কেএনএফের জন্ম হলো কীভাবে?

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০ এএম

গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বান্দরবানের রুমা, থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, গোলাগুলি ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রত্যেকটির সাথে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করেছে। এ ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় ৬টি মামলা করা হয়েছে। সবগুলো মামলার আসামী অজ্ঞাত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, কেএনএফ মূলত অর্থসংগ্রহ ও তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে। পাহাড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় থাকলেও ২০২২ সালের শেষ দিকে কেএনএফ-এর কথা বেশ শোনা গিয়েছিল। ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তার সামরিক প্রশিক্ষণের ভিডিও আপলোড করা ছাড়াও সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিলো। তারও আগে ফেসবুকে জানিয়েছিলো, তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে, যার নাম ‘হেড হান্টার কমান্ডো টিম’। কমান্ডো দল মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর অগাস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে এরা তার কমান্ডো। ধারণা করা হয়, তার সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা তিনশ’ থেকে চারশ’র মতো। বান্দরবানের কয়েকটি সূত্র বলছে, কেএনএফের মূল কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত ট্রায়াঙ্গল। সেখানেই জিরো পয়েন্টে তাদের অবস্থান এবং তারা বাংলাদেশের ভেতরেই সক্রিয় থেকে কাজ করে বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের ৯ উপজেলায় বসবাসকারি ৬ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবি তোলা সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নাথান বম নামে এক ব্যক্তি। সংগঠনটি মূলত বমদের মধ্য থেকেই সদস্য রিক্রুট করে। বমরা চিনভিত্তিক লাই (মিয়ানমারে চিন ও ভারতে পাওয়ি নামে পরিচিত) জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বমদের মোট জনসংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৩ জন। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ মিলিয়ে এই জনসংখ্যা কমবেশি ২৬-২৭ হাজার হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, কেএনএফ-এর শক্তি ও সমর্থন খুব একটা নেই। তবে সংগঠনটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব না দেয়ায় শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছে।

কেএনএফ যে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়েছে, তাতে একটা বিষয় পরিস্কার, সংগঠনটি বিনা বাধায় দিনের পর দিন প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে সংগঠিত করেছে। পাহাড়ে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সংগঠনটির কর্মকা- অজানা থাকার কথা নয়। এই জানার মধ্যেও তারা সংগঠিত হয়েছে এবং বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে তাদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে বীরদর্পে চলেও গেছে। সংগতকারণেই প্রশ্ন আসে, তাহলে পাহাড়ে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কি করে? তারা কি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে? যদি করত, তাহলে এই সংগঠনের জন্মই হতো না। জন্ম হলেও অঙ্কুরেই নির্মূল করা যেত। মাত্র দুই বছরের মধ্যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যেই বেড়ে উঠেছে, তার বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে জানান দিয়েছে, তারপরও পাহাড়ের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের ঘুম ভাঙ্গেনি। এমনকি, ব্যাংক লুট, অপহরণ, গোলাগুলি ইত্যাদি ঘটনা যে ঘটাবে, এ সম্পর্কেও তাদের আগাম কোনো ধারণা না থাকা বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কেএনএফের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি লুট করে নিয়ে গেছে। এটা কিভাবে সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। হামলার সময় আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী কি করেছিল? থানচি বাজারের দুই-তিনশ’ গজের ভেতরে রয়েছে থানচি থানা, একটি বিজিবি ক্যা¤প এবং বাজারের শেষ মাথায় সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। এরকম নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে সন্ত্রাসীরা তা-ব চালিয়ে কোনো বাধা ছাড়াই চলে গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা বলয় এমনভাবে গঠিত যে, কোনো গোষ্ঠী কোনো এলাকায় এসে হামলা চালাতে পারে, তবে তার ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফিরতি পথে কোথাও না কোথাও ধরা পড়তেই হবে। কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পর বিনাবাধায় তাদের ফিরে যাওয়া পাহাড়ের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা এটাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার শৈথিল্য হিসেবে অভিহিত করার পাশাপাশি আর্মি, বিজিবি’র প্রতিও আঙ্গুল তুলেছেন। পাহাড়ের বিভিন্ন মনোরম এলাকায় তারা বিভিন্ন রিসোর্ট গড়ে তাদের সুবিধাদি নিশ্চিত করলেও পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাদের শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেএনএফ যে লুটপাট, হামলা, অপহরণ করেছে, তার আগাম তথ্য নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে না থাকা অস্বাভাবিক। তাহলে, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা কি করছে? অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল সন্ত্রাসী নির্বিঘেœ এসে সব তছনছ করে দিয়ে বিনাবাধায় চলে যাওয়া পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অকার্যকর প্রমাণ করে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে সেনাবাহিনীর পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তার দায়িত্ব যুদ্ধ না থাকলে অন্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকা। পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার। এর মধ্যে কিভাবে কেএনফের মতো সন্ত্রাসী সংগঠন জন্ম নেয় ও বেড়ে উঠে? এর অর্থ হচ্ছে, সেখানে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না।

কেএনএফের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনতিবিলম্বে যৌথ অভিযান শুরু করবে বলে গতকাল সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল বান্দরবানে গিয়েছেন। ঘটনা ঘটার পর অভিযান চালানো কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আগাম অভিযান পরিচালনা করলে ঘটনা ঘটার শঙ্কা থাকে না। ‘দেখি না কি হয়’ নীতি অবলম্বন করতে করতে অপরাধী যদি পালিয়ে যায়, তখন সম্পদ ও সম্মান দুটোই খোয়া যায়। কেএনফের হামলার ঘটনা এবং তার বিনাবাধায় চলে যাওয়ার ঘটনা তদ্রুপ। আর্মি, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করা। দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ষা ও নিরাপদ করা। এখন আর্মিকে কোনো যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। সে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজসহ অন্যান্য কাজে বেশি ব্যস্ত। পাহাড়ি এলাকায়ও তাদের প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে তার ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। এর মধ্যে কেএনএফের মতো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের হামলা এবং তা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকা বাহিনীর মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেছে। আমরা মনে করি, দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কেএনএফসহ পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কেএনএফ কাদের মদদে গড়ে উঠেছে, অস্ত্র ও ট্রেনিং কারা দিচ্ছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। এর সঙ্গে চীনের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা স্পষ্ট। তবে পশ্চিমাদের সম্পর্ক থাকতে পারে। তারা এই অঞ্চলে একটি খ্রীস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। উল্লেখ্য করা আবশ্যক, পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর প্রভৃতি রাজ্যের উপজাতির প্রায় শতভাগ খ্রীস্টান হয়ে গেছে। কেএনএফের উৎস বম জনগোষ্ঠীও খ্রীস্টান হয়ে গেছে। এটা পশ্চিমাদের খেলার অংশ কিনা, তা খুঁজে বের করতে হবে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট দেশ বা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সেটা করতে হবে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দমনে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কাল

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কাল

জনগন লুটেরা দূর্নীতিগ্রস্হদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না : আমিনুল হক

জনগন লুটেরা দূর্নীতিগ্রস্হদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না : আমিনুল হক

কসবায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুল শিক্ষক নিহত

কসবায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুল শিক্ষক নিহত

হাজীদের গ্রহণে সউদী সরকার সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে

হাজীদের গ্রহণে সউদী সরকার সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে

কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক কবি রকিবুল হাছান

কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক কবি রকিবুল হাছান

আখাউড়ায় ১২০০ শিক্ষার্থী পেলো মোনালিসা ন্যাপকিন

আখাউড়ায় ১২০০ শিক্ষার্থী পেলো মোনালিসা ন্যাপকিন

১১২ উপজেলায় ১ হাজার ৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

১১২ উপজেলায় ১ হাজার ৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

নাসিরনগরে প্রশিক্ষণ, আখাউড়া ও কসবার আচরণবিধির আলোচনায় হুশিয়ারি

নাসিরনগরে প্রশিক্ষণ, আখাউড়া ও কসবার আচরণবিধির আলোচনায় হুশিয়ারি

কুষ্টিয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

কুষ্টিয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

আত্মা ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে থাকা প্রসঙ্গে।

আত্মা ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে থাকা প্রসঙ্গে।

ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন

ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন

বগুড়ায় শজিমেকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের  কমিটি গঠন

বগুড়ায় শজিমেকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন

মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, আট প্রার্থীর মানোনয়ন পত্র জমা

মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, আট প্রার্থীর মানোনয়ন পত্র জমা

বজ্রপাতে কুমিল্লায় ৪ জনের মৃত্যু

বজ্রপাতে কুমিল্লায় ৪ জনের মৃত্যু

টানা অষ্টম দফায় কমলো সোনার দাম

টানা অষ্টম দফায় কমলো সোনার দাম

কাপ্তাইয়ে ঝড় হাওয়ায় সিএনজির উপর গাছ পড়ে আহত: ৩

কাপ্তাইয়ে ঝড় হাওয়ায় সিএনজির উপর গাছ পড়ে আহত: ৩

শীতল পানি বিতরন

শীতল পানি বিতরন

আলমাতিতে মন্ত্রী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যা কাজাখস্তানে বিদ্যমান পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝড়

আলমাতিতে মন্ত্রী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যা কাজাখস্তানে বিদ্যমান পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝড়

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রবাসী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রবাসী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট

চিরিরবন্দরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু

চিরিরবন্দরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু