ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত জনমুক্তির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এবারের এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে দেশের মানুষ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে মনে করছেন। অতি আবেগী কারো কারো মতে, ভারতীয় তাবেদার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান করে সত্যিকার অর্থে একাত্তুরের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যাশাকে অর্থবহ করতে ছাত্র-জনতার এই আত্মদান একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের পাকিস্তানি শাসকদের বিদায় করেছিলাম বটে, মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা, লক্ষ্য এবং প্রত্যাশা শুরুতেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সাম্য, মৈত্রী, গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন আমাদের রাজনৈতিক নেতা দেখিয়েছিলেন, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর সেই মহান নেতাই একদলীয় শাসন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ফ্যাসিবাদী চেতনার খোয়াড়ে বন্দি করেছিলেন। বলাবাহুল্য, আমাদের স্বাধীনতা পাকিস্তানীদের হাত থেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের হাতে ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। বিজয়ের প্রথম প্রহরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কসহ সব সেক্টর কমান্ডার, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের কাছে অগ্রাহ্য ও অপাঙতেয় বলে মনে হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণায় যেমন শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জনের দিনেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে বাহ্যত লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কৃতিত্বকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড অপহরণ করেছিল। পাক বাহিনীর আকস্মিক আত্মসমর্পণ করার পেছনে সিভিলিয়ান ক্যাজুয়ালটি বা বেসামরিক লোক হত্যার ঘটনা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা আত্মসমপর্ণকে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে স্বীকার করেছিলেন। পাক বাহিনীর ৯০ হাজারের বেশি সেনা সদস্যের মধ্যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার মতো শত শত সেনা কর্মকর্তা ছিল। তাদেরকে নিরাপদে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার পেছনে পাক-ভারতের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ জড়িত ছিল। বিশেষত: এর আগের এক দশকের মধ্যে ১৯৬২ সালে চীনের সাথে এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত যুদ্ধে ভারতের নাস্তানাবুদ অবস্থার কথা স্মরণ রেখে পাক সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্যকে ভারতে বন্দি ও জিম্মি করে জম্মু-কাশ্মিরে বেকায়দায় থাকা ভারতীয় বাহিনীর লাইন অব কন্ট্রোল মেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এ দেশের লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু, কোটি কোটি সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা হয়ে গেল ভারতীয় বাহিনীর হাতে পাকিস্তানিদের পরাজয়ের স্মারক। তাদের ইতিহাসে এই মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ বলেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ৯ মাসের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণের সময় ছিল এক সপ্তাহেরও কম। যুদ্ধে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নাকি বলেছিলেন, ‘হাজার সাল কা বদলা লিয়া’। তার এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ভারতের মাটিতে মুসলমানদের হাজার বছরের ইতিহাস এবং ভারতীয় হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহি:প্রকাশ ঘটেছিল। একইসাথে আধিপত্যবাদের থাবার নিচে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যতও নির্ধারিত হয়েছিল। ডিভাইড অ্যান্ড রোল নীতির আলোকে হিন্দুদের প্রতি বৃটিশদের পক্ষপাতমূলক ভ’মিকার কারনে এই বাংলায় হিন্দু জমিদারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এর আগে কখনোই এখানে হিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। একাত্তুরের স্বাধীনতার পর আধিপত্যবাদী ভারতকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছিল। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উপর ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ভারতের কাছে বেহাত হয়ে গিয়েছিল। হাসিনার লগি-বৈঠার তান্ডবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এক-এগারো সরকারের ধারাবাহিকতায় পর পর চারটি নির্বাচনে ভারতের ইচ্ছায় গণতন্ত্র হত্যা ও ফ্যাসিবাদী বয়ানের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক জনগণের উপর অত্যাচার চালুর মধ্য দিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে লুন্ঠনের ষোলকলা পূর্ণ করে একটি অকার্যকর দেউলিয়া রাষ্ট্রের পরিনত করতে শেখ হাসিনা ভারতীয় শিখ-ী ও মারাঠা বর্গীদের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন।

আমাদের স্বাধীনতা ও জাতিসত্তার মূল ইতিহাসকে বিকৃত করে একটি চাপিয়ে দেয়া, খ-িত ফ্যাসিবাদী বয়ানকে বিভাজনের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিনত করার বিষয়টি ছিল খুবই অপরিপক্ক ও অপরিনামদর্শী। দেশের সব গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, বিরোধীমতকে কঠোরভাবে দমন করে। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সবখানে মুক্তিযুদ্ধের খন্ডিত ইতিহাস, ও ভ্রান্ত চেতনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমে শেখ মুজিবের নামকে এমনভাবে বিন্যাস্ত করা হয়েছে, যেন ‘কানু বিনে কোনো গীত নাই’। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ফ্যাসিবাদের সেই অচলায়তন ভেঙ্গে সত্যিকারের স্বাধীনতার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে, সেই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, চিন্তায়, মননে, শিক্ষা- সংস্কৃতিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। এ দেশের মাটিতে ইসলামের আগমন ঘটেছিল তুর্কি, আরব, আফগানিস্তান ও ইরান থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে আসা পীর-ফকির, দরবেশদের মাধ্যমে। ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে বর্ণবাদী শোষণ-নিস্পেষণ ও সেন রাজাদের মাৎস্যন্যায়ের চরম অরাজকতা থেকে এই ভূখ- মুক্তি পেয়েছিল। নিস্পেষিত-নিপীড়িত মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদে পরিনত করেছিল। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের দোসর শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি রিজিম মুসলমানদের সেই গৌরবময় ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের শিশুদের মনোজগতে যে ইতিহাস চেতনা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল, সেখানে আরব দেশ থেকে এসে আমাদের দেশ দখলের ব্রাহ্মণ্যবাদী বয়ান শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচি থেকে ইসলামি মূল্যবোধ সম্পৃক্ত সাহিত্যকর্মগুলো বাদ দিয়ে হিন্দু ও তথাকথিত সেক্যুলারদের বিতর্কিত লেখা দিয়ে যে কারিক্যুলাম সাজানো হয়েছিল, দেশের আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষের আপত্তি-প্রতিবাদের মুখে কিছু পরিবর্তন হলেও এসব শিক্ষা কারিক্যুলাম একটি স্বাধীন দেশের বুনিয়াদি শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেনা। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের আজ্ঞাবহ ফ্যাসিবাদমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পতিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যে ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছিল, তিনি নিজেকে একজন রামকৃষ্ণ মিশন ও ইসকন মন্দিরের আদর্শিক সন্তান বলে দাবি করেছিলেন। মূলত: এই তার এই সম্পৃক্তির কারণেই শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এমন ব্যক্তিকে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর আসনে বসানো হয়েছিল। মুসলমান পরিচয়ধারি হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা খুব সহজেই দেশকে ভারতের করতলগত করে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। শিক্ষা অধিদফতর, মন্ত্রনালয় ও শিক্ষাবোর্ডগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের পদায়নের ধারাবাহিকতায় এক সময় মাদরাসা বোর্ড ও আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল হিসেবেও হিন্দুদের বসানো শুরু হয়েছিল। সাধারণভাবে আলিয়া মাদরাসায় গণিত বা বিশেষ কোনো বিষয়ে অন্য ধর্মালম্বি শিক্ষক থাকতেই পারে। কিন্তু কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক নিয়োগকে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের দেখানো পথে তাবেদার সরকার বাংলাদেশেও সে পথ অনুসরণ করেছিল। এর চেয়ে অনেক বেশি বিদ্ধংসী ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, ছাত্রলীগ থেকে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়, দলবাজি, দুর্নীতির পথ ধরে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির মধ্য দিয়ে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেশীয় চাকরি প্রার্থী তরুনদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লাখ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি নিয়ে দেশ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও অকার্যকর করার নেপথ্য কারণ সম্ভবত এটাই।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীণ সরকার জাতিকে নতুন স্বপ্নে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হচ্ছে কিনা, এমন সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি। তবে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, সমস্যাকে চিহ্নিত করার সদিচ্ছা থাকা এবং সমস্যাকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পারা। ভূরাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত ও শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার সাথে সাথে সব রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজনৈতিক-কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের আগে, প্রথম প্রতিক্রিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করে যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা ছিল ভারতের বিজেপি সরকারের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং মিয়ানমারের পশ্চিমাংশ নিরাপদ থাকবে না। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ফোনালাপে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কী করেছে, তা দেখার জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে দিল্লিতে গিয়ে মোদির আতিথ্যে নানা রকম উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম এখনো স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার হিংসাত্মক এজেন্ডা অনুসারে বাংলাদেশে হিন্দু নিগ্রহের গুজব ও অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা, সাধারণ মানুষ এবং সরকার এসব বিষয়ে সচেতন রয়েছে, তীক্ষè নজর রাখছেন। শেখ হাসিনার যুগ শেষ, এমনকি হাজার হাজার মানুষ হত্যা, গণতন্ত্র ধ্বংস, দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার এবং রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশকে দেউলিয়া ও অকার্যকর করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের লিগ্যাসিও শেষ হয়ে গেছে। ¯্রফে নিজের স্বৈরাচারি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ তুলে যে আইনে শেখ হাসিনা জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেছেন, তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ তার সব অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ করা এখন ছাত্র-জনতার অন্যতম প্রধান দাবি। পিলখানায় ৫৭জন সেনা অফিসার হত্যাকারী, রাতের অন্ধকারে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামা ও ছাত্র হত্যাকারী, ভারত ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা আয়নাঘরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আটকে রেখে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন করে হত্যার মাস্টারমাইন্ড এবং ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনে গণহত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের শাস্তি নিশ্চিত করা আমাদের ইতিহাস ও সভ্যতার অন্যতম দায়। গত ১৮ আগস্ট ঢাকায় হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সামনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে গেছেন। এটি হঠাৎ করেই ঘটেনি। দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব পথ রুদ্ধ করে, বঙ্গভবন-গণভবন থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদী দলীয়করণের মধ্য দিয়ে ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্র ধ্বংস ও মানবাধিকার হরণের ষোলকলা পূর্ণ করা হয়েছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনা বিদেশি গণমাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে। বিদ্যুত খাতের উন্নয়নের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ফোঁকলা করে তোলা হয়েছে। অযৌক্তিক-অবিশ্বাস্য উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে জনগণের পকেট থেকে বছরে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার পেছনে হাসিনা-মোদি-আদানিদের স্কাম নেক্সাস দায়ী।

ধ্বংসস্তুপের উপর নতুন সম্ভাবনার বীজ একদিন মহীরূহ রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ, পাকিস্তানিদের বৈষম্য এবং ভারতের আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ ও লুন্ঠন বাংলাদেশের মানুষের উপর শত বছর ধরে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাবোধের জন্ম দিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের হারাতে যে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, আধিপত্যবাদের পথ ধরে সেই ভারতই এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা হরণের পথ বেছে নিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশ যে নতুন স্বাধীনতা অর্জন করল, তা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য অন্যান্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, বাংলাদেশ শিখিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতা কতটা জরুরি। অন্যদিকে পাকিস্তানে রাজপথে লড়াইরত মুক্তিকামী জনগণ এখন বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের পথ অনুসরণের কথা বলছেন। কয়েক বছর আগে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায়ও একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবারতান্ত্রিক রিজিমের পতন ঘটেছিল। অনেকেই বলেছিল, বাংলাদেশে হাসিনা রেজিমের পরিনতিও শ্রীলঙ্কার মতই হবে। আদতে দেখা গেল, বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার চেয়েও প্রবল গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় শেখ হাসিনা পালাতে না পারলে, তার দোসররা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় না পেলে কী ঘটত তা ভাবলেও শিহরিত হতে হয়। জনসমর্থন ছাড়া, বিনাভোটের নির্বাচনে, গায়ের জোরে ক্ষমতা আকড়ে রেখে একটি ফ্যাসিবাদী শাসনে নিজের পিতাকে জাতির সর্বকালের সেরা মহাপুরুষ-দেবদূত বানাতে শত শত ভাস্কর্য স্থাপনের শেষ পরিনতি কেমন হতে পারে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আবার তা দেখিয়ে দিল। একজন রাজনীতিবিদ, একজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে ইস্পাতের পর্দায় ঢেকে দিয়ে নিষ্কলুষ ত্রাতা বানানোর মিথ্যা কসরত ব্যর্থ হয়েছে, হতে বাধ্য। তবে ইতিহাসের পটভ’মিতে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য মর্যাদা একদিন বুঝিয়ে দিতে হয়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রথম স্বাধীনতা ব্যর্থ করে দেয়ার যে খেসারত শেখ মুজিবকে দিতে হয়েছিল, তাকে নিষ্কলুষ মহাপুরুষ বানিয়ে স্বাধীনতার চেতনার নামে জাতিকে বিভক্ত করে তার কন্যা শেখ হাসিনার সীমাহীন অপকর্মের দায়ে শেখ মুজিবকে আবারো বিশ্বের সামনে হেয় করা হলো। সেদিন ছাত্র-জনতার রুদ্ররোষে শেখ মুজিবের ভাস্কর্যগুলো যখন হাজার মানুষের পদাঘাতে, হাতুড়ির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল, ধাতব ভাষ্কর্যের গলায় দড়ি লাগিয়ে ক্রেন-বুলডোজারে টেনে মাটিতে ফেলা হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, শেখ হাসিনা তার পিতাকে রেখে পালিয়ে গেলেন।
লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে মূল্য যারা ব্যক্তিগত খায়েশ ও খামখেয়ালে ব্যর্থতায় ঠেলে দেয়, মুক্তিকামী মানুষের দৃষ্টিতে তারা ক্ষমার অযোগ্য। আধুনিক বিশ্বের মানুষ ফরাসি বিপ্লবে বাস্তিলের পতন দেখেছে। রাশিয়ায় জারের পতন দেখেছে। ইরানে পাহলবিদের পতন দেখেছে। এসব বিপ্লবের পেছনে রাজনৈতিক শক্তির সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। এখানে পাঁচ দশক কিংবা সর্বশেষ দেড় দশকে সব রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতার পর দেশের শিক্ষার্থী ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ তাড়ানোর প্রেরণা কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মহাশক্তিতে পরিনত করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিন্দুত্ববাদী হাইব্রিড রিজিমের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা নির্মম-নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদকে সহশ্র মানুষের রক্তের আগুনে ছাই-ভস্মে পরিনত করা হয়েছে। শহীদ আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, ইয়ামিন, শান্ত, দীপ্ত, ইরফান, আসিফ, তাহমিদের মত শত শত তাজা প্রাণ স্বৈরাচারের বুলেটে ঝরে যাওয়ার এমন ইতিহাস বিশ্বে বিরল। এর আগে আয়নাঘরের অন্ধ কুঠোরিতে যাদের হত্যা করা হয়েছে। বুয়েটের মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মত যারা স্বৈরাচারের নরপিচাশ জল্লাদদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে, তারা সবাই স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ের সৈনিক। এখনো অসংখ্য শহীদ নিখোঁজ। এখনো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে-বাড়িতে বিছানায় কাতরাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ছে শহীদের সংখ্যা। তাদের রক্তের শপথ নিয়ে ছাত্র-জনতা এই স্বাধীনতা রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য ও জনমুক্তির সনদ বাস্তবায়ন করবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আন্দোলনে গুলিবর্ষণকারী নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা আ.লীগ সভাপতি খোকন কল্যানপুরে গ্রেফতার

আন্দোলনে গুলিবর্ষণকারী নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা আ.লীগ সভাপতি খোকন কল্যানপুরে গ্রেফতার

কুতুবদিয়া উপজেলাধীন লেমশীখালীতে কোস্টগার্ডর অভিযান

কুতুবদিয়া উপজেলাধীন লেমশীখালীতে কোস্টগার্ডর অভিযান

যুক্তরাজ্য বিএনপি'র সভাপতি মালেকের বাড়িতে হামলার ঘটনায় সিলেটে মামলা

যুক্তরাজ্য বিএনপি'র সভাপতি মালেকের বাড়িতে হামলার ঘটনায় সিলেটে মামলা

দুই পুলিশ সদস্যকে রিমান্ড শেষ না হতেই কারাগারে প্রেরণ

দুই পুলিশ সদস্যকে রিমান্ড শেষ না হতেই কারাগারে প্রেরণ

গেঞ্জির পেছনে নাম দেখে সনাক্ত হয় দগ্ধ কামালের লাশ

গেঞ্জির পেছনে নাম দেখে সনাক্ত হয় দগ্ধ কামালের লাশ

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে

আদানি পাওয়ার বিদ্যুতের দাম বেশি নিচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করবে বাংলাদেশ

আদানি পাওয়ার বিদ্যুতের দাম বেশি নিচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করবে বাংলাদেশ

নেত্রকোনা পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম খানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

নেত্রকোনা পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম খানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

প্রাথমিক শিক্ষার ‘এডহক’ কমিটির ১১ সদস্যের

প্রাথমিক শিক্ষার ‘এডহক’ কমিটির ১১ সদস্যের

গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে অস্থিরতা ও দীর্ঘসূত্রিতা কোনটাই কাম্য নয় -এবি পার্টি

গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে অস্থিরতা ও দীর্ঘসূত্রিতা কোনটাই কাম্য নয় -এবি পার্টি

গণমাধ্যমের সাথে আলোচনা করে কমিশন করা হবে : তথ্য উপদেষ্টা

গণমাধ্যমের সাথে আলোচনা করে কমিশন করা হবে : তথ্য উপদেষ্টা

ওরসের নাম ভাঙিয়ে কিছু কুচক্রি মহল দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন ও মাজারের পবিত্রতা বিনষ্ট করতে পারে

ওরসের নাম ভাঙিয়ে কিছু কুচক্রি মহল দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্ন ও মাজারের পবিত্রতা বিনষ্ট করতে পারে

মাওলানা হাজী ইউছুফের নামাজে জানাযা ও দাফন সম্পন্ন

মাওলানা হাজী ইউছুফের নামাজে জানাযা ও দাফন সম্পন্ন

গোবিন্দগঞ্জে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার

গোবিন্দগঞ্জে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হলে পড়াশুনার ব্যাপক মানোন্নয়ন হবে: অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হলে পড়াশুনার ব্যাপক মানোন্নয়ন হবে: অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী

মাগুরা ও কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কমিটি বাতিল

মাগুরা ও কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কমিটি বাতিল

বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্যের পদত্যাগ

বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সকল সদস্যের পদত্যাগ

রাজবাড়ীতে বিএনপির সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের প্রতিবাদ সভায় হামলা-ভাংচুর,  আহত ১০

রাজবাড়ীতে বিএনপির সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের প্রতিবাদ সভায় হামলা-ভাংচুর, আহত ১০

মুরাদনগরে মাদক, চাঁদাবাজি ও ভুমি দখলদারদের বিরুদ্ধে বিএনপির মাইকিং

মুরাদনগরে মাদক, চাঁদাবাজি ও ভুমি দখলদারদের বিরুদ্ধে বিএনপির মাইকিং

বিপ্লব কুমারকে ভারতে পাচারের দাবিদার শুভকে খুঁজছে পুলিশ

বিপ্লব কুমারকে ভারতে পাচারের দাবিদার শুভকে খুঁজছে পুলিশ