ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

উন্নয়নের প্রপঞ্চ এবং ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ জনগণ বয়কট করছে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:১০ এএম

রাজনৈতিক উন্নয়নবাজি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রথমে প্রপঞ্চ তারপর প্রতারণার মতো মনে হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির গোলক ধাঁধায় দেশের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির হাতে বিপুল বিত্ত-বৈভব জমা হয়েছে। তারা এসব সম্পদের বেশিরভাগ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে। অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য-অনটনের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা ক্রমে এক জটিল সামাজিক বাতাবরণ তৈরী করেছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক লুটপাট, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার, ক্রমবর্ধমান ঋণের বন্দিত্বে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত করে তোলার বাস্তবতায় দেশ একটি চরম অর্থনৈতিক সংকট থেকে দুর্ভিক্ষের দিকে যাত্রা করেছে। দেশের নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বা বিরোধীমতের লোকেরা যেমন এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছে, একইভাবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। পরপর চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে, আওয়ামীলীগ নেতা শেখ হাসিনাও ২০২৪ সালে একটি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন। তার বক্তব্যের নেপথ্য রাজনৈতিক ইঙ্গিত যাই থাক না কেন, দুর্ভিক্ষের অন্তরালে তিনি মূলত একটি অর্থনৈতিক মহামন্দা বা সংকটকেই নির্দেশ করেছেন। বিশ্বায়ণের এ যুগে দেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বড় ধরণের আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি কিংবা মহাযুদ্ধের মত ঘটনা ছাড়া বাণিজ্য ও উৎপাদন ব্যবস্থায় দৈব-দুর্বিপাক না ঘটলে কোনো জনগোষ্ঠির না খেয়ে মরার কোনো কারণ নেই। তবে মূল শর্ত হচ্ছে, দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সামর্থ অটুট থাকতে হবে। শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য বিপর্যয়ের করুন চিত্র ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। বিশ্বের প্রতিটি দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটের ইতিহাস মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং উৎপাদনের বিপণন ও বন্টন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার ইতিহাস। রোম পোড়ার সময় সম্রাট নীরোর বাঁশি বাজানোর মত চরম দুর্ভিক্ষের সময়ও একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীকে ভোগ-বিলাসে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে দেখা যায়। সম্পদের সুষম বন্টন, কর্মসংস্থান এবং শ্রমিক শ্রেণীর উপযুক্ত মজুরির নিশ্চয়তার অভাবে কোটি কোটি মানুষ খাদ্য সংকট, পুষ্টিহীনতা, অপচিকিৎসা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনে ধুকেধুকে মরতে বাধ্য হয়। ইতিহাসের কুখ্যাত মনন্তরে হাজার হাজার নিরন্ন-ক্ষুধার্ত মানুষ রাস্তায় মরে পড়ে থাকার মত পরিস্থিতি আর না ঘটলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ ও লুণ্ঠনের কারণে সৃষ্ট নীরব দুর্ভিক্ষের ছোবল আড়াল করার প্রয়াস আড়াল করা যাচ্ছে না। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে বিগত দুই শতকে এ দেশে বার দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশ সৈন্যদের রসদ যোগাতে গিয়ে ১৯৪৩ সালে (বাংলা ১৩৫০) বাংলায় নেমে আসা দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, যা ইতিহাসে পঞ্চাশের মনন্তর নামে পরিচিত। বৃটিশ ঐতিহাসিকরাও এর জন্য যুদ্ধকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টিন চার্চিলকে দায়ী করেন। দেড় দশক ধরে তথাকথিত উন্নয়নের ডামাডোলের আড়ালে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং কয়েক কোটি মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ও নীরব দুর্ভিক্ষের নেপথ্যে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রীয় লুন্ঠনব্যবস্থাই দায়ী।

দেশের মানুষ ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ হারিয়েছে। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিকে সামনে রেখে দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণ করেছিল, জীবন দিয়েছিল, সেই গণতন্ত্রকে তথাকথিত উন্নয়নের মোড়কে ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টাও দেখা গেছে। বাংলাদেশ যখন গণতান্ত্রিক বিশ্বের তালিকা থেকে ছিটকে পড়ছে, তখন দেশের এক শ্রেণীর রাজনৈতিক গোষ্ঠির কণ্ঠে বলতে শোনা গেছে, ‘কম গণতন্ত্র, অধিক উন্নয়ন’। উন্নয়ন বলতে তারা মূলত পদ্মাসেতুসহ কিছু মেগা অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প বাস্তবায়নকে বুঝিয়েছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে একেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আড়ালে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়ার বিপরীতে চরম সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণীর একচ্ছত্র আধিপত্যে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাতগুলোও একই রকম লুটপাট ও অর্থ পাচারের মচ্ছবে পরিনত হয়ে এখন দেউলিয়াত্বের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত বছর দেশের ব্যাংকিং খাত প্রায় ১ লাখ গ্রাহক হারিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার পারদ ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এটি বড় ধরণের অনাস্থা ও সংকটের অশনি সংকেত। অথচ এতদিন ধরে সরকার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে নেয়ার কৃতিত্ব জাহির করে এসেছে। মূলত: বাংলাদেশের মত এলডিসিভুক্ত দেশের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতি নির্ভর করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত রাজিনৈতিক ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ, সুশাসন ও জাতীয় ঐক্যের মানদ-ের উপর ভিত্তি করে। গত দেড় দশকে দেশে একটি একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা এবং দূরনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রথমত: দেশে গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের রাজনীতিকে নস্যাৎ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিতে পরিনত হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি-অস্বচ্ছতাকে বৈধতা দিতে আইনগতভাবে ইমিউনিটি দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশি-বিদেশি কতিপয় চিহ্নিত গোষ্ঠিকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। গত দেড় দশকে দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা শত বিলিয়ন ডলারের অঙ্ক অতিক্রম করেছে। স্বাধীনতাত্তোর অবশিষ্ট সময়ের চেয়ে এ হার অন্তত ৫ গুণ বেশি। একটি সদ্যোজাত শিশু থেকে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপর মাথাপিছু লাখ টাকার বৈদেশিক ঋণ। জাতীয় বাজেটের শতকরা ২০ ভাগের বেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় করেও মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও ন্যুনতম সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক খাতগুলোতে লাখ লাখ কর্মসংস্থান ভারতীয়দের দখলে চলে গেছে। বিদেশে কর্মরত আমাদের দেড়কোটি প্রবাসী কর্মী যে পরিমান রেমিটেন্স দেশে পাঠায়, তার অর্ধেক ভারতীয় কর্মীরা নিয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদী ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের গ্যাঁরাকলে পড়ে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ যেন আজো সেই তলাবিহীন ঝুড়ির বাস্তবতা অতিক্রম করতে পারছে না। দশক ধরে অবিরাম উন্নয়নের বাদ্য শোনার পর দেশের কোটি কোটি মানুষ এখন এক নীরব দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। ঢাকার রাস্তায় আবার সেই চুয়াত্তুরের মত ভিক্ষুক ও নিরন্ন মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছে।

গণতন্ত্র কক্ষচ্যুত হলে দেশের রাজনীতি যখন সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, রাষ্ট্রশক্তি যখন জনগণের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নেয়, বিভক্ত-অসংগঠিত সাধারণ মানুষও এক সময় প্রতিবাদের বিকল্প ভাষা ও শক্তি খুঁজে নেয়। সামরিক স্বৈরাচার হটিয়ে একটি টেকসই ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূল জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করে দেশে একটি রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের আস্থার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার বদলে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কুশীলবদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জরুরি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার পর তা পুণ:প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করে বার বার ভোটারবিহিন একপাক্ষিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা হলেও জনগণের নিরব প্রতিবাদের ভাষা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে। গত বছর ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি’র মহাসমাবেশ ভন্ডুলের মধ্য দিয়ে সরকার আগের দুইটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকেও একপাক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের কমিটমেন্ট ভারতীয় আধিপত্যের কাছে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো অস্ত্রই যখন আর কাজে লাগছে না, বিরোধীদল এবং দেশের মানুষ বয়কটের শক্তিকে কাজে লাগাতে একটি প্রচ্ছন্ন জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সবকিছুই করেছিল। জনগণের হাতে থাকা একমাত্র বিকল্প অস্ত্র হচ্ছে সরকারের আহ্বানে সাড়া না দেয়া বা নির্বাচন বর্জন করা। নির্বাচনে জনগণের সেই অমোঘ শক্তির প্রতিফলন দেখা গেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অনুষ্ঠিত হাইপ্রোফাইল একটি জাতীয় নির্বাচনে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সারাবিশ্ব দেখল, দেশের মানুষ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন বা বয়কট করেছে। দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শত্রুমিত্র চিহ্নিত হয়েছে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশার পাশাপাশি আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের একাত্মতা ও প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করতে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে। অগণতান্ত্রিক পন্থায় একটি বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গত দেড় দশকে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভারতের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থের একচ্ছত্র বাজার। ভারতীয় প্রযোজনায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর দেশের জনগণ এবার ভারতীয় পণ্যবর্জনের ডাক দিয়েছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভারতীয় পণ্যবর্জনের ডাক ইতিমধ্যে ভারতের অর্থনীতিতে বড় ধরণের প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ভারতে বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের পেছনে রয়েছে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বঞ্চনার ইতিহাস। দেড়শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকা পূর্ববঙ্গ ও আসামের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন বেঙ্গল প্রদেশ ঘোষণা করেন। এরই প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী নেতারা বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সাথে সাথে স্বদেশী আন্দোলন তথা বিলেতি পণ্যবর্জনের ডাক দেন। বৃটিশ পণ্যের বিশাল বাজার ভারতে বিলেতি পণ্য র্জনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ও হুমকি সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে মাত্র ৫ বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদের দাবী আদায়ে সক্ষম হয়। পিছিয়েপড়া, অনগ্রসর পূর্ববাংলার মানুষের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন এভাবেই স্বপ্নভঙ্গে পরিনত হয়।

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, বাণিজ্য ও সমাজবাস্তবতায় আজ ভারতীয় আধিপত্যবাদের থাবায় বিপর্যস্ত। ভারতের পানি আগ্রাসনে দেশের উত্তর-পশ্চিমের ৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবীকা, পরিবেশ, প্রকৃতি, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। গঙ্গার পানি বন্টন, তিস্তার পানি চুক্তিসহ চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর উজানে ভারতের পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিতে শুরু করেছে। গত দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর কথাবার্তা দুই পক্ষেই উচ্চারিত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগদি হচ্ছে, এ সময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রায় বিনাশুল্কের ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ও বাণিজ্যিক করিডোর পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করে ভারতীয় ভূখ- থেকে সেভেন সির্স্টাস অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব অঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারতের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল, তা এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ভারতকে সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ তার বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৪বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেখানে ভারতে বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল রফতানি পণ্য পাট ও পাটজাত পণ্যের উপর অনৈতিকভাবে এন্টি-ডাম্পিং ট্যাক্স বসিয়ে তা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের বন্ধু সরকার তাদের জন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েও দেশের স্বার্থে কিছুই আদায় করতে পারেনি। বর্তমান সরকারের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ককে অনেকটা বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী গর্ভনর লর্ড ওয়েলেসলির প্রবর্তিত অধীনতামূলক মিত্রতার নীতির সাথে সাজুয্য লক্ষ্য করা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা হচ্ছে, জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভারতের সাথে কার্যত একটি ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’র সম্পর্কে জড়িয়েছে সরকার। সেনা সমর্থিত এগারোর সময় সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের ঘোড়া কুটনীতি থেকে শুরু করে গত দেড় দশকে নানা ঘটনা পরম্পরায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের উপর ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। দশম-একাদশ নির্বাচনের আগে এরাশাদের জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে ভারতীয় কুটনীতিকদের দৌড়ঝাপ-হস্তক্ষেপ, দ্বাদশ নির্বাচনের আগে সরকারীদলের কোনো কোনো প্রার্থী নিজেকে ভারত সমর্থিত প্রার্থী বলে দাবি করতে দেখা গেছে। এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে বিদেশিদের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ভারত মূল ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব যখন একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমুলক নির্বাচন আয়োজন করতে সচেষ্ট ছিল, ভারত তখন শেখ হাসিনার অধীনে একপাক্ষিক নির্বাচনকে বৈধতা দিতে তার ভূরাজনৈতিক প্রভাবকে ব্যবহার করেছে। ভারতীয় প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং গণমানুষের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাওয়াল পিন্ডির বশ্যতা মানেনি, দিল্লীর আগ্রাসনও মানতে প্রস্তুত নয়।

প্রবল রাষ্ট্রশক্তির সাথে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রধান অস্ত্র এখন বর্জন ও বয়কটের ডাক। ‘স্বদেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’ এই পুরনো জাতীয় শ্লোগানটি এখন ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি আতঙ্কের শ্লোগানে পরিনত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের বয়ান ও এজেন্ডাগুলোর বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র প্রতিবেশিরাও ভারতের প্রভাব বলয় ভেঙ্গে স্বাধীন মনোভাব প্রকাশ করছে। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশী ডায়াসপোরা ভারতীয় পণ্যবর্জনের আন্দোলনে সক্রিয় হলে তা ভারতের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। চলমান বিশ্ববাস্তবতায় এ ধরণের বয়কটের ডাক পুরোপুরি সফল হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই আন্দোলন নিয়ে দিল্লী ও ঢাকার নিয়ন্ত্রকদের নিরবতা, মুখরতা ও অস্থিরতার অস্বাভাবিকতা আর চাপা থাকছে না। বিশ্ব যখন টেকসই উন্নয়নের কথা বলছে, দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে, ভারত তখন নিকটতম প্রতিবেশিদের সাথে সাম্প্রদায়িকতা ও আধিপত্যবাদী নীতি অনুসরণ করছে। প্রতিবেশীদের উপর ভারতের আগ্রাসি মনোভাব এবং আধিপত্যবাদী নীতির কারণে ভূরাজনৈতিক মেরুকরণে সবাই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সেই সাথে বর্জন-বয়কটের মধ্য দিয়ে ভারতের ভূরাজনীতি ও অর্থনীতি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে শুরু করেছে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গণপিটুনিকে নরমালাইজ করা নিয়ে অভিনেত্রী মেহজাবীনের পোস্ট

গণপিটুনিকে নরমালাইজ করা নিয়ে অভিনেত্রী মেহজাবীনের পোস্ট

গোয়ালন্দে গলায় ফাঁস নিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

গোয়ালন্দে গলায় ফাঁস নিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

হবিগঞ্জে ৫ সাংবাদিক নাশকতার মামলায় আসামি

হবিগঞ্জে ৫ সাংবাদিক নাশকতার মামলায় আসামি

ঢাবিতে বর্বরোচিত গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলের জানাজা শেষে পাথরঘাটায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন

ঢাবিতে বর্বরোচিত গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলের জানাজা শেষে পাথরঘাটায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন

তারাকান্দায় প্রাইভেটকার ও সিএনজির সংঘর্ষে নিহত-২

তারাকান্দায় প্রাইভেটকার ও সিএনজির সংঘর্ষে নিহত-২

রাঙামাটিতে পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি

রাঙামাটিতে পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ইউটিউব চ্যানেল হ্যাকড

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ইউটিউব চ্যানেল হ্যাকড

দৌলতপুর সীমান্তে অস্ত্র ও মাদক সহ আটক-১

দৌলতপুর সীমান্তে অস্ত্র ও মাদক সহ আটক-১

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে নিয়োগ পেলেন ড. এস এম হাসান তালুকদার

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে নিয়োগ পেলেন ড. এস এম হাসান তালুকদার

৮ উইকেট হারিয়ে চা বিরতিতে বাংলাদেশ

৮ উইকেট হারিয়ে চা বিরতিতে বাংলাদেশ

২০ কোটি সহায়তা দিয়ে এখনও বিএনপির ত্রাণ তহবিলে ৭ কোটি টাকা জমা রয়েছে : ডা. জাহিদ

২০ কোটি সহায়তা দিয়ে এখনও বিএনপির ত্রাণ তহবিলে ৭ কোটি টাকা জমা রয়েছে : ডা. জাহিদ

বায়তুল মোকাররমে তুমুল হট্টোগোল-মারামারি (ভিডিওসহ)

বায়তুল মোকাররমে তুমুল হট্টোগোল-মারামারি (ভিডিওসহ)

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ফিরোজ হোসেনকে গ্রেফতার

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ফিরোজ হোসেনকে গ্রেফতার

বান্দরবানে বিজিবির অভিযান: অস্ত্র-গোলাবারুদ, ড্রোন ও সিগন্যাল-জ্যামারসহ প্রযুক্তি সরঞ্জামাদি উদ্ধার

বান্দরবানে বিজিবির অভিযান: অস্ত্র-গোলাবারুদ, ড্রোন ও সিগন্যাল-জ্যামারসহ প্রযুক্তি সরঞ্জামাদি উদ্ধার

কেরানীগঞ্জে তিন লক্ষ জাল টাকা এবং জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামাদিসহ, গ্রেফতার ২

কেরানীগঞ্জে তিন লক্ষ জাল টাকা এবং জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামাদিসহ, গ্রেফতার ২

পলাতক আওয়ামী খতিবের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল

পলাতক আওয়ামী খতিবের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল

মাগুরায় যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

মাগুরায় যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের উপর আক্রমণ করে পালিয়ে গেলেন আওয়ামী খতিব

বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের উপর আক্রমণ করে পালিয়ে গেলেন আওয়ামী খতিব

ফলোঅনের শঙ্কায় বাংলাদেশ

ফলোঅনের শঙ্কায় বাংলাদেশ

শিক্ষক ভিন্ন ধর্মালম্বি হলেও তার সাথে ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ ও সম্মান করতে হবে -ছারছীনার পীর ছাহেব

শিক্ষক ভিন্ন ধর্মালম্বি হলেও তার সাথে ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ ও সম্মান করতে হবে -ছারছীনার পীর ছাহেব