মূল্যস্ফীতিই অর্থনীতিতে বড় সমস্যা
২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম
দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমছে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে বড় পতন হয়েছে। এ সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ দশমিক ২০ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ছিল ১০ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যা ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
গত ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে দেশ। বিবিএস এর তথ্যমতে গত মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ০.১৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৩ সালের মার্চে যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, এ বছরের মার্চে তা ১০৯ টাকা ৮১ পয়সায় কিনতে হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মার্চে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ ও ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলগুলোতে উচ্চতর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়েছে। শহর এলাকায় মুদ্রাস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। মার্চে শহর এলাকায় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। এটি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদের হার বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কৌশল বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশে। কিন্তু বিলম্বে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই পদক্ষেপগুলো এখনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব দেখাতে পারেনি। এদিকে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণের প্রবাহ কমে গেছে, যার সসামগ্রিক প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতেও। মুদ্রাস্ফীতি দুই অংকের দিকে যাওয়া এবং কোয়ার্টারলি জিডিপি প্রবৃদ্ধি বছরের ব্যবধানে প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের ওপর বাড়ছে চাপ। সেইসঙ্গে সামনে আরও কঠিন সময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আবারো সংশোধন করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ করেছে। আইএমএফের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, নি¤œ রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং শিল্প বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাসসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ও স্থানীয় চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে দেয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করেছিল, যা এখন সংশোধন করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ করেছে। যদিও চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে।এদিকে আরেক উন্নয়ন-সহযোগী বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এটি কোভিড-১৯ সময়কার গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে কম। এর মধ্যে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক উভয়ই প্রবৃদ্ধি অর্জনে এক নাম্বার চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে। এতে দেখা যায়, জনগণের আয়ের সুযোগ কমছে ও নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ক্রমাগত ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও হ্রাস পাচ্ছে। দ্রব্য ও সেবা খাতের উচ্চমূল্যে মানুষ হিমসিম খাচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে ভোজ্য তেলসহ অনেক পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সামগ্রিক পতনের পেছনে দেখা যায়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, আমদানি বিধিনিষেধ এবং দুর্দশাগ্রস্ত আর্থিক খাত এই তিনটিই প্রধান কারণ। আগামীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে আমদানি আরও কঠিন হয়ে পড়লে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি আরো কমে যেতে পারে। যন্ত্রপাতি আমদানি করতে না পারলে উৎপাদনের গতি ধরে রাখা কঠিন হবে। এই মুহূর্তে দেশের উৎপাদন খাত রপ্তানিমুখী এবং অভ্যন্তরীণ-উভয়মুখী। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় চাহিদার অভাবে দেশীয় বাজারে উৎপাদন কমেছে। এক কথায় বলা যায়, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, কম বিনিয়োগ এবং আমদানি বিধিনিষেধ দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে উৎপাদন ও সেবা খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণে আমদানি সীমিত করতে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিক না হওয়ায় এ ধরনের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ভালো ঋণগ্রহীতারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পান না। পরিবর্তে, ঋণখেলাপিরা ঠিকই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছেন। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শ্লথগতির পেছনে বাইরের কারণের চেয়ে দেশীয় কারণই বেশি দায়ী বলে মনে করেন বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ। তবে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে শিপিং খরচসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়বে। এই উত্তেজনা কতদিন থাকবে তার ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করছে। এই মুহূর্তে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে এবং বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে ডলার সংকট পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তৃতীয় প্রান্তিকেও একই চিত্র থাকবে। আর এতে শিল্পখাতই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে। ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের খাতভিত্তিক তথ্য থেকে তা দেখা যায়, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণেই শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি কমছে। খুব দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সমাধান না হলে ভবিষ্যতে শিল্পোৎপাদন আরো কমে আসবে এবং শিল্পখাতের উপর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হারের পেছনে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা এবং নিয়মিত পণ্যের দাম বৃদ্ধিকে প্রাথমিকভাবে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এই ক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রবৃদ্ধির সংকোচন মেনে নিয়ে হলেও মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সেদিকে নজর দেয়া দরকার।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এখন জনগণ বিশ্ব দরবারে মর্যাদা নিয়ে চলতে পারে : প্রধানমন্ত্রী
শিগগিরই উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ শুরু হবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
‘প্রবাসী আতঙ্ক’ই আঘাত হানছে ভারত-চীনের অর্থনীতিতে: বাইডেন
৩০ বছর বাদে সোজা হলেন বিশ্বের কোঁচকানো ব্যাক্তি
মার্কিন ও ব্রিটিশ ১৫ ব্যক্তি ও ১০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ইরানের
কালীগঞ্জে বিএনপির পক্ষ থেকে ছাতা পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশে ক্যাস্পারস্কি’র নতুন ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট লাইন ‘ক্যাস্পারস্কি নেক্সট’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে মোবাইল ফোন ও মোটর সাইকেল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ
অতি ডান-অতি বামের কথা বলে শেখ হাসিনা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়: প্রিন্স
জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কাল
জনগন লুটেরা দূর্নীতিগ্রস্হদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না : আমিনুল হক
কসবায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুল শিক্ষক নিহত
হাজীদের গ্রহণে সউদী সরকার সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে
কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক কবি রকিবুল হাছান
আখাউড়ায় ১২০০ শিক্ষার্থী পেলো মোনালিসা ন্যাপকিন
১১২ উপজেলায় ১ হাজার ৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল
নাসিরনগরে প্রশিক্ষণ, আখাউড়া ও কসবার আচরণবিধির আলোচনায় হুশিয়ারি
কুষ্টিয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
আত্মা ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে থাকা প্রসঙ্গে।
ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন