পরিবেশের ঘাতক ইটভাটা
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম
বহু প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোদে শুকানো বা আগুনে পোড়ানো ইট ব্যবহার হয়ে আসছে। সহজলভ্যতা ও অল্প খরচের জন্য এর জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার সর্বাধিক। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক জনগণের প্রয়োজনীয় বাসস্থানের জন্য নষ্ট হচ্ছে শত শত হেক্টর কৃষি জমি, উজার করা হচ্ছে বন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২২৫ হেক্টর ভূমি এবং বছরে ৮২০০০ হেক্টর ভূমি নষ্ট হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আবাসন তৈরি ও ইটভাটার জন্য মাটি সংগ্রহ করা। বর্তমান আধুনিক বিশে^ এই বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণে কংক্রিট, অ্যালুমিনিয়াম শিট, প্লাস্টিক, কাঁচ ফাইবার, স্টিল এবং ধাতব বস্তুর ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাংলাদেশসহ বহু স্বল্পোন্নত দেশে প্রধানু ব্যবহার হচ্ছে ইট।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা সাড়ে ৮ হাজারেরও বেশি। অধিকাংশ ইটভাটাই মানছে না কোনো নিয়ম, প্রতিনিয়তই নষ্ট করে যাচ্ছে পরিবেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান: মাটি, বায়ু, কাঠ এবং ওজনস্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ৪২ হাজার হেক্টর হিসাবে গত ২০ বছরে অন্তত ৮ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বনভূমি হারিয়েছে দেশ। অতিরিক্ত কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত হচ্ছে ধূলিকনা, পার্টিকুলেট কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফারের এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ যা চোখ, ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গতানুগতিক ধারার ৬,০০০ এর মতো ইট ভাটা রয়েছে, যা বছরে ৮.৭৫ মিলিয়ন টন কার্বন নির্গত করে।
দেশে গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদনের সর্ববৃহৎ উৎস হলো ইটভাটা। ইটভাটায় প্রতিবছর কয়লার ব্যবহার ৪.৭৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন; কাঠের ব্যবহার ১.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন; মাটির ব্যবহার ২৮৪০ মিলিয়ন সিএফটি; কার্বন নিঃসরণ ১১.৫৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যার ফলাফল বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউ (নিলু)’র সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় উঠে আসে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ ভাগ। বায়ুতে ক্ষতিকারক উপাদান পিএম২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) এর অন্যতম উৎস ইটভাটা। ইন্সটিটিউট অফ হেলথ এন্ড ইভালুয়েট এবং হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউট বোস্টন এর গবেষণা অনুযায়ী পিএম২.৫ হচ্ছে ক্ষতিকর বস্তুকণা, যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের নিচে। এই ক্ষতিকর বস্তুকণা খুব সহজেই আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে চলে যায় যেটি অনেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী। গবেষকদের ধারণা মতে, এই ক্ষতিকর বস্তুকণা ঢাকার ১ লক্ষের বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
দ্যা স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট এর গবেষণা অনুযায়ী ১৯৯০ সালে ঢাকায় পিএম২.৫ এর মাত্রা ছিল ৬৫। কিন্তু ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সেটি ১০১ এ পৌঁছেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর তথ্য অনুযায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড কণা এবং কার্বন মনোক্সাইড কণা শ্বসনুন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং এটি ফুসফুস ক্যান্সার তৈরির জন্য দায়ী। এছাড়াও কার্বন ডাই-অক্সাইড অক্সিজেন গ্রহণে বাধাগ্রস্ত করে এবং কার্বন মনোক্সাইডকে নিরব ঘাতক বলা হয়। সালফারের অক্সাইডসমূহ চোখ ফুসফুসের এবং গলার সমস্যা সৃষ্টি করে। জমির উপরের স্তরের মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহার করছে। এতে পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণত মাটির পৃষ্ঠ থেকে গভীরে পুষ্টি উপাদান ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। আর ৪/৫ ফুট গভীরতায় পুষ্টির পরিমাণ খুবই অল্প। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি যেভাবে তার উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে সে হিসাবে মাটি পুড়িয়ে ইট বানানো বন্ধ না করলে ২০৪০ সালে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে। সালফার ও নাইট্রোজেন এর অক্সাইডসমূহ এসিড বৃষ্টির জন্য দায়ী। এতে ফসলের হানি ও নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। এছাড়াও ইটভাটার কারণে আশেপাশের এলাকায় পাখিসহ অন্যান্য প্রাণির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।
পোড়ামাটির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে বিকল্প নির্মাণসামগ্রী প্রয়োজন, যা হবে সার্বিকভাবে কৃষিবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগসহনীয়, টেকসই, সর্বোপরি ব্যয়সাশ্রয়ী। এর সহজ সমাধান হিসেবে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
সিমেন্ট, বালু ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ৪ মিলি পাথরের কণা বা ডাস্ট সমন্বয়ে এই ব্লক তৈরি করা হয়। ম্যানুয়েল, মেকানিক্যাল বা হাইড্রোলিক মেশিন ব্যবহার করে এ ব্লক তৈরি করা যায়। মেশিনগুলো বৈদ্যুতিক হওয়ায় বায়ুদূষণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজাইনমাফিক বিভিন্ন মান ও দামের ব্লক তৈরি করা যায়। কংক্রিট ব্লক হলো, সলিড, ইন্টারলকিং বা থার্মাল যেকোনো ধরনের হতে পারে। ব্লকের ওজন কম, ইটের তুলনায় মজবুত ফলে অধিকতর ভূমিকম্পসহনীয়। তাছাড়া প্রচলিত ইটের সমতুল্য কংক্রিট ব্লক মূল্যসাশ্রয়ী (২৫% কম)। এছাড়াও এটি অধিকতর তাপ কুপরিবাহী। ফলে গরম ও শীতে ঘর আরামদায়ক ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হয়। কার্বন নিঃসরণ প্রচলিত ইটের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ। বাড়ির নির্মাণ কাজে ইটের বিকল্প ব্যবহারে অধিক মাত্রায় বায়ু দূষণ কমে যাবে। পাশাপাশি কৃষি জমির ক্ষতির পরিমাণ কমবে এবং দেশের মোট উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হবে না।
লেখক: পরিবেশ কর্মী।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার শুভেচ্ছাদূত হলেন কারিনা
নেপালের মানচিত্রে বিতর্কিত তিন এলাকা! মুখ খুললেন জয়শংকর
আমদানির খবরে হিলিতে কমেছে পেঁয়াজের দাম
ম্যাডোনার কনসার্টে হাজির ১৬ লাখ দর্শক
আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জোতানো কিংবদন্তি কোচের চিরবিদায়
কেনিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে ২২৮
গাজায় পানিশূন্যতায় ভুগছেন দেড় লাখের বেশি অন্তঃসত্ত্বা নারী
স্থানীয় নির্বাচনে বিশাল পরাজয়, বড়সড় অস্বস্তিতে ঋষি সুনাক
বাংলাদেশি গার্মেন্টস পণ্যের উপর ‘ল্যান্ডিং চার্জ’ বসানোর দাবি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের
ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনি নারী
মাতুয়াইলে ইউটার্নের সময় পিকআপ ভ্যানকে ধাক্কা বাসের, চালকসহ নিহত ২
মোবাইলের আলোয় অস্ত্রোপচার, মা ও নবজাতকের মৃত্যু
নাগরিকদের রক্ষাই কানাডার উদ্দেশ্য, ৩ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে জানালেন ট্রুডো
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অবশ্যই ভারতের অংশ: জয়শঙ্কর
রেকর্ড সংখ্যক হাজির সমাগম হবে মক্কায়, প্রস্তুতি নিচ্ছে সউদী আরব
রাফাহতে ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলা, ২১ ফিলিস্তিনি নিহত
ব্রাজিলে বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, নিখোঁজ শতাধিক
যুক্তরাষ্ট্রে মা-ভাইয়ের সামনে বাংলাদেশি যুবককে হত্যা, ভিডিও প্রকাশ
ভারতে ‘অপমানিত’ হয়ে পদত্যাগ আফগান কূটনীতিকের
ঈশ্বরদী রেল ইয়ার্ডে আগুনে পুড়ল বেশ কয়েকটি স্লিপার