সেনাপ্রধান এসএম শফিউদ্দিন আহমেদের প্রশংসনীয় বক্তব্য

Daily Inqilab ইনকিলাব

২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম

সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে স¤পর্ক নিয়ে যা করা প্রয়োজন, তা অবশ্যই করা হবে। তবে দেশটির সামরিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, দেশটির সামরিক নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই এক বন্ধুকে খুশি করতে গিয়ে আরেকজনের বিরাগভাজন হতে পারি না। এ বাস্তবতা বুঝে যেটা ভালো, আমরা সেটাই করছি। গত বৃহ¯পতিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে ‘ডিফেন্স ডিপ্লোম্যাসি : স্ট্র্যাটেজি ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সেনাপ্রধান এ কথা বলেছেন। সভাপতিত্ব করেন বিআইআইএসএস চেয়ারম্যান এএফএম গওসোল আযম সরকার। স্বাগত বক্তব্য দেন ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আবু বকর সিদ্দিক খান। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেমিনারে সামরিক কূটনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে চারটি বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। মুক্ত আলোচনায় কেউ কেউ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স¤পর্ক জোরদারের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করে সেনাপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে সেনাপ্রধান মিয়ানমারের জেনারেলদের সঙ্গে স¤পর্ক জোরদারে বাস্তব সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সামরিক কূটনীতি শুধু সামরিক বিষয়ের ওপর সীমাবদ্ধ নয়। সামরিক কূটনীতি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয়ও নয়। রাষ্ট্রের সব অঙ্গ একসঙ্গে কাজ করবে। কীভাবে এ সহযোগিতা হতে পারে, সেটাই হলো চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামরিক কূটনীতি চলে। তিনি বলেছেন, সামরিক বাহিনীর কাজ শুধু যুদ্ধ করা নয়; বরং জাতীয় স্বার্থরক্ষায় কীভাবে যুদ্ধ পরিহার করা যায়, সেটাও দেখা সামরিক বাহিনীর কাজ। আজ যারা বন্ধু, কাল তারা বন্ধু থাকবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের কূটনীতি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ তিনি সামরিক বাহিনীর পাঁচটি দায়িত্বের উল্লেখ করে বলেছেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের সর্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় জাতিগঠনে দায়িত্ব পালন। তৃতীয়ত, বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় দুর্যোগ মোকাবিলা করা। দুর্যোগ মোকাবিলা শুধু দেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরেও করা যায়। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, তুরস্কে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করেছে। চতুর্থত, বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এই কাজ করছে। পঞ্চমত, বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এটা শুধু শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে নয়, কাতারে পাঁচ হাজারের বেশি লোক পাঠিয়ে এই কাজ সেনাবাহিনী করেছে। এটা শুধু সেনাবাহিনীর লোক নয়, বরং পুলিশ ও বেসামরিক লোকও পাঠানো হয়েছে।

সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদের এ বক্তব্য অত্যন্ত মূল্যবান, সময়োপযোগী এবং দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে দেশের সেনাপ্রধানদের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য খুব কম পাওয়া গেছে। সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য কি, মোটাদাগে তার একটা ধারণা দেশের মানুষ পেয়েছে। তিনি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- আমাদের এ পররাষ্ট্রনীতি উল্লেখ ও উপজীব্য করে যে কথাগুলো বলেছেন, তা সর্বজনীন। আমরা জানি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ চলছে। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হয়ে দেশটি ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত। প্রতিবেশী ভারত তার সেভেন সিস্টার নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করছে। এসব পরিস্থিতিতে দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক কূটনীতি কি হতে পারে, তার আভাস সেনাপ্রধানের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। অত্যন্ত সুসংহত, ভারসাম্যমূলক ও যৌক্তিক কথা বলেছেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমাদের সরকার তুলনামূলকভাবে ভারতের প্রতি বেশি ঝুঁকে রয়েছে যেখানে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সে’র ঘাটতি রয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সম্পর্কটি ‘একতরফা’ এবং শুধুই ভারতের পক্ষে। ভারতের সাথে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ, পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, সীমান্তে প্রতিনিয়ত পাখির মতো বাংলাদেশিদের হত্যা, নির্যাতন ও তুলে নিয়ে যাওয়া, ট্রানজিটের নামে করিডোর দেওয়াসহ ভারতের সব চাওয়া পূরণ করা, বিনিময়ে কিছুই না পাওয়ার কারণে সম্পর্কের ভারসাম্য বলতে কিছু নেই। এমন প্রেক্ষিতে, সেনাপ্রধানের সামরিক কূটনীতির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সর্বজনগ্রহণযোগ্য। যদিও সীমান্তে যথাযথভাবে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বিজিবির সক্ষ্যমতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে যেভাবে মানুষকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং গুলি করে, তা বিজিবিকে প্রতিহত করতে দেখা যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আগের সেই একক আধিপত্য নেই। অন্যদিকে, চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশগুলো বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠেছে। চীন আমাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু। আমাদের বৃহৎ উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিনের ঘটনা প্রবাহে তা প্রমাণিত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আমাদের কাছ থেকে নিজেদের ষোলআনা বুঝে নেয়ার নীতি নিয়ে চলে। সাম্প্রতিক সময়ে পাবর্ত্য এলাকায় যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কেএনএফ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের স্বার্থ থাকতে পারে। তাদের পরোক্ষ মদত রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তারা মনে করেন, পশ্চিমারা অনেকদিন ধরেই পাবর্ত্য এলাকায় একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এটি পার্বত্য এলাকাকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তবে আমাদের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী যৌথভাবে কুকি-চীন বা কেএনএফ-কে দমন ও উচ্ছেদে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অখ-তা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সামরিক বাহিনী অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রয়েছে। এমনকি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষায় কাজ করে প্রশংসা অর্জন করছে। অবশ্য পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সামরিক বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘লাক্সারিয়াস লাইফ’ যাপনের প্রবণতা ও মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হতে পারে। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য আসা অসম্ভব কিছু নয়।

সেনাপ্রধান এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ এমন সময়ে তার আলোচ্য বক্তব্য রেখেছেন, যখন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ‘ভারসাম্যে’ ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল তত্ত্ব বা কথাই তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে এ নীতির প্রতিফলন হওয়া বাঞ্চনীয়। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রী স্বার্থ ও জনকল্যাণই সার্বোচ্চ প্রাধান্য দাবি করে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ানুগ বক্তব্য রাখার জন্য আমরা সেনাপ্রধানকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে তিনি সেনাবাহিনীর পেশাগত উন্নয়নসহ তার বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটাতে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করি। তিনি তাঁর কাজের জন্য গর্বিত হবেন এবং জনগণ তাকে স্মরণ করবে, আমরা এটাই প্রত্যাশা করি।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে মোবাইল ফোন ও মোটর সাইকেল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে মোবাইল ফোন ও মোটর সাইকেল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ

অতি ডান-অতি বামের কথা বলে শেখ হাসিনা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়: প্রিন্স

অতি ডান-অতি বামের কথা বলে শেখ হাসিনা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়: প্রিন্স

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কাল

জড়িতদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কাল

জনগন লুটেরা দূর্নীতিগ্রস্হদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না : আমিনুল হক

জনগন লুটেরা দূর্নীতিগ্রস্হদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না : আমিনুল হক

কসবায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুল শিক্ষক নিহত

কসবায় ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুল শিক্ষক নিহত

হাজীদের গ্রহণে সউদী সরকার সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে

হাজীদের গ্রহণে সউদী সরকার সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে

কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক কবি রকিবুল হাছান

কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক কবি রকিবুল হাছান

আখাউড়ায় ১২০০ শিক্ষার্থী পেলো মোনালিসা ন্যাপকিন

আখাউড়ায় ১২০০ শিক্ষার্থী পেলো মোনালিসা ন্যাপকিন

১১২ উপজেলায় ১ হাজার ৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

১১২ উপজেলায় ১ হাজার ৫৮৮ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল

নাসিরনগরে প্রশিক্ষণ, আখাউড়া ও কসবার আচরণবিধির আলোচনায় হুশিয়ারি

নাসিরনগরে প্রশিক্ষণ, আখাউড়া ও কসবার আচরণবিধির আলোচনায় হুশিয়ারি

কুষ্টিয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

কুষ্টিয়ায় পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

আত্মা ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে থাকা প্রসঙ্গে।

আত্মা ইল্লিয়্যিন বা সিজ্জিনে থাকা প্রসঙ্গে।

ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন

ইউসিবিএলের সাবেক এমডি শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন

বগুড়ায় শজিমেকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের  কমিটি গঠন

বগুড়ায় শজিমেকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন

মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, আট প্রার্থীর মানোনয়ন পত্র জমা

মোরেলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে, আট প্রার্থীর মানোনয়ন পত্র জমা

বজ্রপাতে কুমিল্লায় ৪ জনের মৃত্যু

বজ্রপাতে কুমিল্লায় ৪ জনের মৃত্যু

টানা অষ্টম দফায় কমলো সোনার দাম

টানা অষ্টম দফায় কমলো সোনার দাম

কাপ্তাইয়ে ঝড় হাওয়ায় সিএনজির উপর গাছ পড়ে আহত: ৩

কাপ্তাইয়ে ঝড় হাওয়ায় সিএনজির উপর গাছ পড়ে আহত: ৩

শীতল পানি বিতরন

শীতল পানি বিতরন

আলমাতিতে মন্ত্রী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যা কাজাখস্তানে বিদ্যমান পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝড়

আলমাতিতে মন্ত্রী কর্তৃক স্ত্রীকে হত্যা কাজাখস্তানে বিদ্যমান পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঝড়