক। দৃষ্টান্তস্বরূপ, প্রতি ৫ কোটি জনসংখ্যায় এরকম সংঘর্ষের ফলে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা আমেরিকায় মাত্র ১৫টি। বিপরীতে আফগানিস্তানে ১৮৩৫টি ও পাকিস্তানের ৬৬৪টি। সেভাবে গর্ভবতী অবস্থায় মার মৃত্যু সংখ্যা আমেরিকায় ৯১টি। আগের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, ১৯৯৬-২০০৬ সময়কালে বৈধ, অবৈধ মারণাস্ত্র সংঘাতের ফলে প্রায় ৩ কোটি শিশুর মৃত্যু হয়, ৭ কোটি আহত হয় এবং অসংখ্য শিশু এমন নিষ্ঠুর সংঘাতের সাক্ষী হয়।
বিশ্বের সর্বাধিক মারণাস্ত্র রফতানিকারী দেশসমূহের মধ্যে আছে ক্রমে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন এবং চীন। অন্যদিকে সর্বাধিক অস্ত্র আমদানিকারী গরিব দেশসমূহের ভেতর আছে সিয়েরালিওন, অ্যাঙ্গোলা, সোমালিয়া, কঙ্গো, ইথোপিওয়া, রুয়ান্ডা, পাকিস্তান, ভারত, উগান্ডা, সৌদিআরব।
সম্প্রতি অস্ত্র রফতানিকারী দেশসমূহ ক্ষুদ্র আকার এবং হালকা মরণাস্ত্র উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ক্ষুদ্র আকৃতির অস্ত্রের বাজারটি সহজে বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত করা যায়। নির্মাণ ব্যয়ও তুলনামুলকভাবে কম। সন্ত্রাসবাদীদেরও এর ফলে সুবিধা হয়েছে।
বিশ্বের গরিব দেশসমূহে মারণাস্ত্র রফতানিকারী দেশগুলো তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া রাষ্ট্রগুলোতে সংঘাত প্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিচ্ছে এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এরা বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক তথা কূটনৈতিক কারণেও প্রয়োজন সাপেক্ষে মারণাস্ত্রকে ‘অনুদান’ হিসেবে তুলে দেয়। এমন উদাহরণ আছে। ১৯৭৫-২০১৫ সময়কালে পৃথিবীর ভিতরে সবেচেয়ে বেশি মারণাস্ত্র আমদানিকারীর লেনদেনের বিষয়টি ‘মুক্ত গোপনীয়’ রূপে ধরা হতো। এই সময়ে আমেরিকা সন্ত্রাস কবলিত পাকিস্তানে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের মারণাস্ত্র মুক্ত হস্তে দান করেছিল। এভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধনী দেশগুলো মারণাস্ত্র বিস্তারের সঙ্গে জড়িত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত বৃহৎ সংঘর্ষগুলোর মধ্যে ৮৫ শতাংশই গরিব দেশগুলোয় রয়েছে। মানুষের সৃষ্ট অস্ত্র সংঘাতের দুর্যোগ আফগানিস্তানে ২৬ বছর ধরে, অ্যাঙ্গোলায়া ৪০ বছর এবং সোমালিয়ায় প্রায় ১৬ বছর ধরে চলেছে। এছাড়া বর্তমানে মধ্যপাচ্যে এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে বেশি।
অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক পুলিশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক কাজে জড়িত অপরাধী চক্রকে উৎখাত করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আটক করার পাশাপাশি তাদের কারখানাগুলো বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অবৈধ তথা চোরাই ব্যবসাকে সমর্থন যোগানো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি তথা কোম্পানিগুলোকে এই অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে নিতে হবে।
জাতিসংঘের গৃহীতব্য পদক্ষেপের অংশ হবে আন্তর্জাতিক আইনগুলোকে অধিক শক্তিশালী করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করা এবং আন্তর্জাতিক আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। আমরা নিশ্চিয়ই আশা করবো সংঘাতমুক্ত, শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ হোক অস্ত্র রফতানিকারী দেশগুলো অনুভব করুক, গরিব রাষ্ট্রসমূহের সমস্যার কথা। বিশ্ব মানবতার মর্যাদা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে কিন্তু জাতিসংঘকেই।
এটা পরিতাপের বিষয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত বা উৎপাদিত মারাত্মক ধরনের অস্ত্র আজ ইসরাইল কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে। মানব কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ আজ কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার
আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়
হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড ইংল্যান্ড
পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল