উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশে যেমন মেধাবী প্রজন্মের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজুড়ে সুনাম থাকলেও এখন তা বিশ্বের এক হাজার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নেই। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য বিদেশী শিক্ষার্থীরা ছুটে আসত। এমনকি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও উপমহাদেশসহ উন্নত দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য আসত। এখন দিন দিন বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরাও ব্যাপক হারে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক বিদেশি শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষাবিদদের মতে, মানস¤পন্ন শিক্ষার ঘাটতি, ভালো শিক্ষকের অভাব, গবেষণা ও আধুনিক গবেষণাগারের সুবিধা না থাকা, আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকা, চাকরির অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। ’৭০ ও ’৮০ দশকে মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতো। এখন উল্টো চিত্র। বাংলাদেশেরই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্য।

বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের শিক্ষার মান নি¤œগামী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষাবিদরা ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। দেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেলেও প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার ২৫টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ৫৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের অধিভুক্ত কলেজ এবং ১১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। অথচ গত ১৫ বছরে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ গুণ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দেশে কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগসহ বেশ কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৬ হাজার ৬০৯। যেখানে মানসম্মত শিক্ষার অভাব ও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার কারণে দেশের শিক্ষার্থীরা বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে, সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারানো স্বাভাবিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের শিক্ষার মান কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপরাজনীতি, সন্ত্রাস, দলবাজ শিক্ষক অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। আমরা দেখছি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর শিক্ষার্থী কিভাবে খুন, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাই, অপহরণ, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব থেকে শুরু করে হেন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। তাদের এসব ভয়াবহ অপকর্মের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ যেমন বিনষ্ট, আস্থাহীন, ভীতিকর হয়ে পড়েছে, তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা মেধাবী, তারা কোনো রকমে শিক্ষাবর্ষ পার করে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদেশ গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, সেখানেই থেকে যাচ্ছে। দেশে আসছে না। তারা ভাল করেই জানে, দেশে এসে তাদের শিক্ষা কাজে লাগানোর সুযোগ ও ক্ষেত্র খুবই কম। অন্যদিকে, ছাত্রলীগ নামধারী অপকর্মকারী এবং তুলনামূলক কম মেধাবীরা দেশে থেকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিতে তারা কী ভূমিকা রাখবে, তা সহজেই অনুমেয়। একজন অভিভাবকও এখন সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। তারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে সংশয় ও শঙ্কার মধ্যে থাকে। শিক্ষাবিদদের মতে, বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী কম হওয়ার কারণ হচ্ছে, পাঠদান পদ্ধতি, ক্রেডিট ট্রান্সফার, স্কলারশিপের সুযোগ, পিএইচডি, এমফিল, র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকা, ভাষাগত সমস্যা, চাকরির সুযোগ না থাকাসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, অরাজকতা, যোগ্যতা নয়, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দায়ী। যে র‌্যাংকিং দেখে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী সেই র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের আকৃষ্ট হওয়ার মতো কিছুই নেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর আধিপত্য, নানা অপকর্ম, বিশেষ করে কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা সারা বিশ্বে প্রচারিত হচ্ছে-ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স¤পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের মেধাবীদের ধরে রাখার জন্য যেমন পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন সেটি আমরা দিতে পারছি না।

শিক্ষার মানের ক্রমাবনতিতে আমাদের আগামী প্রজন্ম কেমন হবে, তার চিত্র উৎকণ্ঠার। এমন চিত্র দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। শিক্ষার মানের অবনতির জন্য ইউজিসি দায় এড়াতে পারে না। ইউজিসি লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কিভাবে মান উন্নয়ন করা যায়, সে নিয়েও প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষাবিদদের অসন্তোষ কিংবা পরামর্শও আমলে নিচ্ছে বলে মনে হয় না। শিক্ষা পদ্ধতি থেকে শুরু করে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করতে পারছে না। শিক্ষার মানের চলমান নি¤œগামিতা এবং মেধাবীরা কেন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে ও বিদেশিরা আগ্রহ হারাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মেধাপাচার ঠেকাতে হবে। আমাদের দেশে বিদেশি শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আরও বেশি আগ্রহী হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বলা বাহুল্য, এতে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রাও যুক্ত হবে। ভারতসহ উন্নত বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলছে। এতে দেশগুলো যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে, তেমনি দেশের ভাবমর্যাদাও উন্নত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষসহ শিক্ষাবিদদের নিয়ে শিক্ষার মান উন্নতকরণে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

হল্যান্ডে-রিয়ালের রাতে হ্যাটট্রিক রোনালদোর, নাসেরের গোল উৎসব

হল্যান্ডে-রিয়ালের রাতে হ্যাটট্রিক রোনালদোর, নাসেরের গোল উৎসব

চার ম্যাচ হাতে রেখেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন রিয়াল

চার ম্যাচ হাতে রেখেই লা লিগা চ্যাম্পিয়ন রিয়াল

ঘুরে দাঁড়িয়ে বার্সাকে হারিয়ে জিরোনার ইতিহাস

ঘুরে দাঁড়িয়ে বার্সাকে হারিয়ে জিরোনার ইতিহাস

হল্যান্ডে একাই দিলেন চার গোল,সিটির দাপুটে জয়

হল্যান্ডে একাই দিলেন চার গোল,সিটির দাপুটে জয়

নারী বিশ্বকাপের সূচির জন্য শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা

নারী বিশ্বকাপের সূচির জন্য শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা

সরকার হটাতে গণবিপ্লব ঘটাতে হবে : আমিনুল হক

সরকার হটাতে গণবিপ্লব ঘটাতে হবে : আমিনুল হক

যুদ্ধ সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে: ভিসি ড. মশিউর রহমান

যুদ্ধ সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে: ভিসি ড. মশিউর রহমান

শ্রমিকদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা - বদিউজ্জামান সোহাগ

শ্রমিকদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা - বদিউজ্জামান সোহাগ

ব্রাহ্মণপাড়ায় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

ব্রাহ্মণপাড়ায় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

‘পানি তাল খাইয়া শরীরডা ঠান্ডা কইরা যায় সবাই’

‘পানি তাল খাইয়া শরীরডা ঠান্ডা কইরা যায় সবাই’

বাজিতপুরে বিশাল মাহফিল আজ

বাজিতপুরে বিশাল মাহফিল আজ

শ্রীনগরে ৭টি ঘর পুড়ে ছাই

শ্রীনগরে ৭টি ঘর পুড়ে ছাই

অসহনীয় গরম ও লোডশেডিংয়ে চরম জনভোগান্তি

অসহনীয় গরম ও লোডশেডিংয়ে চরম জনভোগান্তি

দৈনিক ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের পর নদীর বাঁধ অপসারণ

দৈনিক ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের পর নদীর বাঁধ অপসারণ

ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ২৫

ভোলায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত ২৫

বড়াইগ্রামে নিজ ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু

বড়াইগ্রামে নিজ ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার মৃত্যু

কাপ্তাই হ্রদ শুধু দেশের নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পদ

কাপ্তাই হ্রদ শুধু দেশের নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পদ

রাজবাড়ী-ভাঙ্গা-ঢাকা রুটে কমিউটার রেলের যাত্রা শুরু

রাজবাড়ী-ভাঙ্গা-ঢাকা রুটে কমিউটার রেলের যাত্রা শুরু

ফ্রি ফায়ারে পরিচয়ে বিয়ে ৬ মাস পর লাশ

ফ্রি ফায়ারে পরিচয়ে বিয়ে ৬ মাস পর লাশ

দৌলতপুরে আগুনে পুড়লো ব্যবসায়ীর ৫ ঘর ও নগদ ১২ লাখ টাকা

দৌলতপুরে আগুনে পুড়লো ব্যবসায়ীর ৫ ঘর ও নগদ ১২ লাখ টাকা