মেরাজ : এক বিস্ময়কর মুজেজা
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে সকল মুজেজা দান করেছেন, তাঁর মধ্যে মেরাজে গমন এক মহাবিস্ময়কর মুজেজা। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন যেমন পৃথিবীর যেকোন সাহিত্যকর্ম ও জ্ঞানগ্রন্থের মোকাবেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী, ঠিক তেমনি নুরুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মেরাজ গমন বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞানীদের নিকট এক অনন্য সাধারণ গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানের যতই উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে ইসলামের বিধি-বিধান বুঝাও ততই সহজতর হচ্ছে। এক সময় বিজ্ঞানীরা বলতেন, কোনো প্রাণির পক্ষে আকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। তাই তারা মেরাজকে অস্বীকার করতেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষে তারাই প্রমাণ করলেন, মানুষ শুধু আকাশ নয়, বরং গ্রহ হতে গ্রহান্তরে, শূন্য হতে মহাশূন্যে বিচরণ করতে পারে। আমেরিকার নভোচারী পৃথিবী হতে দু’লাখ চল্লিশ হাজার মাইল দূরের চাঁদের সাথে মিতালী করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। এখন প্রতিযোগিতা চলছে, কে মঙ্গল, কে বুধ, কে শুক্র, ইউরেনাস ও নেপচুনে গিয়ে পৌঁছবে। তারপরেও মেরাজুন্নবী বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তন্মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য।
প্রথম প্রশ্ন: দুর্বল হৃদপি- নিয়ে মানুষের পক্ষে নভোম-ল ভ্রমণ সম্ভব নয়। কেননা, মানুষের হৃদপি- কেবল বায়ুম-লের অভ্যন্তরে কাজ করে। পৃথিবীর উপরে কেবল ৫২ মাইলব্যাপী বায়ুম-ল অবস্থিত। এর উপরে রয়েছে হিলিয়াম, ক্রিপ্টন প্রভৃতি হালকা গ্যাসীয় পদার্থ। বায়ুস্তর ভেদ করে হালকা গ্যাসীয় পদার্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কোনো প্রাণির পক্ষে তার প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্যই নভোচারীদের মহাশূন্যের উদ্দেশ্য যাত্রার পূর্বে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা শারীরিক সহিষ্ণুতার কৌশল, রক্তচাপ, হৃদয় ক্রিয়া, বুদ্ধির পরিমাপ, পঞ্চেন্দ্রীয় প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নভোম-ল ভ্রমণের উপযুক্ততা বিবেচনা করা হয়। অতঃপর তাকে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা সহকারে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়। এখন প্রশ্ন জাগে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জন্যও তদ্রুপ ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না। কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার কি তাঁর শরীরে অস্ত্রপচার করেছিলেন?
উত্তর: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে জানা যায়, যেসব ব্যবস্থা নভোচারীদের জন্য করা হয়, তার চাইতেও অনেক উন্নতর ব্যবস্থা সুনিপুণ ও শক্তিশালী ডাক্তার দ্বারা নবীজির জন্য করা হয়েছিল। তাঁকে সবকাজে উপযোগী করতে মহান আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত মহাবিজ্ঞ ডাক্তার জিব্রাইল আমীন আলাইহিসসালাম দু’বার তাঁর বক্ষ বিদারণ করেছিলেন এবং তাঁর বক্ষ মুবারক নূর দ্বারা শক্তিশালী করেছিলেন। প্রথমবার ৪ বছর বয়সে মা মালিমার গৃহে অবস্থানকালে। আরেকবার মেরাজ রজনীতে মেরাজে যাওয়ার প্রাক্কালে। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ তাআলা সূরা ইনশিরাহতে ইরশাদ করেন: ‘আমি কি আপনার জন্য আপনার বক্ষ প্রশস্ত করিনি?’ প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ মিশকাত শরীফে বর্ণিত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘আমার হৃদপি- বের করা হলো। তারপর ঈমানে পরিপূর্ণ এক সোনার তশতরী আনা হলো এবং আমার হৃদপি- ধৌত করা হলো। তারপর তা ঈমানে পরিপূর্ণ করা হলো এবং যথাস্থানে স্থাপন করা হলো।’ প্রমাণিত হলো, মেরাজে গমনের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হৃদপি-কে এমন এক শক্তি দ্বারা পূর্ণ করা হয়, যার প্রভাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সপ্তাকাশ অতিক্রম করে ঊর্ধ্বজগত তথা লা-মকানে পাড়ি জমান।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: আকাশ ভ্রমণে সবচেয়ে বড় বাধা মধ্যাকর্ষণ শক্তি, যা অতিক্রম করার জন্য অত্যাধিক দ্রুতগামী যানের প্রয়োজন। যেমন- নভোচারীরা মহাশূন্য যানের মাধ্যমে নভোম-লে অভিযান চালায়। যেগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ২৬ হাজার থেকে ৩২ হাজার মাইল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোনো দ্রুতগামী যানের মাধ্যমে মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ভেদ করে ঊর্ধ্বজগতে পাড়ি জমিয়েছেন?
উত্তর: উল্লেখিত প্রশ্নের সমাধান আজ থেকে পনের শত বছর পূর্বে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই দিয়েছেন। নবীজি ইরশাদ করেন: আমার আকাশ ভ্রমণ সংঘটিত হয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত জিব্রাইল কর্তৃক আনীত কল্পনাতীত গতিসম্পন্ন স্বর্গীয় বাহন বোরাকের মাধ্যমে, যার গতিবেগ ছিল প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি মাইল। জামে তিরমিযীতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহর বাণীই তার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি ইরশাদ করেন: ‘অতঃপর আমার নিকট গাধা হতে বড় খচ্চর অপেক্ষা ছোট একটি প্রাণি আনা হয়, যাকে বোরাক বলা হয়। তার চলার গতি এমনই ক্ষিপ্র ছিল যে, দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর।’ আকাশের দিকে তাকালে অজস্ত্র নক্ষত্র আমাদের চোখে পড়ে। কোন নক্ষত্র কতদূরে অবস্থিত, তার হিসাব দেয়া খুবই কঠিন। সাধারণত আকাশে দৃশ্যমান নক্ষত্ররাজির মাঝে ধ্রুবতারা অন্যতম, যা দ্বারা দিক নির্ণয় করা হয়। আর পৃথিবী থেকে ধ্রুব তারার দূরত্ব ৪৭ আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ এক বছরের আলোর গতি। সুতরাং ৪৭ আলোকবর্ষ সমান দুইশত বিরাশি লক্ষ কোটি মাইল। এভাবে নক্ষত্ররাজি নিয়ে হিসাব করলে আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে যায় বোরাকের গতিবেগ দেখে। অসাধারণ গতিবেগ নিয়েই বোরাক চলেছিল মহাকাশের দিকে আল্লাহর হাবীবকে বহন করে, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল বায়তুল্লাহ থেকে এবং সমাপ্ত হয় সিদরাতুল মুনতাহায়। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহা থেকে বোরাক অপেক্ষা দ্রুতগামী নূরের বাহন রফরফের মাধ্যমে আলমে লা মকানে গিয়ে আল্লাহ রাববুল ইজ্জতের সান্নিধ্যে গমন করেন।
তৃতীয় প্রশ্ন: সফরের সময়ের মেয়াদ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন করে থাকেন। শুভযাত্রার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করেন গৃহদ্বারে। ফিরে এসে দেখেন যে, ওযুর পানি তখনো গড়িয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই উক্ত সফর সমাধান করেন। প্রশ্ন ওঠা তাই স্বাভাবিক, ওই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে বায়তুল মুক্কাদাস হয়ে সপ্ত আসমান, জান্নাত-দোযখ ও লা-মকানের ভ্রমণ ও দিদার ইলাহী সম্পন্ন করা সম্ভব হলো?
উত্তর: রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের সফরের বিশৃঙ্খলা এড়ানোর লক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ সড়কে বা স্থানে নিদিষ্ট সময়ের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। নেতৃবৃন্দকে বহনকারী গাড়ি সে স্থান অতিক্রম করার পর আবার শুরু হয় স্বাভাবিক যান চলাচল। ওই সময়ে থেমে থাকা যানবাহনগুলোর মাইল-মিটারের কাঁটাগুলো স্থির হয়ে বসে থাকে। তাফসীরে রহুল মাআনী ও রুহুল বয়ান ইত্যাদি অধ্যয়ন করে জানা যায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সৃষ্টি জগতের প্রাণ। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজ রজনীতে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহর দাওয়াতে তাঁর দরবারে যাচ্ছিলেন, তখন সমস্ত বস্তুকে সচল পেয়েছিলেন। হুযুর যখন ঊর্ধ্বজগতে চলে গেলেন তখন সৃষ্টি তথা বিশ্ব কারখানাও বন্ধ হয়ে গেল। ঠান্ডা-গরম অবস্থায় থেমে যায়। হুযুরের বিছানায় উষ্ণতাও আপন অবস্থায় থেমে যায়। ওযুর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। দরজার কড়া নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নবীজি যখন মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন, আল্লাহর নির্দেশে কুদরতের কারখানা আবার সচল হয়, যে বস্তু স্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল, তা গতিশীল হতে শুরু করে। ওযুর পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে, দরজার কড়া নড়াচড়া করতে লাগল। বস্তুত জগতের পরিবর্তনের জন্য স্পন্দন দরকার। এর তখন স্পন্দন ছিল না। তাই মহাবিশ্বের কর্মযজ্ঞ বন্ধ ছিল। এ আলোচনা থেকে বুঝা যায়, মেরাজ সামান্য সময়ে সংঘঠিত হয়নি, কিন্তু জগতের স্পন্দন না থাকায় জগৎবাসী তা অনুধাবন করতে পারেনি।
মেরাজুন্নবী উপলক্ষে মহান প্রভু আপন মাহবুব ও তাঁর উম্মতকে অনেক নেয়ামত দান করেছেন। প্রবাসী গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় পরিবার-পরিজনের জন্য সাধ্যমত উপহার নিয়ে আসেন। আমাদের আক্বা মাওলা এক মহাসফরে গিয়েছিলেন। এই সফর ছিল অশ্রুতপূর্ব ও অতুলনীয় মর্যাদার। সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় উম্মতের জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে এসেছেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যা বান্দা আপন প্রতিপালককের দর্শন লাভের সোপান।
লেখক: আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ দরসে নিযামী মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম এবং খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার
আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়
হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড ইংল্যান্ড
পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল