পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি এবং নিহোন হিদাঙ্কিয়’র শান্তিতে নোবেল
২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২১ পিএম | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২১ পিএম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের ওপর থেকে রাশিয়ার দৃষ্টি সরানোর নানা পরিকল্পনা হাতে নেয় মার্কিনীরা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা ছিল জাপানকে যেভাবেই হোক ধ্বংস ও পঙ্গু করে দেয়া। এজন্য তারা মরিয়া হয়ে জাপান আক্রমণ করতে বদ্ধপরিকর হয়। অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে তার বিমান বাহিনী ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হনশু দ্বীপের হিরোশিমা নগরে ‘লিটল বয়’ নামক পারমাণবিক বোমা ছুঁড়ে। এর তিনদিন পর ৯ আগস্ট কিউসু দ্বীপের নাগাসাকিতে ‘ফ্যাটম্যান’ নামক পারমাণবিক বোমা ছুঁড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।
জাপান আগ্নেয়গিরিসঞ্জাত চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত ও খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ একটি লম্বা মানচিত্রের দ্বীপ দেশ। যেখানে রয়েছে বড়-ছোট হাজারো দ্বীপের সমাহার। সবচেয়ে বড় চারটি দ্বীপ হলো- হোক্কাইদো, হনশু, কিউসু ও শিকোকু। প্রাচীনকাল থেকে এই দ্বীপগুলো নিজেদের দখলে রেখে শাসন করতো সেখানকার সামন্তপ্রভূরা। ঘন ঘন অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্প, তাইফু ও সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অতীতে জাপানের মানুষ খুব অভাবী ছিল। তাদের মধ্যে গোত্রপ্রীতির ধারণা প্রকট ছিল। দ্বীপে দ্বীপে ভিন্ন গোত্রগুলোর মধ্যে নানা কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে থাকতো। তবে তারা খুব পরিশ্রমী ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ জাতি হওয়ায় নিজেদের ‘কেন’ বা এলাকাগুলোর উন্নতি সাধন করে সুরক্ষিত করে রাখতো। এজন্য জাপানের প্রায় সব অঞ্চলে অনেক সুরক্ষিত দুর্গ দেখতে পাওয়া যায়।
ষোড়শ শতকে জাপানে সামন্ত প্রভূদের কর্তৃত্ব ছিল অনেক বেশি। তাদের তৈরি প্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি পরবর্তীতে সোওয়া ও মেইজি আমলে বিভিন্ন দানশীল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে সেগুলোর অনেক জমি ও সম্পদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ লাভ করে। হিরোসীমা দ্বীপটি জাপানের সবচেয়ে সমতল ও প্রশস্থ দ্বীপ হনশুতে অবস্থিত। জাপানীজ ভাষায় হিরোই অর্থ প্রশস্থ এবং সীমা অর্থ দ্বীপ। এই প্রশস্থ ভূমিতে ‘গো-কাসুন’ বা পাঁচটি মৌজা নিয়ে গড়ে উঠে হিরোসীমা দুর্গ। ১৮৬৮ সালে হিরোসীমা হনশু দ্বীপের বড় সামরিক কেন্দ্র ছিল। তাই এর উপর নজর ছিল রাশিয়া, চীন, কোরিয়া ও মার্কিনীদের। সেকারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা মিত্রবাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
অপরদিকে কিউসু দ্বীপের ‘নাগাসাকি কেন’ বা জেলার সবচেয়ে বড় শহরের নাম নাগাসাকি। নাগাসাকিতে আগ্নেয়পর্বতের কোলে উৎপন্ন ‘ওনসেন’ বা হটস্প্রিং বাথের জন্য বিখ্যাত। সদূর অতীতকাল থেকে নাগাসাকি ছিল বিদেশিদের জন্য জাপানে প্রবেশের সহজ দ্বার। ইউরোপ আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য জাহাজের বড় অংশ নাগাসাকি বন্দরে ভিড়তো বলে এই বন্দরের নামডাক খুব বেশি। স্বভাবতই বৈদেশিক আক্রমণ থেকে সতর্কতার জন্য এখানে অনেক সুরক্ষিত ক্যাসেল ও দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আধুনিক যুগে জাপানের বড় বড় ‘জো’ বা মিউজিয়ামের অবস্থান হয়েছে এসব ক্যাসেল ও দুর্গের ভবনগুলোতে। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে এই লেখকের সুযোগ হয়েছিল এদো, মেইজি, তাইসো ডাইনেস্টির বিভিন্ন সামন্ত রাজাদের ঐতিহাসিক ক্যাসেল ও স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার। জাপানে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীরা সেখানে স্টাডিট্যুর করার সুযোগ পায় এবং ছুটির দিনে পর্যটকগণ সেগুলোতে ভিড় করে থাকেন।
এভাবেই হিরোসীমা ও নাগাসাকি একদিকে দুর্গ ও অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসিদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী আকর্ষণ ও পরিচিতি পেয়ে যায়। জাপান অক্ষশক্তির সাথে হাত মেলানোর ফলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শক্তিধর দেশগুলোর আক্রোশের শিকার হয়ে শেষমেশ আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। ঘটে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী আক্রমণের শিকার হবার ঘটনা। তিন দিনের ব্যবধানে মার্কিনীদের নিক্ষিপ্ত পর পর দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পারমাণবিক বোমার আঘাতে ২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ ও ৯ হাজার জাপানী সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। এর পরের ইতিহাস অনেকের জানা আছে। সে ইতিহাসটি হলো পারমাণবিক বিকিরণের ফলে সেখানকার অধিবাসীদের পঙ্গুত্ববরণ করার ইতিহাস ও বিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হবার করুণ ইতিহাস।
এই করুণ ইতিহাসের যেন আর কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য সারা বিশ্বের মানুষ অদ্যাবধি মার্কিনীদের ছোঁড়া সেসব পারমাণবিক বোমার প্রতি উষ্মা ও ঘৃণা প্রদর্শন করে থাকে। এজন্য বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয় প্রতিবাদী আন্দোলন। গড়ে উঠে অনেক মানবহিতৈষী সংগঠন।
পারমাণবিক বোমার আঘাতের পর থেকে জাপানের অভ্যন্তরে যে বিষয়টি অতীব ঘৃণা, বৈষম্য সামাজিক বিভেদ ছড়াতে থাকে তা হলো- ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক অভিশাপ। এটাকে ‘হাই’-আক্রান্ত, ‘বাকু’-বোমা, ও ‘শা’-ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এভাবে যারা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় পঙ্গু হয়েছিলন অথবা যারা কোনরকমে বেঁচে গিয়ে নতুনভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন তাদের উপর নেমে আসে ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক নানা রকমের দৈহ-মানসিক যন্ত্রণা ও সামাজিক বৈষম্যের খড়গ। ‘হিবাকুসাইয়া’কথিত জেনেটিক সমস্যার গুজব ছড়িয়ে নানা অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে থাকে।
কারণ, পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার জন্য বিকিরিত রশ্মিকে সর্বজনীন সংক্রমণ ভাবা হতো। তারা সুস্থ সন্তানধারণে অক্ষম ও কর্মক্ষমতাহীন বিবেচিত হওয়ায় হিবাকুসাইয়া প্রজন্মকে কোণঠাসা হতে হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার এত বছর পর জাপানের হিবাকুসাইয়া প্রজন্ম শেষ হবার পথে। ২০২৪ সালে এসে এখন ভয় হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসরাইলের নৃশংসতায় এআই যুগের পৃথিবীতে রোবটের ভুলে আবার কোনো নতুন হিবাকুসাইয়া জন্ম নেয় কি-না!
পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রভাবে সৃষ্ট ‘হিবাকুসাইয়া’ নামক বৈষম্য ও পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার নিমিত্তে অনেক সংগঠনের মতো ১৯৫৬ সালে সৃষ্টি হয় ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’ নামক জনকল্যাণমূলক সংগঠনটি। যেটি এবছর ২০২৪ সালে এসে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’র শ্লোগান হলো ‘নো মোর হিবাকুসাইয়া’। এর মনোগ্রামের প্রতীক হলো ‘ওরিজুরু’ বা ওরিগ্যামিক ক্রেন বা কাগজে ভাঁজ করা বক। ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’র প্রতীক বক সবার জন্য সুস্থতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক। এর দ্বারা শান্তি ও সহনশীলতাকেও বুঝানো হয়ে থাকে। বাস্তবের এই বক সমুদ্রে থেকে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে শান্তি ও সৌভাগ্যের বারতা নিয়ে উড়ে বেড়ায়। এর মাধ্যমে তারা সেই বার্তা দেয়, যাতে পৃথিবীতে আর কোনো ‘হিবাকুসাইয়া’ বা সুস্থ সন্তানধারণে অক্ষম ও কর্মক্ষমতাহীন মানুষ জন্ম না নেয়।
বিশেষ করে, এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণাটি এমন সময় এসছে, যখন পৃথিবীতে নতুন করে পারমাণবিক বোমার আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরাইলের বর্বরোচিত আক্রমণের ফলে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে তার বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কারের সংবাদ এসে অনেকটা নতুন আলোচনা ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে। মানুষ নতুন করে কিছু ভাবতে শুরু করেছে।
ইরানের প্রতি ইসরাইলের তাক করা পারমাণবিক বোমার বিপক্ষে ইরান নতুন করে তাদের দিকে একই বোমা তাক করে প্রতিরোধ তৈরি করে আছে। ইসরাইল নিজে কখনও যুদ্ধ করে না। তাকে যুদ্ধ করতে সবসময় রসদ ও অনুপ্রেরণা দেয় মার্কিনীরা ও কিছু ইউরোপীয় দেশ। ফিলিস্তিনে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ হত্যার পর মার্কিনী সমর্থনে ইসরাইল এখন লেবানন, ইয়েমেন ও ইরানে আক্রমণ চালাচ্ছে। মার্কিনীদের মারণাস্ত্র বিক্রির ব্যবসা এবং ইসরাইলের প্রতি তাদের নগ্ন সমর্থন প্রতিদিন একেকটি ঘৃণ্য ইতিহাসের জন্ম দিলেও তারা কারো কথায় কর্ণপাত না করে সাধু সেজে মোড়লীপনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশ সুইডেন, নরওয়ের এ ব্যাপারে আপত্তি জানানো সত্ত্বেও তারা ইসরাইলকে মাথায় তুলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের উপর আরো বেশি খড়গহস্ত হয়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীর যুদ্ধ-নিপীড়িত মানুষ আবারো যাতে পারমাণবিক হামলার শিকার না হয় সেজন্য ‘নিহোন হিদাঙ্কিয়’র ২০২৪ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন অনেকটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে নোবেল কমিটি মনে করলেও তাদের দোসররা দিব্যজ্ঞানে কখনও সেটা মনে করে বলে বিশ্বাস করা যায় না। সেটা করতে পারলে এতদিন মার্কিন-রাশিয়াসহ বড় বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো দেশে দেশে অনবরত যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে পারতো না।
এআই যুগের পৃথিবীতে রোবটের ভুলে আবার কোনো নতুন হিবাকুসাইয়া জন্ম নিক সেটা কোনো সভ্য মানুষ চায় না। আমরা আর কোনো ট্রুম্যান চাই না, নেতানিয়াহু নামক আর কোনো অসভ্য বর্বরকে চাই না। পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার জন্য বিকিরিত রশ্মিকে আবার সর্বজনীন সংক্রমণ ভাবা হোক এমন বৈষম্যের পৃথিবীকে চাই না।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মাদক থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে কোরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষা সন্তানদের দিতে হবে -ধর্ম উপদেষ্টা
উৎপাদনে ২১১৩ পোশাক কারখানা, বন্ধ ৬টি
হাবের বার্ষিক সাধারণ সভা চেম্বারকোর্টে স্থগিত
লগি বৈঠার তান্ডবকারীদের বিচার দাবীতে পঞ্চগড়ে গণ অবস্থান
বিশেষ অভিযান জোরদার করার নির্দেশ আইজিপির
‘সংবিধানের দোহাই দিয়ে অযথা সময়ক্ষেপন করবেন না'
জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও বাংলাদেশ
বগুড়ায় সাবেক এমপি রিপুর দেহরক্ষী নিঝুম জনতার হাতে আটক।। পরে পুলিশে সোপর্দ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারি কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষা
সঠিক অবস্থানেই আছে বিএনপি
প্রকাশ্যে এলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির
ইসরাইলে ট্রাক হামলায় হতাহত ৪১
সুদানে আবারো আধাসামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত ১২০
ধিক্কারের মুখে বক্তৃতা থামাতে বাধ্য হলেন নেতানিয়াহু
আগামী ২ নভেম্বর ঢাকায় আলা হযরত কনফারেন্স
তাইওয়ানে বিলিয়ন ডলার মূল্যে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি, চীনের হুঁশিয়ারি
ইউরোপজুড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে মুসলিমরা
ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ উ.কোরিয়ার, নিশ্চুপ সিউল
নিউ ইয়র্কে ট্রাম্পের সমাবেশে অশোভন ও বর্ণবাদী মন্তব্য
গণভবন জাদুঘরে ‘আয়নাঘরের রেপ্লিকা’ রাখার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার