এই মৃত্যুর দায় কার?
০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লেগে ৪৬ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এখন শোকের মাতম চলছে। চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, প্রবাসীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন। তাঁদের খুব কমই নিরাপদে ফিরতে পেরেছেন। যাঁরা সেখানে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে ফিরেছেন লাশ হয়ে। কয়েকটি পরিবার একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অনেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, যাঁদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অগ্নিকা-ের সময় কয়েকশ’ লোক ছিলেন ওই ভবনে। খবর পেয়ে অকূস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছেন। তবে একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ কক্ষে আটকে পড়ে বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন শিশু, নারীসহ প্রায় অর্ধশত মানুষ। র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগুনের সূত্রপাত নিচের ‘চুমুক’ নামক একটি দোকান থেকে। এক পর্যায়ে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে ছিল একটিমাত্র সিঁড়ি ও দুটি লিফট। সিঁড়িতেও থরে থরে গ্যাস সিলিন্ডার সাজানো ছিল।
ব্যস্ততম রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণহানি হয়, পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল। দায়িত্বহীনতার কারণে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও মামলা হয় না। আবার যেসব ঘটনায় মামলা হয়, সেগুলোর বিচার আলোর মুখ দেখেনি আজও। দায়ীদের সাজার কোনও নজির নেই। মামলা করার পর সমালোচনার মুখে পড়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেফতার হলেও কিছুদিন পর জামিনে মুক্তি পেয়ে প্রকাশ্যে বুক টান করে ঘুরে বেড়ান তারা।
এর আগে চুড়িহাট্টা, নিমতলী ও বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুন লেগে বহু হতাহতের ঘটনা সবার জানা। গত বছর শুধু রাজধানীতেই বেশ কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, এপ্রিলে বঙ্গবাজার, এরপর নিউসুপার মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। সিদ্দিকবাজারে একটি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারান।
বরাবরের মতোই বেইলি রোড ট্রাজেডির পর বিভিন্ন দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এখন কড়া হুঁশিয়ারিমূলক বক্তব্য আসছে। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে। যখনই কোনো মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে, তখনই বড়কর্তাদের মুখ থেকে ছাড় না দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়। এমন কথা অতীতেও বহুবার শোনা গেছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি অনিয়ম।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রিন কোজি কটেজে কোনো অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, ওই ভবনের কেবল আটতলায় আবাসিকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। বাকি এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হলেও সেখানে কেবল অফিস কক্ষ করার জন্য অনুমোদন ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্ট শোরুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
প্রাথমিক তদন্তে যে চিত্র এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ভবন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় আইনকানুনের তোয়াক্কা করা হয়নি। অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না রেখে কীভাবে ছয়তলা একটি ভবনে এতগুলো রেস্তোরাঁ চালু ছিল, সেটাই প্রশ্ন। প্রতিটি রেস্তেরাঁয় কিচেন ছিল এবং সেখানে রান্না হতো গ্যাস সিলিন্ডারে। বারান্দা ও সিঁড়িঘরেও গ্যাস সিলিন্ডার ছিল অনেকগুলো। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা ঘটলে যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, বেইলি রোডের ওই ভবনটি জানান দিয়ে গেল।
কারো অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে যখন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটে, তখন তাকে নিছক দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। এটা এক ধরনের হত্যা। বেইলি রোডের ভবনমালিককে তিনবার নোটিশ দেওয়ার পরও যদি তিনি সেখানে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না নিয়ে থাকেন, তাহলে এই মৃত্যুর দায় তাকে নিতে হবে। রাজউক বলেছে, ভবনমালিক বিনা অনুমতিতে সেখানে রেস্তোরাঁ করেছেন। প্রশ্ন হলো, রাজউক এতদিন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না কেন? এতগুলো প্রাণহানির জন্যে অপেক্ষায় ছিলো?
কেবল বেইলি রোডের ভবনটি নয়, ঢাকা শহরে এ রকম অবকাঠামো অনেক আছে। দুর্ঘটনা ঘটার পরই আমরা জানতে পারি, সেখানে কী কী ত্রুটি বা দুর্বলতা ছিল। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা অসংখ্য রেস্তোরাঁয় নিরাপদ নির্গমনে বিকল্প সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। এ রকম অবস্থায় আগুন লাগলে সমূহ বিপদ। প্রতিটি ভবনে প্রশস্ত ও বিকল্প সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন।
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের অনেকগুলো বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বিল্ডিং কোডগুলো মেনে চলতে হয়। কিন্তু অনেক ভবনমালিকই সেটা মানেন না। আবার তদারককারী যেসব সংস্থা আছে, তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে না। আমাদের আইন আছে কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ হয় না।
নগরবিদরা বার বার তাগিদ দিয়ে বলছেন, প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তার জন্য ভবনটি যাঁরা নির্মাণ করেন, তাঁদের সচেতন থাকতে হবে। আইন মেনে চলতে হবে। প্রতিটি ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ও বহির্গমনের পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা থাকতে হবে। আগুন লাগলে পরিস্থিতি সামলাতে কর্মীদের প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডারের মতো দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও নিয়মিত তদারক করতে হবে। সেটি অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি ভবন পরিদর্শন বিভাগকেও।
রাজধানীর উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলে খ্যাত ‘নাটকপাড়া’ বেইলি রোড। হালে এটি ভোজনবিলাসীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাহারী নামের ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি এখানে। তেমনই অনেকগুলো রেস্টুরেন্টে রসনাবিলাসে গিয়ে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল। কেউ নেবে এর দায়? কেউ নিচ্ছে না।
ঢাকা এক আজব ও অনিরাপদ শহর। এই শহরে বেড রুম নিরাপদ নয়, ফুটপাত নিরাপদ নয়, যানবাহন নিরাপদ নয়, আবাসিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, বাণিজ্যকেন্দ্র অনিরাপদ, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন পার্কÑ কিছুই নিরাপদ নয়। শৃঙ্খলাহীনতা, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করার বেপরোয়া মনোভাবের কারণে নিয়মিত কত প্রাণ যায়, কত কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু দায়িত্বহীনতার অবসান হয় না। আর কত মৃত্যু দেখলে, আর কত স্বজন হারানো মানুষের হাহাকার শুনলে আমরা দায়িত্বসচেতন হয়ে উঠব, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?
বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিরপূর্ণ শহরের তালিকায় আমাদের রাজধানী ঢাকা শিরোপা ধরে রেখেছে। দূষিত বায়ুর বিবেচনায় ঢাকা শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে সাম্প্রতিক সময়েও! বিশে^র ধীরগতির শহর হিসেবে ঢাকা শীর্ষে বলেও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এখন দায়হীন প্রাণহানি আর সারি সারি লাশের শহর হিসেবেও বোধকরি ঢাকা নাম্বার ওয়ান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশে গণ প্রাণহানিতো বটেই এক বা একাধিক মৃত্যুর দায় নির্ধারণ হয় দ্রুততার সঙ্গে। শাস্তি হয়। কোনো ভয়াবহ ট্রাজেডি পারস্পারিক দোষারোপে হারিয়ে যায় বলে জানা নেই। কেবল বাংলাদেশে নিয়মিত বিরতিতে লাশের মিছিল দেখতে হয়, আর কয়েক দিন অভিযোগ, নীতিবাক্য বর্ষণের পর স্তিমিত হয়ে যায় সবকিছু।
জানি, মানুষের উদ্বেগ, দাবি ও চাওয়ায় কারও কিছু যায় আসে না। কর্ণপাত করারও সময় নেই। তবুও বলি, যাঁদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল, তাঁদের প্রত্যেকের দায় নিরূপণ করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। অতীতে চুড়িহাট্টা, নিমতলী, এফআর টাওয়ায়, বঙ্গবাজারের ঘটনায় দায়ীরা পার পেয়ে গেছে। এবারও তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয় কোনোভাবেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন খুলছে আজ
বিচিত্রার সম্পাদক দেওয়ান হাবিব আর নেই
জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা শামীম হত্যা : ৮ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ
তোফাজ্জলকে হত্যার আগে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা চাওয়া হয় পরিবারের কাছে
বিশ্বের কাছে ১২টি পরমাণু গবেষণার ও স্থাপনা উন্মুক্ত করবে চীন
এবার রাবির শেরে-বাংলা হল থেকে লাঠিসোঁটা-হকিস্টিক উদ্ধার
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস
লেবাননে এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা ইসরায়েলের
সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাইলেন পঞ্চগড়ের নতুন জেলা প্রশাসক
ইনস্টাগ্রামের মতো ফিচার এবার আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও!
যুক্তরাষ্ট্রে কোর্টহাউসে বিচারককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা
তাপপ্রবাহ নিয়ে যা জানা গেল
৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা
‘ভারতীয় খাবার জঘন্য’, অস্ট্রেলিয়ান ইউটিউবারের পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে
ট্রাম্পের তথ্য চুরি করে বাইডেন শিবিরে পাঠিয়েছিল ইরান! দাবি গোয়েন্দা সংস্থার
সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নান গ্রেফতার
ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার
আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়
হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড ইংল্যান্ড
পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের