ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

ভারতের বিপুল অর্জনের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে কিছু নেই

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে তার সব স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে, তা এতদিন জোরেসোরে উচ্চারিত না হলেও, এখন ভারত নিজেই তা প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ থেকে তার দাবি আদায় করা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। গত ৩০ জানুয়ারি বেশ ঘটা করে ঘোষণা দিয়ে তার এ আনন্দ প্রকাশ করেছে। ওই দিন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট মুম্বাই’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে যেতে বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ভারত এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাস ও ট্রেনে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি বদলে যাবে। শুধু জয়শংকরই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি, বাংলাদেশ থেকে ‘মেগা অর্জন’ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীও আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন। তাদের দিক থেকে এ আনন্দ প্রকাশ করা স্বাভাবিক। তবে এর বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কি? এ প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

বেশ কয়েক মাস আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ যা দিয়েছে, ভারত তা আজীবন মনে রাখবে। কি কি দেয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট করে না বললেও, এখন তা বোঝা যাচ্ছে। ভারত বাংলাদেশ থেকে যা পেয়েছে, বাস্তবিকই তা সারাজীবন মনে রাখার মতো। এর কারণ হচ্ছে, ভারত যুগ যুগ ধরে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সহজে যাতায়াত করতে পারছিল না। বহু পথ ঘুরে যেতে হতো। ফলে অর্থনৈতিকভাবে রাজ্যগুলো অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে করিডোর আদায় এবং নির্বাধে সড়ক ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় রাজ্যগুলোতে কম সময়ে ও দূরত্বে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। এতে রাজ্যগুলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বলা বাহুল্য, এতদিন এই ধারণা দেয়া হয়েছিল, ভারত থেকে ট্রানজিটের মাধ্যমে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দেশগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। এখন দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিটের নামে শুধু ভারতকে করিডোর দেয়া হয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতেরই বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করা যাবে। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ পাবে নামকাওয়াস্তে মাশুল। তাও তা আন্তর্জাতিক নিয়মে ডলারে নয়, টাকায়। পর্যবেক্ষকরা এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি দেখছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের সড়কের উপর দিয়ে পণ্যবাহী ভারতীয় ভারি যানবাহন চলাচলের ফলে সড়কের যে ক্ষতি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হবে, তার পুরো ভার বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে। এ খাতে বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের পয়সা খরচ হবে। ভারতের এই অকল্পণীয় প্রাপ্তির বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিগুলোর অন্যতম অভিন্ন নদনদীর পানির সমবন্টন। এর মধ্যে তিস্তা চুক্তি একটি। এই চুক্তিটি নানা টালবাহানায় ভারত বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। শুকনো মৌসুমে ভারত পানি আটকে রেখে পুরো তিস্তা অঞ্চলকে শুকিয়ে মারছে, বর্ষায় গজলডোবা বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ফেনী নদী থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের মরণবাঁধ হয়ে থাকা ফারাক্কাকে ব্যবহার করে ভারত পদ্মা নদীকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মায় এখন ধু ধু বালুচর জেগে উঠেছে। ভারতের এই বৈরি পানিনীতির বিপরীতে বাংলাদেশ যে বিকল্প ব্যবস্থা নেবে, সেক্ষেত্রেও ভারত বাধা দিচ্ছে। প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েও ভারতের আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে রয়েছে। তিস্তায় চীনের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প চূড়ান্ত হলেও তা বাস্তবায়নে ভারত বাধা দিচ্ছে। চীন ঘোষণা দিয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিস্তা মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু করবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত বাধা দেয়ায় তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু নদনদীর পানিই নয়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে রেখেছে। নানা বাধাবিপত্তি দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের চতুর্থ বৃহৎ রফতানির বাজার। আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশ ভারতের তৃতীয় বৃহৎ রেমিট্যান্স আহরণকারি দেশ। দেশটির প্রায় দশ লাখ নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠানে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত। বাণিজ্যিক বৈষম্যের পাশাপাশি ভারত সীমান্তে বিজিবি সদস্যসহ সাধারণ বাংলাদেশীদের পাখির মতো গুলি করে মারছে। দুই দেশ সরকারি পর্যায়ে সীমান্তে হত্যাকা- শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বললেও ভারত তা মানছে না। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারত বাংলাদেশকে একদিকে তার চাওয়া-পাওয়া এবং দাদাগিরির একটি বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা আদায় করা যে কঠিন হয়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, ভারত থেকে দাবি আদায়ের কোনো বার্গেইনিং বিষয় বলতে গেলে বাংলাদেশের হাতে আর কিছু নেই। অথচ সারাবিশ্বেই প্রতিবেশি দেশ পারস্পরিক স্বার্থ বিনিময়ের মাধ্যমে দাবি আদায় করে থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে প্রতিবেশি ভারতের সাথে ভারসাম্যমূলক ও ন্যায্যতাভিত্তিক কোনো স্বার্থ অর্জন করতে পারেনি বা পারছে না। বাংলাদেশের সরকার ‘অনন্য বন্দুত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক নিয়েই যেন খুশি। এক্ষেত্রে সরকারের নতজানু নীতি ও সীমাহীন ব্যর্থতার দিকটি স্পষ্ট হয়। বলা বাহুল্য, ভারতের সব চাওয়া পূরণ এবং বাংলাদেশের ন্যূনতম চাওয়া আদায় করতে না পারা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। ভারতের চাওয়া পূরণ নিয়ে তার উল্লাস এ দেশের মানুষের অন্তরকে বিদীর্ণ করেছে এবং করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই একতরফা ও অসম সম্পর্ক, এই অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনা আর কতদিন অব্যাহত থাকবে?


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল