দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যেন আইওয়াশ না হয়

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম

গত এক দশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি, টেবিলটক, বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট পর্যালোচনা কম হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নির্দেশনাসহ জিরো টলারেন্সের বার্তাও দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এসবের পরও দুর্নীতি হ্রাস কিংবা বন্ধের কোনো আলামত দেখা যায়নি। দেশি-বিদেশি চাপে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানগুলো ছিল অনেকটা দায়সারা, আইওয়াশ। দুর্নীতি দমন কমিশনকে চুনোপুটি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তবে এবার উচ্চ মহলের কতিপয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শেকড়ে টান পড়তে শুরু করেছে। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজির আহমেদ, সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ, পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মািতউর রহমান, কাজী আবু ফয়সালসহ একে একে সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের চিত্র বেরিয়ে আসার পর দুর্নীতি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। সরকারি অফিস এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে প্রতিদিনই বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। এহেন বাস্তবতায় পুলিশের মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ব্যক্তির দুর্নীতির দায় বাহিনী নেবে না। একইভাবে মন্ত্রী পরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, দুর্নীতি করে কিছু ব্যক্তি বদনাম হয় সবার। সেই সাথে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগত কাঠামোর দুর্বলতা ও দীর্ঘসুত্রিতার প্রসঙ্গও মন্ত্রী পরিষদ সচিবের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এ কথা সত্য যে, প্রতিষ্ঠানগুলোর সকলে বা বেশিরভাগ কর্মকর্তা দুর্নীতির সাথে যুক্ত না হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতি, বদনাম ও দায় বহন করতে হচ্ছে। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ ভূমিকার মাধ্যমেই এ থেকে উত্তরণ সম্ভব।

গত দেড় দশকে বেশুমার অর্থ পাচার হয়ে গেছে। প্রতি বছর অন্তত ১লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতির কারণ বহুমাত্রিক এবং প্রধান কারণগুলোর সাথে অন্যগুলো নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। বিশেষত সরকারি নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে মেধা, দক্ষতা, জেষ্ঠ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনা, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা ও ঘুষের সম্পর্কের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব দেখা যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে সর্বত্র ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দলবাজ কর্মকর্তাদের দাপুটে ভূমিকা প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা চরমভাবে ব্যহত করেছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসায় দুর্নীতি এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। জেনারেল আজিজ আহমেদ কিংবা বেনজির আহমেদ দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদে আসীন হয়ে যে সব বেআইনী ও অনৈতিক কর্মকান্ড করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তা, এতদিন প্রকাশ না হওয়া কিংবা তাদেরকে বিরত রাখতে না পারাও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। আইন সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। দুর্নীতি দমন কমিশন, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাজই হচ্ছে রাষ্ট্রের সম্পদ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারের সংশ্লিষ্টরা এখন যা’ই বলুন, নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির লঙ্ঘণের দায় রাষ্ট্র ও সরকার এড়াতে পারেনা। দুর্নীতিবাজদের বল্গাহীন লুটপাট ও অর্থপাচারের কারণে দেশের অর্থনীতি এখন দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। দুর্নীতিমূলক নিয়োগ ও পদায়ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের শৃঙ্খলা, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং চেইন অব কমান্ডেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ ও এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে সব রিপোর্ট বেরিয়ে এসেছে তা দুর্নীতির পুরো দৃশ্যপটের অংশমাত্র। সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে, তা চলবে। তবে কতদিন চলবে, কতদূর এগোবে, কে কে শাস্তি ও জবাবদিহিতার আওতায় আসবে, তা নিশ্চিত করা বলা যাচ্ছে না। পুলিশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংকিং সেক্টরসহ সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতির মূল ভুক্তভোগী দেশের জনগণ। গত দেড় দশকে একদিকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে অন্যদিকে দেশের মানুষের উপর বৈদেশিক ঋণের বোঝা প্রায় চারগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে ২০০৮ সালে যেখানে দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২৪ সালে তা ১০০বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সিপিডির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকা। সরকারের ঋণের সুদের কিস্তি পরিশোধের চাপ এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অর্থপাচার সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, অর্থপাচার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদির কথা বলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি, কুক্ষিগত ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে চরম দুর্ভোগ থেকে দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। শুধুমাত্র গতানুগতিক অভিযান চালিয়ে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার পাশাপাশি দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের স্বচ্ছ পরিণতি দেশের মানুষের আন্তরিক প্রত্যাশা।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন; আবারও ঢাকা- রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ

রাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন; আবারও ঢাকা- রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ

কমলনগরে আওয়ামী লীগের সভাপতিকে পিটিয়ে আহত করলেন সাধারণ সম্পাদক: ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে

কমলনগরে আওয়ামী লীগের সভাপতিকে পিটিয়ে আহত করলেন সাধারণ সম্পাদক: ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে

কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেছে মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা, দেড় ঘন্টা গাড়ি চলাচল বন্ধ

কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেছে মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা, দেড় ঘন্টা গাড়ি চলাচল বন্ধ

কিশোরগঞ্জ পৌরসভার সড়কের বেহাল দশা: ভোগান্তিতে এলাকাবাসী

কিশোরগঞ্জ পৌরসভার সড়কের বেহাল দশা: ভোগান্তিতে এলাকাবাসী

শনিবার সকালে পানির স্রোতে ভুঞাপুরের ভালকুটিয়ায় একটি কাচা সড়ক ভেঙ্গে গেছে

শনিবার সকালে পানির স্রোতে ভুঞাপুরের ভালকুটিয়ায় একটি কাচা সড়ক ভেঙ্গে গেছে

ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনার ৩ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: অনেকগুলোর শ্রেণীকক্ষই ব্যবহার অনুপযোগী

ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বরগুনার ৩ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: অনেকগুলোর শ্রেণীকক্ষই ব্যবহার অনুপযোগী

অবিলম্বে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে : পরিবেশমন্ত্রী সাবের চৌধুরী

অবিলম্বে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে : পরিবেশমন্ত্রী সাবের চৌধুরী

চীন ও ভারতের উচিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে স্থিতিশীল করা: ওয়াং ই

চীন ও ভারতের উচিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে স্থিতিশীল করা: ওয়াং ই

কুড়িগ্রামে চরম দুর্ভোগে ৫ উপজেলার বানভাসি মানুষ

কুড়িগ্রামে চরম দুর্ভোগে ৫ উপজেলার বানভাসি মানুষ

সাত বছরেও শেষ হয়নি সেতুর নির্মাণ কাজ, দুর্ভোগে কয়েক লাখ মানুষ

সাত বছরেও শেষ হয়নি সেতুর নির্মাণ কাজ, দুর্ভোগে কয়েক লাখ মানুষ

বোহাই সাগরে বড় আকারের দুর্যোগ মহড়া

বোহাই সাগরে বড় আকারের দুর্যোগ মহড়া

ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.০৫ সেন্টিমিটার

ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.০৫ সেন্টিমিটার

সাটু‌রিয়ায় পল্লী বিদ‌্যুৎ কর্মকর্তা কর্মচারী‌দের কর্মবির‌তি

সাটু‌রিয়ায় পল্লী বিদ‌্যুৎ কর্মকর্তা কর্মচারী‌দের কর্মবির‌তি

পাঁচ মাসে চীনের সেবা খাতের বাণিজ্য বেড়েছে ১৬ শতাংশ

পাঁচ মাসে চীনের সেবা খাতের বাণিজ্য বেড়েছে ১৬ শতাংশ

হিংসা বিধ্বস্ত মণিপুরে এবার বন্যার প্রকোপ, ঘরছাড়া অন্তত ২০ হাজার

হিংসা বিধ্বস্ত মণিপুরে এবার বন্যার প্রকোপ, ঘরছাড়া অন্তত ২০ হাজার

মাগুরায় তীর্থ হত্যার মূল নায়ক গ্রেফতার তীর্থের মটর সাইকেল উদ্ধার

মাগুরায় তীর্থ হত্যার মূল নায়ক গ্রেফতার তীর্থের মটর সাইকেল উদ্ধার

ভারতের মুর্শিদাবাদের এক হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টায় ৭ শিশুর মৃত্যু

ভারতের মুর্শিদাবাদের এক হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টায় ৭ শিশুর মৃত্যু

চীনে নতুন গুচ্ছ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

চীনে নতুন গুচ্ছ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

ঢাকায় বাঘা পৌরসভার মেয়র ডিবির হাতে গ্রেফতার

ঢাকায় বাঘা পৌরসভার মেয়র ডিবির হাতে গ্রেফতার

ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধের আহ্বান করলেন ৪ মার্কিন সিনেটর

ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধের আহ্বান করলেন ৪ মার্কিন সিনেটর