কারাগারের পরিস্থিতি অমানবিক বললেও কম বলা হয়

Daily Inqilab সরদার সিরাজ

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশের কারাগারগুলোর অবস্থা নিয়ে এক লোমহর্ষক খবর প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইনকিলাবে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত উক্ত খবর মতে, দেশের কারাগারগুলোতে কয়েদীর সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি! উপরন্তু চরম স্থান সংকট, খাবার সংকট, চিকিৎসা সংকট এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদি চলছে। ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ৬৮টি জেলা কারাগার রয়েছে দেশে, যাতে নারী-পুরুষ মিলে মোট বন্দির সংখ্যা ৭৫ হাজার। কয়েদি বন্দির চেয়ে হাজতি বন্দির সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। কয়েদি বন্দিরা বিভিন্ন মেয়াদের সশ্রম/বিনাশ্রমের শাস্তি ভোগ করছে। আবার বিনা বিচারে আটক থাকাও রয়েছে অনেক। অথচ কারাগারগুলোর মোট বন্দির ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪৩ হাজার। নারী বন্দিদের জন্য কোনো গাইনি ডাক্তার নেই। অনুমোদিত ১৪১টি ডাক্তারের পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৬ জন ডাক্তার। অন্য জনবলেরও সংকট তীব্র! জেলকোড অনুযায়ী বন্দিদের জন্য স্থান বরাদ্দ ৩৬ স্কয়ার ফুট। কিন্তু বন্দির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় সকলকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে, যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস নেই। খাবারের মান খারাপ। পানি, শৌচাগার ও গোসল করার সংকট মারাত্মক। তাই এসবের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সর্বোপরি মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ কারবার চলে। শক্তিশালীরা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, দুর্বলরা চরম নিষ্পেষিত হয়।

অর্থাৎ দেশের কারাগারগুলোতে চরম অমানবিক অবস্থা বিরাজ করছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বললে অত্যুক্তি হবে না। ইতোপূর্বেও দেশের কারাগারগুলোর দুর্নীতি, মাদক কারবার, বন্দিদের সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার, বন্দির পলায়ন ইত্যাদি খবর প্রকাশিত হয়েছে বহুবার। মায়ের সাথে শিশু বন্দির এবং ডা-া বেড়ি পরে আপনজনের জানাজায় শরীক হওয়া ইত্যাদিরও সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্যবার, যা দেখে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়েছে। অনেক সময় ভয়ংকর বন্দির সাথে থাকতে হয় ভালো বন্দিদের। ফলে ভালরাও ভয়ংকর হয়ে উঠে। এছাড়া, নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত বন্দির সাথে থাকতে থাকতে ভালো বন্দিও নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ভিআইপি বন্দিরা বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পেলেও সাধারণ বন্দিরা বাইরের চিকিৎসা করার সুযোগ পায় না। ফলে তারা ব্যাধিমুক্ত হয় না দীর্ঘদিন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কোনো গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসন থাকা দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচার শেষে দোষী সাব্যস্ত হাওয়ার পর থেকে কারাভোগ শুরু করেন। অথচ, বাংলাদেশে এক তৃতীয়াংশের অধিক বন্দি বিচার চলা অবস্থায় কারা ভোগ করেন!

দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সামান্য কিছু টাকার অনিয়মের অভিযোগে বয়স্ক বন্দি জামিন পায় না; দীর্ঘদিনের কারাদ- হয়। আবার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে অভিযুক্ত বন্দি নির্দ্বিধায় জামিন পায়। এছাড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া চন্দ্র বিজয়ের সমান। অনেক মামলা বাদীর জীবদ্দশায় নিঃষ্পত্তি হয় না। বিশেষ করে, দেওয়ানি মামলা। কারণ, দেশের বিদ্যমান আইনের অধিকাংশই বহু পুরানো। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বলেন, ‘ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ৩৬৯টি আইন বাংলাদেশে এখনো চালু রয়েছে’। অবশ্য এসবের মধ্যে কিছু আইন ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। বাকীগুলো পূর্বাবস্থাতেই রয়েছে।

বিনা বিচারে দিনের পর দিন আটক থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ক্ষেত্রেও তথৈবচ। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি বহুবার অভিযোগ করে বলেছে, ভুয়া লক্ষাধিক মামলায় দলের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তন্মধ্যে অসংখ্যজন কারাগারে বন্দি রয়েছে। অনেক শীর্ষ নেতা বহু চেষ্টা করেও জামিন পাচ্ছেন না। সর্বোপরি অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা রয়েছে। এভাবে দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪০ লাখের অধিক। আইনমন্ত্রী গত ৪ জুন’২৩ জাতীয় সংসদে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের অধস্তন আদালতসমূহে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৭০ হাজার ৬৭০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা হলো ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৬০টি এবং ফৌজদারি মামলা ২০ লাখ ৮৬ হাজার ৫১০টি’। ইতোমধ্যে এ সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে। সর্বোপরি উচ্চ আদালতেও বিচারাধীন অনেক মামলা রয়েছে। মোট মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকের সংখ্যা কয়েক কোটি। বিনা বিচারে হত্যা, যাকে বলে ক্রসফায়ার, বন্দিদশায় মৃত্যু ইত্যাদিও বাংলাদেশে বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কিছু দিন আগে। তার পর থেকে ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু বন্দিদশায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে কারাগারে ১২ বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে’। ফলে বন্দিদের আপনজনরা শংকিত হয়ে পড়েছে। আটক ব্যক্তিদের উপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ ব্যাপক। বিচারাধীন বন্দির সংখ্যায় এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে আর বিশ্বে পঞ্চম বলে খবরে প্রকাশ। অথচ, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচলিত প্রবাদ বাক্য হচ্ছে, জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাইড। অপরদিকে, দেশে মামলা পরিচালনার ব্যয় অত্যধিক, যা বহন করতে বছরে অসংখ্য লোক সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ চরম অমানবিক কর্মের নিন্দা জানিয়ে রাজনৈতিক ও মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার এবং বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বহুবার। জাতিসংঘসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশও রাজনৈতিক মামলায় বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে অনেকবার। কিন্তু সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেনি। ফলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে এ দেশে! তবুও নিষ্কৃতি নেই। অথচ, বিশ্বব্যাপী বিচারের বাণী হচ্ছে, শত দোষী ব্যক্তি রেহাই পেলেও পেতে পারে, কিন্তু একজন নির্দোষ ব্যক্তিও যেন বিন্দুমাত্র শাস্তি না পায়। কিন্তু এ দেশে অপরাধীর চেয়ে নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায় বেশি! বিশেষ করে, বিরোধী দলের লোকরা এবং প্রতাপশালী ব্যক্তিদের প্রতিপক্ষরা, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী! অন্যদিকে, বিচারক ও অন্য জনবলের স্বল্পতা, আইনজীবীদের বারবার তারিখ গ্রহণ এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ না হওয়া বিচার বিলম্বের প্রধান কারণ। উপরন্তু দেশের বেশিরভাগ আইন সময়োপযোগী নয়।

যা’হোক, দেশে অপরাধ অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও কমবেশি থাকবে। তাই অপরাধীদের শাস্তি হবে। কারাবরণ করতে হবে। কিন্তু সেখানে যেন কোনো বন্দি অমানবিক পরিস্থিতির শিকার না হয়, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, সুষম খাদ্য, আলো-বাতাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, বন্দির বরাদ্দকৃত স্থান বৃদ্ধি এবং নিয়ম-শৃংখলা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে। সর্বোপরি কারাগারগুলোকে দুর্নীতি, হয়রানি, মাদক ও অনিয়ম মুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে দেশের সব কারাগারকে আধুনিক করতে হবে। প্রয়োজনে কারাগারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বিনা বিচারে আটক, অপহরণ, নিখোঁজ, জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় ইত্যাদি চরম অমানবিক কর্ম। তাই এসব বন্ধ করা আবশ্যক। মিথ্যা, প্রতারণা ও প্রতিহিংসামূলক মামলাকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে এসব মামলা বন্ধ হয়ে মোট মামলা সংখ্যা অনেক কমে যাবে। মানুষের হয়রানিও বন্ধ হবে। আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কার করে আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে হবে। বিচারকসহ বিচার বিভাগের সব শূন্য পদ পূরণ করতে হবে অবিলম্বে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

হল্যান্ডে-রিয়ালের রাতে হ্যাটট্রিক রোনালদোর, নাসেরের গোল উৎসব

হল্যান্ডে-রিয়ালের রাতে হ্যাটট্রিক রোনালদোর, নাসেরের গোল উৎসব

চার ম্যাচ হাতে রেখেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন রিয়াল

চার ম্যাচ হাতে রেখেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন রিয়াল

ঘুরে দাঁড়িয়ে বার্সাকে হারিয়ে জিরোনার ইতিহাস

ঘুরে দাঁড়িয়ে বার্সাকে হারিয়ে জিরোনার ইতিহাস

হল্যান্ডে একাই দিলেন চার গোল,সিটির দাপুটে জয়

হল্যান্ডে একাই দিলেন চার গোল,সিটির দাপুটে জয়

নারী বিশ্বকাপের সূচির জন্য শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা

নারী বিশ্বকাপের সূচির জন্য শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা

সরকার হটাতে গণবিপ্লব ঘটাতে হবে : আমিনুল হক

সরকার হটাতে গণবিপ্লব ঘটাতে হবে : আমিনুল হক

যুদ্ধ সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে: ভিসি ড. মশিউর রহমান

যুদ্ধ সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে: ভিসি ড. মশিউর রহমান

শ্রমিকদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা - বদিউজ্জামান সোহাগ

শ্রমিকদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা - বদিউজ্জামান সোহাগ

ব্রাহ্মণপাড়ায় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

ব্রাহ্মণপাড়ায় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

‘পানি তাল খাইয়া শরীরডা ঠান্ডা কইরা যায় সবাই’

‘পানি তাল খাইয়া শরীরডা ঠান্ডা কইরা যায় সবাই’

বাজিতপুরে বিশাল মাহফিল আজ

বাজিতপুরে বিশাল মাহফিল আজ

শ্রীনগরে ৭টি ঘর পুড়ে ছাই

শ্রীনগরে ৭টি ঘর পুড়ে ছাই

অসহনীয় গরম ও লোডশেডিংয়ে চরম জনভোগান্তি

অসহনীয় গরম ও লোডশেডিংয়ে চরম জনভোগান্তি

দৈনিক ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের পর নদীর বাঁধ অপসারণ

দৈনিক ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের পর নদীর বাঁধ অপসারণ

ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ২৫

ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ২৫

বড়াইগ্রামে নিজ ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু

বড়াইগ্রামে নিজ ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু

কাপ্তাই হ্রদ শুধু দেশের নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পদ

কাপ্তাই হ্রদ শুধু দেশের নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পদ

রাজবাড়ী-ভাঙ্গা-ঢাকা রুটে কমিউটার রেলের যাত্রা শুরু

রাজবাড়ী-ভাঙ্গা-ঢাকা রুটে কমিউটার রেলের যাত্রা শুরু

ফ্রি ফায়ারে পরিচয়ে বিয়ে ৬ মাস পর লাশ

ফ্রি ফায়ারে পরিচয়ে বিয়ে ৬ মাস পর লাশ

দৌলতপুরে আগুনে পুড়লো ব্যবসায়ীর ৫ ঘর ও নগদ ১২ লাখ টাকা

দৌলতপুরে আগুনে পুড়লো ব্যবসায়ীর ৫ ঘর ও নগদ ১২ লাখ টাকা