আত্রাই নদীর অস্তিত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে
২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম
বাংলাদেশে নদীর অন্ত নেই। নদীগুলোই তার প্রাণ। নদীগুলো জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে। প্রতিটি নদীর দু’পাশেই গড়ে উঠেছে হাট, বাজার, নগর ও বন্দর। প্রতিটি নদীই নির্দিষ্ট অঞ্চলে তার অবদান রাখছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০টি নদনদী বিপুল পানিরাশি নিয়ে ২২,১৫৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের নদনদীর সংখ্যা ছিল ৩১০টি।
দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর মধ্যে আত্রাই অন্যতম। মহাভারত ও দেবীপুরাণে বর্ণিত পবিত্র নদীগুলোর মধ্যে একটি হলো আত্রাই। আত্রাই নদী ভারত-বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪০ মাইল (৩৯০ কিলোমিটার), যার বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ২৬৯ কিলোমিটার এবং ভারতের অংশের দৈর্ঘ্য ১২১ কিলোমিটার।
ভারতের হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উৎপত্তি এ নদী। এরপর নদীটি ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদী বাংলাদেশ অংশে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট, পতœীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা ও আত্রাই উপজেলা হয়ে নাটোরের সিংড়া উপজেলা দিয়ে চলনবিলে পতিত হয়েছে। এরপর পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি পুনরায় পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার ৬ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বাঘাবাড়ীর কাছে যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে।
আত্রাই-এর কয়েকটি উপনদীর মধ্যে পুনর্ভবা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ডান তীরে ফকিরনী (বর্তমান নাম রানী নদী) ও বড়াল নদী এবং বাম তীরে করতোয়া অন্যতম। বৃহত্তর রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে আত্রাই-এর অন্য উপনদীসমূহ হচ্ছে: তুলসীগঙ্গা, নন্দকুয়া, বরানাই এবং বড়াল।
আত্রাই নদীতে একসময় ঢেউয়ের তালে তালে চলাচল করেছে অসংখ্য পালতোলা নৌকা। ভাটিয়ালী আর পল্লী গানের সুরে মাঝিরা নৌকা নিয়ে ছুটে গেছে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ব্যবসা কেন্দ্রগুলোতে। নৌকায় নানা কৃষিপণ্য নিয়ে সওদাগররা (ব্যবসায়ীরা) ছুটে চলত। নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল অনেক হাট-বাজার। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাট ও বাজার হচ্ছে: আমাইতারা, রাঙ্গামাটি, মহাদেবপুর, পাঠাকাটা, প্রসাদপুর, জোতবাজার, পাঁজরভাঙ্গা, জোকাহাট, পলাশবাড়ী, মিঠাপুর, বান্দাইখাড়া, শুটকিগাছা, আহসানগঞ্জ, কাশিবাড়ী, সমসপাড়া, সিংড়া, বিলদহর, মির্জাপুর, বাঘাবাড়ী ইত্যাদি। শুধু হাট-বাজারই নয়, এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য নগর ও বন্দর। মাইলের পর মাইল জুড়ে সে কী এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! বর্তমানে কৃষি জমিগুলো পরিণত হয়েছে ধু ধু প্রান্তরে। অফুরন্ত মাছের উৎস ছিল এ নদী। জীবিকার জন্য জেলেরা রাত-দিন সমানে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে মাছ ধরত। জেলেপাড়াগুলোও এখন প্রায় বিলীন। নদী গবেষকদের মতে, নদী কখনো একা মরে না। নদীর মৃত্যু হলে পাড়ের জনপদও একটু একটু করে মরতে শুরু করে। বাস্তবে আত্রাই নদী ও এর অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনপদ দেখলে বুঝা যায়, কথাটি কতটা সত্য।
জোতবাজার বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি মো. আহসান আলী মোল্লাহ জানান, বেশি দিন আগের কথা নয়, আশির দশকের শুরুতেও এ নদীতে নিয়মিত লঞ্চ চলাচল করতো, যা জেলা শহর নওগাঁর সংগে অত্র অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ধরা হতো। জোতবাজার শুধু হাটই ছিল না, এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও পাইকারী বাজার। তিনি আরো জানান, জোতবাজার ছিলো পাটের বাজার। এ বাজারে হাজার হাজার মণ পাট কেনাবেচা হতো। সেসময় জোতবাজারে বড় বড় পাটের গুদাম গড়ে উঠেছিল। নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় বড় পাল তোলা নৌকা আসতো জোতবাজারে। কোনটি ছিল ১০০০ মণ, কোনটি ছিল ১২০০ মণ বা তারও বেশি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন। বৃটিশরা এ বাজারের নামকরণ করেছিল জুটবাজার অর্থাৎ পাটের বাজার। ধীরে ধীরে এটি পরিবর্তিত হয়ে নতুন হয়েছে জোতবাজার।
কালের বিবর্তনে আত্রাই নদীতে পলি পড়ে নাব্য হ্রাস পেয়েছে। এই হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনের কারণে নদীটি ক্রমাগত তার গতিপথ পরিবর্তন করছে। স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নদীটি খনন করা জরুরি। এই নদী খননের ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতাও বাড়বে, কৃষকরা নদীর পানি ব্যবহার করে সেচকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। এছাড়াও নৌপথ পুনরায় চালু হবে। একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে তার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর এ যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু সড়ক পথ বা রেল পথের উন্নতি করা নয়, জোরালোভাবে প্রয়োজন নদীপথের সংস্কার তথা নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। নদী পথের অনেক সুবিধা। যেমন, নদী পথের পরিবহন খরচ কম, নদী সংস্কার খরচ সড়ক বা রেল পথের তুলনায় কম, এছাড়াও পরিবহনকালীন মালের ক্ষতি হওয়ার সুযোগ কম থাকে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্রাই নদীর উৎসের অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, ভারতের অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার, পলি জমে তলদেশ ভরাট, ইরিগেশনের সময় ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারসহ জলবায়ুর পরিবর্তন নদীটির অস্তিত্ব সংকটের প্রধান কারণ। তারা আরও বলেন, জরুরি ভিত্তিতে তলদেশ ড্রেজিং, রাবার ড্রাম তৈরি করে পানি সংরক্ষণ ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে দিলে অন্যান্য নদ-নদীর মতো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে না নদীটি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে নদীর স্তরের একটা সংযোগ রয়েছে। কোনো কোনো সময় ভূগর্ভস্থ পানি নদীতে আবার নদী থেকে পানি ভূগর্ভস্থ স্তরে রিচার্জ হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অনাবৃষ্টির কারণে প্রকৃতির এসব স্বাভাবিক কাজে বিঘœ ঘটছে।
এছাড়াও সরকারের সঠিক নজরদারি না থাকার সুযোগে এক শ্রেণির দখলবাজ নদীটির অনেকস্থান দখলে নিয়ে খুশিমতো ভরাট করে দিচ্ছে। অনেকে আবার বর্জ্য ফেলে দূষণ ও ভরাট অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে চলছে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন ও পাড় কেটে মাটি বিক্রির প্রতিযোগিতা। এতে হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে নদীটির অস্তিত্ব। অচিরেই ব্যবস্থা নেয়া না হলে মানচিত্র থেকে মুছে যাবে এক সময়ের খর¯্রােতা এই নদী। হুমকির মুখে পড়বে এলাকার জীববৈচিত্র্য।
বর্তমান সরকার নদীবান্ধব সরকার। নদী রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৪টি জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সব নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর সহায়তায় আত্রাই নদীর মান্দা অংশ ছাড়া অন্যান্য অংশে খনন ও সংস্কার কাজ কিছুটা হলেও সম্পন্ন হয়েছে। নদীটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংস্কারসহ খননের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল এন্ড কলেজ, জাহাংগীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সীমান্তে দু'দিনে স্থল মাইন বিস্ফোরণে ২ সহোদরসহ ৫ জন আহত, ২ জনের পা বিচ্ছিন্ন
নারাইন নৈপুণ্যে লাক্ষ্মৌর বিপক্ষে বড় জয়ে শীর্ষে কলকাতা
লিভারপুলের বিপক্ষে হেরে অস্বস্তিতে টটেনহ্যাম
অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি
ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী
লক্ষ্যটা নাগালেই রাখল বাংলাদেশ
ইসলামী শিক্ষা নিয়ে যে কোন দূরভিসন্ধি রুখে দিতে হবে পীর সাহেব চরমোনাই
জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে: কুষ্টিয়ায় হানিফ
উখিয়া ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবককে জবাই করে হত্যা
ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী কারিকুলাম প্রত্যাখ্যান করুন
শাহজালালে তিনদিন ৩ ঘণ্টা করে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ
মুস্তাফিজকে ছাড়াই চেন্নাইয়ের বড় জয়
সুদহার শিগগিরই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে: গভর্নর
মোদির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উপজীব্য ভোট জিহাদ, তারপর কী?
‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন করলো এনার্জিপ্যাক
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর শরি‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটির ৪৪তম সভা অনুষ্ঠিত
দুই দিনে সোনার দাম বাড়ল ১৭৮৫ টাকা
এসআই পদে বয়সসীমা ৩০ করা হোক
ইউরোপীয় রাজনীতিতে শরণার্থী প্রসঙ্গ
হিন্দুত্ববাদের কবলে আমাদের পাঠ্যবই